দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:২১ পূর্বাহ্ণ

মঙ্গোলিয়ার কাছাকাছি পৌঁছুতেই, নাহ মানে গ্রেটহলের মঙ্গোলিয়া কক্ষের দরজার সামনে আসতেই বুঝলাম এখানকার অবস্থা হলো, ঢোকা যাবে না, ঘোরা যাবে না, ধরা যাবে না কিছু । মানে দরজা যদিও খোলা আছে এ মুহূর্তে দর্শনার্থীদের জন্য, তবে উহাতে প্রবেশ নিষেধ। কারণ দরজার সামনেই লাল ফিতা মাথায় টানটান করে বেঁধে সটান দাঁড়িয়ে আছে পিতলা স্ট্যান্ড ! অতএব দলবল নিয়ে কাঁটাতারের মানে ঐ লালফিতা নির্দেশিত সীমা রেখার এপাড়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মেরে যা চোখে পড়ল প্রথমেই তা হল, মেঝেতে বিছানো নীল রঙয়ের নানা শেডের কারুকাজে ভরপুর মোটা কার্পেটটি। আর তা দেখেই কেন যেন মনে হলে ওতে পা রাখলে, পা দেবে যাবে ইঞ্চিখানেক তুলতুলে ঐ চমৎকার পশমি কার্পেটে। তবে বড় ব্যাপার হল চারিদিকে সমাজতান্ত্রিক লালের ছড়াছড়ির মাঝে এক টুকরো শরতের বাংলার আকাশের এই নীল রঙয়ের কার্পেটকে, বড়ই চোখ জুড়ানো মন ভরানো ঠেকল। আবার কার্পেটের গোটা বুকজুড়ে জড়িয়ে থাকা চমৎকার ফুল লতাপাতা সমৃদ্ধ কারুকাজ, কেন জানি একইসাথে সমরখন্দ বোখারার কথাও মনে করিয়ে দিল ।
নাহ সমরখন্দ বা বোখারায় যাই নি কখনও আমি। কিন্তু উজবেকিস্তান তাজাকিস্তান এ সবের ছবি তো দেখেছি ঢের ছোটবেলায়, মস্কো থেকে প্রকাশিত হওয়া ঝকেঝকে রঙ্গিন উদয়ন, সোভিয়েত নারী নাকি যেন সোভিয়েত ইউনিয়ন পত্রিকা মারফত। এসময়ে সোভিয়েত নারীর শব্দদ্বয়ের নারী শব্দটির লেজ ধরেই চলে এলো মনে কবি হাফিজের সেই কবিতার চরণের কথা, যাতে তিনি প্রিয়ার গালের একটি তিলের বিনিময়ে সমৃদ্ধ গোটা সমরখন্দ বোখারা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে হাফিজের সাথে পরিচয় তো হয়েছিল বহু পরে। সেই পরিচয়ের বহু আগেই ঐসব রাশিয়ান পত্রিকায় সমরখন্দ, বোখারার সুন্দরীদের ছবি দেখেই তো তাদের প্রেমে পড়ে যে গিয়েছিলাম মনে মনে কিশোর বয়সে , সে কথাও মনে পড়ল এই মুহূর্তে। ‘এখানে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব এভাবে? ঢুকতে দিচ্ছে না কেন এরা এর ভেতরে?’ প্রশ্ন না অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করা লাজুর এই কথা কানে যেতেই মনে হল, আরে টের পেয়ে গেল নাকি ও, যে মনে আমার ঘোরাফেরা করছে বেগানা সমরখন্দ বোখারার উজবেক সুন্দরীরা? তাহলে তো আর রক্ষা নাই, এক্ষুণি আমাকে বুরবক উজবুক বানিয়ে ছাড়বে তবে।
সুতরাং আত্মরক্ষার তুমুল প্রণোদনায়, চকিতে একান্ত বাধ্যগত ভ্যাবলা স্বামীর ভাব ধরে বললাম, তাই তো তাই তো? এ কেমন কথা হল? দেখতেই যখন দিবি একটু ভেতরে ঢুকে দেখতে দিলে কি আর এমন ক্ষতি হতো তোদের? ঐ যে দেখ চমৎকার একটা মোগলাই কার্পেট। এই জবরদস্ত মোগালাই কার্পেটগুলোর উপর বসিয়ে রাখা ঐ ভোমা সাইজের সোফা গুলো মোটেও মানাচ্ছে না, তাই না? এখানে আসলে কার্পেটের উপর সাজানো রাখতে হতো রং বেরঙের মখমলে মোড়ান নানা সাইজের বালিশ, কোল, বালিশ, তাকিয়া এসব। তবেই না মনে হতো এটাকে খাঁ সাহবের হুজরা। কিম্বা থাকতে পারত জবর জং মোগলাই ডিজাইনের বিশাল সিংহাসন একটা, আর উজির নাজির কোতোয়ালদের জন্য জম্পেশ কেদারা। হড়বড় করে এসব বলেই মনে হল, অবচেতন আত্মরক্ষার প্রণোদনাটি আমার এমনই সাবধান যে; সচেতনভাবে সে সমরখন্দ বোখারা বা উজবেকিস্তানের কথা মুখ দিয়ে যাতে বের না হয় তার ব্যবস্থা করে, তার বদলে মোগল শব্দটি চমৎকার বসিয়ে দিয়েছে ঠোঁটে ! “খাঁ সাহেব মানে? কোন খাঁ সাহেবের কথা বলছ?”
না না লি খাঁ না , ভাবছিলাম সেই বিখ্যাত মঙ্গোল খানদের কথা। মানে চেঙ্গিস খাঁ, কুবলাই খাঁ, হালাকু খাঁ দের কথা।
“আচ্ছা চিনলাম না হয় ঐ সব খানদের, কিন্তু এই লি খাঁ টা কে? ব্রুস লি কে তো জানি। ব্রুস লি কি খান নাকি ?’ লাজুর এই জিজ্ঞাসায় মনে পড়ল, মনে মনে যে আমাদের শোফার কাম গাইড কে লি খাঁ নাম দিয়েছি আমি , তা তো কেউ আর জানে না। অতএব ব্যাপারটা খোলাসা করা দরকার এখন হাসতে হাসতে বললাম, লি খাঁ মানে আমাদের বেইজিং ট্যুরের ড্রাইভা। এ কথা বলেই পুত্রদের উদ্দেশ্যে বললাম বাবারা, তোমরা তো চায়নার গ্রেট ওয়ালের কথা জান। শত শত বছর আগে যে চীন, মঙ্গোলরা যাতে ঢুকতে না পারে তাদের দেশে সে জন্য অতো বড় একটা দেয়াল তৈরি করেছিল, শত শত বছর পরের সেই চায়নারই মাও সে তুং কী না, এই গ্রেটহল বানিয়ে, তার ভেতরে মঙ্গোলদের জন্য বানিয়ে রেখেছে এই চমৎকার মিটিং রুম । বোজ তবে গ্রেটে গ্রেটে কী গ্রেট তফাৎ মানে গ্রেট ওয়াল আর গ্রেট হলের কথা বলছি আর কী।
“ইজ মঙ্গোলিয়া পার্ট অব চায়না?” মোক্ষম এ প্রশ্নটি এসময় ছুটে এলো অভ্রর মুখ থেকে। বুঝলাম মাও সে তুং বা শক্তিমদমত্ত সমাজতান্ত্রিক চায়নিজদের এই প্রতীকী ব্যাপারটিতেও যে সাম্রাজ্যবাদী একটা আগ্রাসী ব্যাপার আছে, শিশু বা বালক হলেও অভ্র তা ধরতে পেরেছে! ওর প্রশ্নের উত্তরে বললাম -মঙ্গোলিয়া অবশ্যই নিজেদের স্বাধীন দেশই মনে করে, আর তারা স্বাধীনও দেশও। কিন্তু চায়না মনে করে মঙ্গোলিয়া তাদেরই দেশের অংশ। আর চায়না যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে কবে যে মঙ্গোলিয়াকে নিজের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় তা কে জানে? বলেই মনে হল নাহ ! এসব কথা ওকে বলে লাভ নেই। শতকে শতকে যুগে যুগে নানান সময়ে যে নানান দেশের মানচিত্র পাল্টে গেছে, নানান জনের আগ্রাসি কারণে, তা কি করে বুঝবে ও এই বয়সে? এই ভাবনার ঠিক পিছু পিছু মনের ভেতরে এতোক্ষণ চুপ করে থাকা দ্বিতীয়জন এক্কেবারে খেকিয়ে উঠে বলল, তোমার এরকম মনে করার কারন কী? মনে নাই তোমার এই অভ্রই বেশ ক’বছর আগে যখন ম্যাপ দেখতে শিখেছিল, তখন যখন একদিন গভীর আগ্রহে ও মনোযোগে ঘরের ফ্রিজের গায়ে দীপ্রর ভূগোল বিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য লাগিয়ে রাখা বিশ্ব ম্যাপটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে , হঠাত করে মনের তুমুল অবিশ্বাস গলার স্বরে মাখিয়ে প্রশ্ন করে বসেছিল -‘বাবা, হাউ কাম দিইজ ওয়ার এ কান্ট্রি’?
হ্যাঁ তার সেদিনের সেই, প্রশ্নের বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ আর ফাকিস্তান নামের দেশটির এক সময় একদেশ থাকার বিষয়টি। ঐ সময় তুমি যখন বেশ অবাক হয়ে ওকে পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিলে, তার ঐরকম অবিশ্বাসজনিত প্রশ্নের হেতু কী? খুব গুছিয়ে কিছু না বলতে পারলেও, যতোটুকু সে বলেছিল তাতে এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে তার শিশুমনের যুক্তিতেও কোন রকম ভূযোগাযোগহীন ঐ রকম দূরবর্তী দু’টি ভু খন্ডের একদেশ হওয়ার ব্যাপারটা তার যুক্তির ধোপে টিকছিল না মোটেও। অতএব বাচ্চা বলে, সে কিছু বোঝে না এটা ভাবা ঠিক না। তার উপর ও হল আজকালকার ডিজিটাল যুগের গুগুল করা বাচ্চা। অতএব তোমার নিজের বাচ্চা বয়সের অজ্ঞানতার নিত্তিতে ওকে মাপাটা ঠিক না। আর এখানেও তো তার খটকা লেগেছে গ্রেটহলের অন্দরমহলে মঙ্গোলিয়া কক্ষ নিয়ে। অতএব নিশ্চয় তার মনে কিছু না কিছু তো আছেই ‘আচ্ছা দাদা, তোরা একটু মাঝখানে ফাঁকা রেখে দু পাশে ভাগ হয়ে দাঁড়া, দেখি ভেতরের ঐ দেয়ালে লাগানো ঐ পেইন্টিংটা সহ একটা ছবি তুলতে পারি কি না।’ বলেই হেলেন তার মোবাইল আমাদের দিকে তাক করে পিছু হটতে শুরু করতেই, নিজেরা দুই দিকে সরে খোলা দরজার দুই কারুকার্যময় দুই কপাটের দিকে সরে দাঁড়াবার আগে, মঙ্গোলিয়ার অভ্যন্তরে চোখ বোলাতেই প্রায় মিটার পঞ্চাশেক দূরে, রুমের অন্যদিকের দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গার অনেকটা জুড়ে লাগানো চিত্রকর্মটির দিকে নজর যেতেই বুঝলাম বাইরে দেখা আর সব পেইন্টিংগুলোর তুলনায় এটা একটু ভিন্ন ধরনের বৈকি। আর চোখ জরীপ করতে গিয়ে কক্ষটির ডান দিকের দেয়ালে একটা পিতল নাকি কাসা নাকি ব্রোঞ্জের তৈরি বেশ বড় সড় গোলকৃতির কারুকার্যময় ঢাল ঝুলে থাকতে দেখলাম, যার মাঝখনে আবার সেই ব্রোঞ্জ বা পিতলেরই তৈরি একটা মানুষের মাথার আকৃতিও গড়া আছে। এসব দেখে মনে হল এই কক্ষ গুলো আসলেই সম্ভবত সাজানো হয়েছে, স্ব স্ব অঞ্চলের শিল্প সংস্কৃতির আবহে আর আদলেই।
আচ্ছা মঙ্গোলিয়ান চেহারার নয় যেহেতু এই নারীমূর্তি, তাহলে এটি নিশ্চয় কোন চায়নিজ ভাস্করের গড়া শিল্প নয়। আর তাই যদি হয়, তবে এটা কি চায়নাকে কোন দেশ উপহার হিসাবে পাঠিয়েছে? এ কথা মনে হতেই, এ বিষয়ে কোন কিছু লেখা টেখা আছে কি না তা দেখার জন্য গোটা ভাস্কর্য ঘিরে একটা চক্কর দিয়েও কোন ফল হলো না। বরং এ সময়ে একটা মজার বিষয় মাথায় এল। তা হলো শক্তিতে, সামর্থে মঙ্গোলিয়া একসময় চায়নার জন্য হুমকি আর ভয়ের কারন হলেও এখন তো পাশা উল্টে গেছে। যার কারণে রাজনীতি, সমরশক্তি, শিল্পসাহিত্য, ব্যবসা বানিজ্য এসব বিষয়ের নিরিখে বাস্তবে আর বইপত্রে চায়নার জয়গান সর্বত্র , তারপরও একটা জায়গায় কিন্তু মঙ্গোলিয়া, তার জয় নিশান ঠিকই উড়িয়ে রেখেছে , তা হল জীববিদ্যা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বালতে হয়ে প্রানিবিদ্যা। অবশ্য তা শুধু প্রাণিবিদ্যায় নয় নৃবিজ্ঞান আর সমাজবিজ্ঞানেও চায়নিজ নামের চেয়ে মঙ্গোলিয়ান নামেরই জয় জয়কার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘সমপ্রীতি’ : অন্তরে বাইরে
পরবর্তী নিবন্ধআসুন, শিশুবান্ধব বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই