মা নারী, নারী মা : প্রণাম তোমাকে

ছন্দা দাশ

| রবিবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সাঁকোর মাঝ বরাবর আমার অবস্থান। না পারছি সামনে এগুতে, না পেছনের পথ ধরতে। নারী জীবন নিয়ে যে ভাবনা চিন্তা বা সচেতনতা ছিলো আমার যুগের পরিক্রমায় তা আর মেলাতে যেন কষ্ট হচ্ছে। যদি সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করি তবে যেন মনে হয় নারীর তাদের অবস্থান দৃঢ় করেছে বেশ। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছি অঝোর বৃষ্টির মধ্যেই নারী পুরুষ তাল মিলিয়ে চলছে কর্মক্ষেত্রে। আজকাল রাস্তায় যেমন মানুষের চলাচল বেড়েছে তেমনি বেড়ে গেছে যানবাহন। তাকিয়ে দেখি বাসে যাত্রী সাধারণের ওঠানামা। বেশ হুড়োহুড়ি, ধাক্কাধাক্কি। কে কার আগে উঠে সিট দখল করবে। স্বভাবতই পুরুষ এগিয়ে। কিন্তু না। আমাকে অবাক করে দিয়ে দেখি একটি তরুণী কেমন কৌশলে ত্বরিত গতিতে ঠেলেঠুলে সবার আগে উঠে পড়েছে। আমাদের সময় আমরা কখনই পারতামনা না। দেখে আমার বেশ লাগে। কেন লাগবে না?
নারীদেরও তো সময়মত কর্মস্থলে পৌঁছাতে হবে। নইলে যে লাল কালির দাগ পড়বে। তবে সবকিছু এখনও এতো সহজ হয় নি। যতটা আমি সহজ করে বলছি।
এতটা পথ আসতে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, অনেক বাক্যবাণ সইতে হয়েছে এবং অনেক দামও দিতে হয়েছে, হচ্ছে আর হবেও।
যতটুকু উন্নতির কথা লিখছি তা বিশাল সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। ইদানীং যে প্রবণতা নারীদের লক্ষ্যণীয় তা হচ্ছে বিয়ের প্রতি অনাগ্রহ। কেন? বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে নারী যখন একবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে সে কেন অন্ধকার পরাধীন জীবন চাইবে?
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় গো, কে বাঁচিতে চায়?’
এটা আমার কথার কথা না। একটু সময় নিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে একটা সংসারের জন্য নারীকে যতটা না ব্যক্তিগত ভালোলাগাটুকুর ছাড় দিতে হচ্ছে পুরুষের ততটা না। প্রশ্ন আসতে পারে পুরুষ সংসারের প্রধান চাহিদা অর্থের যোগান দিতেই গলদঘর্ম। তার জন্য তার সমস্ত চাহিদা জলাঞ্জলি দিতে হয়।
কিন্তু একবার ভেবে দেখবেন কি, শুধু অর্থ উপার্জন ছাড়া বাকি সবকিছু করেও তাকে কেন বলতে হয় আমি কিছুই করি না। অথচ পরোক্ষভাবে সেও সংসারের অর্থনৈতিক উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আমার মনে হয় সংসার তো কেবল নারীর নয়। পুরুষেরও। তাই দুজনের কষ্ট, স্বার্থত্যাগ তা কিন্তু নিজের জন্যই করছে। তবে নারীরা সর্বোচ্চ ডিগ্রির অবমূল্যায়ন করে যখন গৃহকাজে নিজের মেধা, শিক্ষার অপপ্রয়োগ করে তখন তা আমাকে বিদ্ধ করে অব্যক্ত এক যন্ত্রণায়। শুধু পুরুষ কেন নারীরাও বলে তুমি মা। তোমাকেই সন্তানের জন্য সব বিসর্জন দিতে হবে। তবে কি সন্তানও নারী প্রগতির অন্তরায়?
কিন্তু সেদিনও বদলে যাচ্ছে। সেসব বাণীতে এখন নারীদের আর দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। যেহেতু নারী এখন শিক্ষিতা, সচেতন, আত্মনির্ভরশীল। তাই তারা আজ আর শুধু সংসারের কাজে আবদ্ধ থাকতে চায় না। এতে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। সমবুদ্ধি, সমযোগ্যতা (কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি) নিয়েও কেন নারী হবার কারণে তাকেই শুধু সংসারের কাজ করতে হবে? যে সন্তানের জন্য এই আত্মত্যাগ তারাই যোগ্য হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তবে কেন নারী আর মা নামক ইমোশনাল খাঁচায় বন্দি হতে চাইবে?
চাকুরিরতা নারীদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। ঘরে বাইরে দুই দিক সামলাতে সামলাতে কখন হারিয়ে ফেলে বেঁচে থাকার আনন্দ। তাই আজ নারী বিয়ের প্রতি ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বর্তমানে ডিভোর্সের হার যে পরিমাণ বাড়ছে তাও কিন্তু নারী সচেতনতার একটা দিক।
লেখাটা শেষ করবার আগে ছোট্ট একটা অনুধাবনের কথা উল্লেখ করছি। কারণ সেদিন আমার মনে একটা আলোর দরজা খুলে গিয়েছিল। আমি থাইল্যান্ডে আমার মেয়ের অ.ও.ঞ বাসভবনের কাছাকাছি স্টুডেন্ট ভিলেজে বাংলাদেশ থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি করতে আসা এক ছাত্রীকে দেখি তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে আছে। আমি মেয়েকে বললাম সন্তান নিয়ে এসেছে পড়তে? দেশে কেই নেই? মেয়ে বললো। ও তো বিয়েই করেনি। অসহায় কোনো ডিভোর্সি পিতামাতার অসহায় সন্তানকে মানুষ করছে। এমন এখানে অনেক আছে। বিয়ে করবে না। কিন্তু তবুও মা। প্রণাম তোমাকে মা।এই তো নারীর চিরন্তন রূপ।
লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমানুষের জীবনে চাটুকারিতার প্রভাব ও প্রতিকার