দেশ হতে দেশান্তরে

ডিজিটাল টেস্টামেন্টের আপেল

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

হঠাৎ করেই মুখ খুলে ভাইয়ার মুখের কথা টেনে নিয়ে, অভ্রর দেয়া এরকম একটা মোক্ষম উপসংহারে দীপ্র থতমত খেলেও নিজে হলাম আমি দ্বিতীয়বারের মতো হতবাক, সাথে কিছুটা আশংকিতও। আশংকার কারণ হলো সেই যে দুই ভাইয়ের মধ্যে আছে নিরন্তর বৈরিতা, সেটি। মুখের কথা এভাবে ছো মেরে নেবার অপরাধে ছোট ভাইয়ের উপর দীপ্র হতে পারে চড়াও এক্ষুনি।
কিন্তু নাহ! আমার সেই আশংকাটিকে এই বেইজিং হিমসন্ধ্যার হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়ে, এইমাত্র ছোটভাই কর্তৃক সঙ্ঘটিত ভয়াবহ অপরাধটিকে নিজগুনে ক্ষমা করে দিয়ে, থতমত ভাব কাটিয়ে উঠে দীপ্র বলল- “হ্যাঁ, আমিও আসলে এটাই বলতে চেয়েছিলাম। একচুয়ালি বঙ্গবন্ধু ইজ বাংলাদেশ”
প্রায় সর্বক্ষণই দুভাইয়ের মধ্যে নানান কিছু নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা, এমনকি সময়ে সময়ে যুযুদ্ধমান অবস্থা বিরাজ করলেও, আমাদের জাতীয় জীবনের হাজার বছরের ইতিহাসের এই ঐতিহাসিক সত্যটির ব্যাপারে দুই ভ্রাতার এরকম একাত্মতা পোষণে, এই টেবিলে বসে তৃতীয়বারের মতো হতবাক হওয়ার, সাথে আশ্বস্তও হলাম টেবিলের আবহাওয়া ফের অকারন গরম না হয়ে উঠায় ।
হাসিমুখে হাত উঁচু করে, চুটকি বাজিয়ে তাই দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম একটু দূরে অনিশিচতভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লালসবুজ ওয়েটারের। যেহেতু এ মুহূর্তে একজন ওয়েটারই দেখছি দেখভাল করছে এই নুডুলস বারটির, ধরে নিচ্ছি সেই নিয়েছিল আমাদের অর্ডার। আগেই বলেছি চেহারাতে আমার কাছে এখানকার বেশিরভাগকেই দেখলে মনে হয়, এ চায়নারাজ্য বুঝি যমজ ভ্রাতাভগ্নিতেই পরিপূর্ণ।
ওয়েটার আসতেই, সব্যসাচী ঢঙ্গে দুই হাতের সাথে মুখ, এমনকি শরীরের উপরাংশ সব একসাথে চালিয়ে নিজে গলদঘর্ম হওয়ার সাথে এই বেইজিং হিমে তারও ঘাম ছুটিয়ে, অবশেষে যখন মনে হলে বোঝাতে পেরেছি তাকে তার করণীয়, দেখলাম কিছুটা আমতা আমতা করতে করতেই উঠিয়ে নিয়ে গেল সে পুত্রের আধখাওয়া নুডুলসের জামবাটি টা। এতে মনে হল এরকম আব্দারটা বুঝি বড়ই আচানক ঘটনা তার জন্য । টেকএওয়ে এরা বিক্রি করলেও, এরকম আধখাওয়া নুডুলসের গামলারবাকি টুকু কেউ হয়তো প্যাকেট করে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি কেঊ এখানে কখনো!
এই ছ্যাঁচড়ামিটুকু না করলেই কি হতো না? দিলি তো দেশের নাম ডুবিয়ে। মুখ ভ্যাংচিয়ে তীব্র গলায় বলে উঠলো মনের আমি এ সময় !
আরে রাখ তোর,ফালতু কথা। খাবার নষ্ট করা হলো চূড়ান্ত ধরনের অসভ্যতাই নয় শুধু নির্মমতাও। এ গ্রহে এই ডিজিটাল সময়েও কতো আদমসন্তান যে এখনো খালি পেটে ঘুমাতে যায় প্রতিরাতে, আছে সে খবর তোর? ফালতু ভাবের কোন দরকার নাই। তুই যা বোঝস না, দীপ্র তা তোর চেয়ে ঢের ভাল বোঝে। এ নিয়ে দেশের বদনাম করে যদি কেউ, তবে সমস্যাটা সেই অলম্বুষের, আমার না। এছাড়া চায়নিজদের মতো বাঙালী তো গামলাভর্তি ঝোলঅলা নুডুলস খেয়ে অভ্যস্ত না। আগে জানলে তো দুইয়ের বদলে এক গামলা অর্ডার করেই অভ্র দীপ্র খেতে পারতো। কড়া জবাব এলো নিজেরই অন্তর্গত প্রথমজনের মুখ থেকে!
ইতিমধ্যে লাল রংয়ের ঢাকনা লাগানো হালকা সবুজ রঙ্গয়ের আয়তাকার প্লাস্টিকবক্সে সেই বেঁচে যাওয়া নুডুলস ভর্তি করে, ফিরে এসেছে ওয়েটার। সাথে আছে হাতে ছোট্ট একটা লালসবুজ ফোল্ডারও। বুঝলাম করিতকর্মা ওয়েটার নিজের কাজ কমানোর জন্য আগে থেকেই বিলও করে নিয়ে এসেছে।
এদিকে ভাবছি মনে আমি, নাহ ধারাবাহিকভাবে, নানান উসিলায় এক বা একাধিক একই রঙ্গয়ের পুনঃপুনঃ ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রেতার অবচেতন মনে ব্র্যান্ডের স্থায়ী আসন তৈরি করার বিপণনের এ কায়দাটি ভালই রপ্ত করেছে দেখছি এই নুডুলসবার! কে জানে? হয়তো এই বারের মালিক বা তার সন্তানদের কেউ হয়তো আমেরিকা থেকে এমবিএ করে বেইজিং এসে, চাকুরি না খুঁজে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে, দিয়েছে এই লালসবুজ নুডুলস বার! দেখতে হবে তো আরো আছে নাকি এই বারের ফ্র্যাঞ্চাইজি বেইজিংয়ের নানান জায়গায়?
মেন্যু দেখে খাবারের অর্ডার দেয়ার সময়ই তো জেনে গিয়েছিলাম কতো হতে পারে বিল। সে হিসাবে মাথায় তো হিসাব করাই ছিল বিলের সম্ভাব্য পরিমাণ। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য কিছুটা অনিশ্চিতভাবে ফোল্ডার খুলে ছোট্ট বিলের কাগজটা বের করতেই, বাকিসব কিছু চায়নিজ হলে দামগুলো দেখি ঠিকই ইংরেজিতেই লেখা, তাতে নিশ্চিন্ত হলাম।
খাবারের দামের সাথে ভ্যাট বা সার্ভিস চার্জ যোগ হয়েছে কি না তা বোঝার জন্য, বিলটির নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সব ফকাফকা। মানে খাবারের দামের সাথে অতিরিক্ত কিছু যোগ হয়নি। তার মানে কি? ভ্যাটের জাল এখানে কি বিস্তৃত হয়নি? হয়েছে যেমন আমার দেশসহ আরো অন্যান্য দেশে? নাকি আমাদের দেশের মতো এরাও ভ্যাট ফাঁকি দেয়। তা দিতেই পারে। চায়নিজদের যা বুদ্ধি তাতে ঐ ক্যাশ মেশিন থেকে বের হওয়া বিলেও ভ্যাট কিভাবে ফাঁকি দিতে হয় তা তাদের অবশ্যই জানারই কথা। জাল টাকার যেরকম অস্তিত্ব আছে এদেশে, সেখানে এরা সুযোগ পেলে ভ্যাট ফাঁকি দিবে না, এমন সাধু তো হবার কথা না এখানকার কোন ব্যসবসায়ির । আমাদের দেশের তুমুল মুমিন পোশাক আর চেহারা সুরতের ব্যবসায়িরাদেরই তো আছে চুরিদারির করার নানান রকম আদত! আইন কানুন না থাকলে , আর থাকলেও তা ফাঁকি দিতে পারলে পুঁজি ফেঁপে উঠে লাভে। পুঁজির লাভের লোভের কাছে অনায়াসে দেশে দেশে কালে কালে পরাজিত হয়েছে যাবতীয় নীতি নৈতিকতা ও সততা।
বিল হয়েছে সাকুল্যে ৬৭ রেন মেন বি। আচ্ছা ক্যাশ দিবো? নাকি ব্যাগে থাকা আম্রিকান ব্র্যান্ডের ক্রেডিট কার্ডটা এই চায়না মুল্লুকে আসলেই কাজ করে কি না, দেখবো তা ঝালিয়ে? ভাবতে ভাবতে ক্রেডিট কার্ডটাই বের করে ওটা ফোল্ডারে ঢোকানোর আগে ধরলাম ওয়েটারের চোখের সামনে।
পিট পিট করে চায়নিজ চোখে সেটি দেখে, মুখে নো বলার সাথে সাথে তার ডান হাত মুঠো করে তর্জনীটি খাড়া করে ডানে বাঁয়ে নাড়াতেই বুঝে গেলাম, নাহ এখানে চইলতো নো আম্রিকান প্লাস্টিকমানি। এদিকে ততোক্ষণে সে ডানহাতের বুড়ো আঙ্‌গুল তার তর্জনী আর মধ্যমার সাথে ঐরকম ভাবে ঘষতে শুরু করলো, যেমনটা করি আমরা টাকা গুনতে। হাতের ইশারায় আঙুল ঘষে যেভাবে আমরও বলি, মাল ছাড়ো মিয়া, বা ফেল নগদ নারায়ন, এ ভঙ্গিটিও তেমন। তার মানে কী? এ ব্যাপারে কি বাংলা আর চায়নিজ দেহভাষা একই নাকি? অতএব মানিব্যাগ থেকে দুটো চকচকে পঞ্চাশ রেন মেন বি র নোট বের করে ফোল্ডারাবদ্ধ করে তা তার হাতে তুলে দিতেই মাথা ঝুঁকিয়ে সামান্য নড করে চলে গেল সে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে ।
এর মধ্যে হাতের ছোঁয়াযন্ত্রের পর্দায় চোখ যেতেই, দেখি বাজছে ৮টা ১৭। সাথে সাথে সচকিত হয়ে পুত্রদের বললাম, প্রায় সাড়ে আটটা বাজছে। কাল সকালে উঠে যেতে হবে শহরের বাইরে গ্রেটওয়াল দেখতে । আজ তো সবাই খুব টায়ার্ড , অতএব ঘুমাতে হবে তাড়াতাড়ি । এখন তোমাদের রাস্তা পার করে দেওয়ার দেব হোটেলে ফিরে যেতে । তারপর আমি একা যাবো প্রথমে ম্যাকে তোমাদের ফুপ্পি আর মায়ের জন্য খাবার কিনতে।
“না না বাবা, তুমি না বলেছিলে খাওয়ার শেষে আমরা একটু খুঁজে দেখবো এখানে অ্যাপল স্টোর আছে কি না । বেশীক্ষণ না অল্প একটু ঘুরে দেখবো। এখানে তো অনেক শপ দেখছি।“ দীপ্রর এই জোর দাবীর সমর্থনে অভ্রর মিটিমিটি হাসি নজরে আসতেই কথা আর না বাড়িয়ে বললাম ঠিক আছে। তবে বেশিক্ষন না। একদম ঘড়ি ধরে ১০ মিনিট খুঁজবো ।
“ওয়াও!” বলে উল্লসিত হয়ে দু ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে তক্ষুনি উঠে দাঁড়াতেই দেখি ওয়েটারও ফিরে এসেছে ফোল্ডারে করে ফিরতি টাকা নিয়ে।
ফোল্ডারের ভেতর থেকে টাকা নিতে নিতে, ফের সেই বকশিশ বিষয়ক দ্বন্দটা, মানে ঠিক কতো বকশিশ দিলে ঠিক হয়, কিম্বা আদৌ বকশিশ দেয়া ঠিক হবে কিনা এই চায়নায় ; হাজির হতেই ওটাকে কোন পাত্তা না দিয়ে খুচরা তিন রেন মেন বি রেখে বাকিটা পকেটস্থ করতে করতে হাঁটা ধরলাম গেইটের দিকে , যেদিকে এগিয়ে গেছে এরই মধ্যে ওরা তিনজন ।
গেইট দিয়ে বের হয়ে সামনের চওড়া ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের জটলায় যোগ দিতেই বোজা গেল , কোন দিকটা তারা রেকি করবে আগামী দশ পনের মিনিটে, তা ঠিক করে উঠতে পারেনি ওরা। মানে রেকি করার জন্য এখান থেকে পিছিয়ে গিয়ে এই ব্লকটার পরের ব্লকটায় যাবে, নাকি সামনে এগিয়ে যাবে ওপাশের ব্লকটায়, এ নিয়ে আছে ওরা দ্বিধায় ! সামনের দিকে যাওয়ার সুবিধা হল, ওটা হবে তাহলে ম্যাকের দিকে এগিয়ে যাওয়া । আর পেছনের ব্লকটাতে গেলে, যাওয়া হয়ে হোটেলে ফেরার পথে। এ মনে আসতেই , চলো ওইদিকেই যাই বলে পেছনের ব্লকের নিজে হাঁটা ধরতেই, হুড়মুড় ওরাও অনুগামী হলো।
খুব জোর তিরিশ কি চল্লিশ মিটার এগিয়ে, বা দিকের পাশ রাস্তার সাথে গলাগলি করে সামনে এগিয়ে যাওয়া ফুটপাত ধরে হাটা ধরলাম, মিটার তিরিশেক দূরের ঝলমলে বিল্ডিংটার দিকে। ধোঁয়াশার চাদর গায়ে মুড়ি দিয়ে গা ভর্তি নানান রঙ্গয়ের বাতি জ্বালিয়ে বেইজিংহিমে দাঁড়িয়ে ঝিমুতে থাকা চারতলা সেই বিল্ডিংটা দেখে মনে হচ্ছে আজকের জন্য ওর মেলা হয়েছে সাঙ্গ ইতিমধ্যেই। ঢোকা যাবে না ওতে। ওটা কি কোন শপিং মল? নাকি একক কোন বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ? তা বুঝতে পারছি না। অবশ্য সেটা আমার বোঝার কথাও কি ? এলাম তো আজই প্রথম এ তল্লাটে!
এদিকে পুত্ররা ততোক্ষণে দৌড়াতে শুরু করেছে সেই আলোরমালা গলায় শরীরে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানটির দিকে, পিছু পিছু জগিংয়ের ভঙ্গিতে অনুগামী হয়েছে হেলেন। অতএব নিজেরও গতি বাড়াতেই দ্রুতই পৌঁছে গেলাম।
দালানের এমাথা ও মাথা জুড়ে লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে উপর বিশালাকার সোনালি চায়নিজ বর্ণমালায় কি যে লেখা আছে , তা বোঝার সাধ্য তো আমার নাই। তারপরও কেন জানি ওটা দেখেই বুঝতে চেষ্টা করলাম কি হতে পারে এই বিল্ডিঙয়ের উপযোগিতা। কিছুটা পুরানো দিনেরই মনে হচ্ছে দালানটাকে , ফলে জানলা গুলোসব ছোট ছোট । জানালাগুলোর ওপাশে জমাট অন্ধকার। অতএব ঠাহর করা মুশকিল।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআদালত প্রাঙ্গণে ধূমপান বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধমা নারী, নারী মা : প্রণাম তোমাকে