দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২১ at ৫:১১ পূর্বাহ্ণ

কাঁচকলা বনাম থাম্বস আপ

ড্রাইভিং সিটেই যেহেতু দেখছি আছেন তিনি সমাসীন, নিশ্চয় তবে এই বাসের পাইলটই হবেন তিনি! কিন্তু ছিলেন কোথায় উনি? একটু আগেই তো দেখলাম সবাই যে চালকের সিটে খাঁ খাঁ শূন্যতা! এমন কি বাসের ভেতরের অন্য কোথাও কাউকে দেখেছি, এমনও তো নয়। আর এ কারণেই কিনা পৌরনিক শক্তিশেলের চেয়ে ঢের শক্তির অস্ত্র, স্ত্রীশেলের মুখোমুখি হয়েছিলাম একটু আগে। চায়নিজ ভূত টুতের পাল্লায় পড়িনি তো আবার এই বিকেল বেলায় এখানে! না কি হিম চ্যানেলের ঠাণ্ডায় সকলের নাতিশীতোষ্ণ চোখ জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল! দেখতে পাইনি তাই তাকে!
ঘটনা যাই হোক, তা নিয়ে এই হাড়হিমে সবাইকে দাঁড় করিয়ে ভাবনা গবেষণা করতে গেলে আবারো শুধু স্ত্রীশেলের মুখোমুখি হতে হবে না, বরং পড়তে হবে চতুর্মুখী আক্রমণের মুখে। দ্রুত তাই হাত নেড়ে পাইলট মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যতোটা পারা যায়, হাত পা মুখ নেড়ে বোঝালাম আরে চাচা খোল না তোমার বাসের দরজা !
উত্তরে পাইলট সাহেবও হাসি মুখে হাত নেড়ে যা বললেন তার অর্থ আমার কাছে দাঁড়ালো এই যে, “আসো না তোমরা দরজার কাছে। এতো আগে থেকেই দরজা খুলে বাসের ভেতর ঠাণ্ডা ঢোকাবো নাকি? দরজার কাছে এসে যখনি দাঁড়াবে তখনি চট করে দরজা খুলে দেবো । আর তোমরাও কিন্তু সুড়ুত করে ঢুকে পড়ো ভেতরে ঝটপট।’
চলো চলো, সবাই বাসে উঠো তাড়াতাড়ি, আমি এই ব্যাগ সুটকেসগুলো বাসের লাগেজ কেবিনে তোলার ব্যবস্থা করে উঠবো, ডানে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সবাইকে এই কথা বলতে বলতে তড়িঘড়ি ট্রলি ঠেলে সামনে এগুনোর চেষ্টা করতেই, ঢং করে একটা ধাতব আওয়াজ হয়ে ট্রলিটি নিউটনের তৃতীয় সুত্রের নিয়মে একই শক্তিতে না হলেও উল্টো একটা মৃদু পিছুধাক্কা দিয়ে থেমে পড়তেই, নজরে পড়লো মাটি, না বলা উচিৎ কংক্রিট ফুঁড়ে উঠা হাঁটুসমান উঁচু লোহার পাইপটা।
আগেই দেখেছিলাম বাস স্ট্যান্ডটির প্রতিটি বাস দাঁড়ানোর জায়গার সামনেই এই পাইপগুলো ফাঁক ফাঁক করে পোতা আছে, যাতে কোন বাসই এরচেয়ে সামনে এসে না দাঁড়ায়, তারপরও মনে ছিল না তা। পুতে রাখা ঐ পাইপগুলোর মাঝের ফাঁক গলে অনায়াসে একজন মানুষ যেতে পারলেও, ব্যাগ সুটকেস ভর্তি সুটকেস তো দূরের কথা, খালি ট্রলিটিও তা দিয়ে গলানো সম্ভব না। এখন সেই পাইপগুলোরই একটাতে ট্রলির থুতনি ধাক্কা খেতেই মনে পড়লো সেগুলোর কথা! আচ্ছা কেন এমন ভুল হল? তবে কি এই ঠাণ্ডার মধ্যে শক্তিশালী স্ত্রীশেলের মুখোমুখি হয়ে বিভ্রান্ত আমার দু চোখ আর মন তাদের যুগল মনোসংযোগে বাসের ভেতরের ড্রাইভারের অস্তিত্ব খুঁজতে ব্যস্ত থাকাতেই, ঘটলো নাকি এটা? ভাবতে ভাবতে দ্রুত ট্রলি পিছু টেনে নিজেও একটু পিছিয়ে, ডান দিকে মোচড় দিয়ে শেষ পাইপটার পাশের চওড়া ফাঁকা দিয়ে ট্রলি সামনের দিকে ঠেলে হাঁটা শুরু করতেই দেখি, এরই মধ্যে দীপ্র অভ্র দ্রুত গিয়ে বাসের গেটের সামনে দাঁড়াতেই , হাঁট করে খুলে গেল বাসের দরজা।
বাবা বাবা এক্ষুনি ওঠো না বাসে তোমরা, পুত্রদের উদ্দেশ্যে গলা উঁচু করে বলতে বলতে, ট্রলি পিছু ফেলে এগিয়ে গেলাম নিজেই সামনে -“কেন কি হল আবার” পেছন থেকে আসা লাজুর কথার উত্তর না দেয়ার ঝুঁকিটি অগ্রাহ্য করে, পুত্রদের মাঝ দিয়ে নিজেই বাসের পাদানি বেয়ে উপরে উঠে, পাইলট সাহেবের সামনে গিয়ে তড়িঘড়ি করে পাশ ব্যাগে রাখা, হোটেলের কাগজটি বের করে, দুই হাতে তা ধরে, তার চোখের সামনে মেলে, হোটেলের ছবিটি দেখিয়ে, হাত পা নাড়িয়ে বোঝাতে চাইলাম আমাদের গন্তব্য।
যতোই দেখে থাকি না কেন আমার টিকিটে দেয়া নম্বর আর বাসস্ট্যান্ডে লাগানো নম্বরটি একই। আর ওখানে দাঁড়ানো বাসেই উঠছি আমরা, তারপরও এই বিকেলে সবাই মিলে ভুল বাসে উঠে, ভুল জায়গায় গিয়ে হাজির হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য এ আমার বাড়তি সতর্কতা আর কি?
নিজে চায়নিজমূর্খ, আবার পাইলট সাহেবের ইংরেজির দৌড় জানি না; অতএব গোটা ব্যাপারটাই বোঝাতে চাইলাম দেহভাষায়। যদিও জানি না সঠিক, নিজের দেহভাষা আবার এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়ে বসে কি না! কর্মপোলক্ষে সিঙ্গাপুরে থাকার সময়ে যতটা শিখেছিলাম চায়নিজ দেহভাষা, সে গুলোই প্রাণপণ মনে করে সে মতোই বলতে চেষ্টা করলাম দেহকথা। যেমন একটু আগে সে মতোই হোটেলের কাগজটি তার সামনে দুইহাতে মেলে ধরেছিলাম। কেননা জানি যে চায়নিজদের কোন কিছু দিতে হলে, বা দেখাতে হলে, দিতে বা দেখাতে হয় তা প্রথমে দুই হাতে ধরে, একটু মাথা ঝুকিয়ে ।
বাঙ্গাল আমার এই চায়নিজ তমিজে মনে হল পাইলট সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। এক গাল হাসিতে, উপরে নীচে মাথা ঝুকিয়ে আমাকে নিশ্চিত করার সাথে সাথে, নিজের ডানহাতের আঙ্‌গুলগুলো মুঠো করে শুধু বুড়ো আঙ্‌গুল খাড়া করে বাংলা কাঁচকলা বনাম ইংরেজি থাম্বস আপ দেখালেন। যার বাংলা বনাম ইংরেজি মানে একটা আরেকটার এক্কেবারে উল্টা হলেও, চায়নিজে তার অর্থ প্রায় একই রকম তিনটা। মানে এখানে এ হল একের ভেতরে তিন। যার প্রথম মানে হল , “একদম উচিৎ কইছ বাছা ।“ দ্বিতীয়টা হল “তুমি তো বাবা দেখছি চ্যাম্পিয়ন!” আর তৃতীয় মানে, “যাও বৎস মানলাম তোমার প্রস্তাব”। এমুহূর্তে তিন অর্থের যেটাই বুঝিয়ে থাকুন পাইলট চাচা, তাতেই আমার চলে না শুধু, খুবই ভাল চলে ! অতএব একদম সঠিক কি বোঝালেন চাচা, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, ঘুরে সবাইকে বাসে উঠতে বলার সাথে বললাম বাসটার মাঝামাঝি জায়গায় যে সিট নেয় সবাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমেরিকা-কানাডার পথে
পরবর্তী নিবন্ধঅসাধারণ কূটনৈতিক মিশন শেষে বঙ্গবন্ধুর ঘরে ফেরা