দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:২৬ পূর্বাহ্ণ

গাড়ির পেছনের অংশের যাত্রীদের মধ্যে অহরহই শোরগোল তুলে নিজেদের মধ্যে নানান বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়া আত্মজরা এ মুহূর্তে থেমেছে তাদের মা আর ফুপ্পির হস্তক্ষেপে, তাই চলছে গাড়ি শুনশান। পুত্রদের মতোই নিজের মনের দুজনেরও আপাতত সন্ধি হওয়ার কারণে মিলে যাওয়া ফুরসতে একমনে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই হিমচায়নার প্রকৃতি দেখার চেষ্টা করছিলাম, একবার সামনের দিকে উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ গলিয়ে দিয়ে, তো আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ জানালার কাচের বাইরে দৃষ্টি মেলে।

কিন্তু ধোঁয়াশায় ঢাকা সামনের রাস্তায় কদাচিৎ দুয়েকটা গাড়ি দেখা গেলেও বেশির ভাগ সময়ে আছে খা খা শুন্যতা যেমন, তেমনি রাস্তার দুপাশেও মনকাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। রাস্তার ধারের গাছপালা ঝোপঝাড় সবকিছুই মনে হয়ে যেন জবুথবু হয়ে আছে হিমে। তবে রাস্তার পাশে কোনও মনুষ্য নির্মিত স্থাপনা মানে দালানকোঠা বা ঘরদোর না থাকায় এটা পরিষ্কার যে, সামনে বহুদূর পর্যন্ত লম্বমান হয়ে শুয়ে থাকা কালো অজগরের মতো রাস্তাটি ছাড়া, নগরায়নের আগ্রাসন এ এলাকায় এখনো বিস্তার করেনি থাবা। কিম্বা হয়তো ইচ্ছে করেই এখানে রেখে দিয়েছ এরা প্রাকৃতিকভাব।

সবুজ শ্যামল নদীবহুল দেশের মানুষ হওয়াতে প্রকৃতি বলতেই আমার মনে যেরকম ভেসে উঠে হয় বিশাল সবুজ ক্যানভাস, বা রং বেরঙয়ের পালতোলা নৌকা ঘুরে বেড়ানো নদীর দৃশ্য, ঐরকম কিছুই দেখছি না। ধোঁয়াশার চাদর ভেদ করে রাস্তার দুপাশে যে রং নজর পড়ছে, তা হল খড়খড়ে বাদামি আর মেটে রঙয়ের। এরকম ম্যাটম্যাটে ল্যান্ডস্কেপ কেমন যেন একটা একঘেয়েমি ধরিয়ে দিল দ্রুত চোখে।

তো সেই একঘেয়েমির নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ভাবলাম চুপচাপ একদৃষ্টিতে সামনের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে গাড়ি চালানোতে মগ্ন লি খাঁর সাথে তাহলে একটু খোসগল্প করি। ফলে বেশ ধীরে ধীরে থেমে থেমে ইংরেজিতে প্রথমে তাঁকে ব্রিটিশ কেতায় জিজ্ঞেস করলাম, আবহাওয়ার খবর। মানে বৃষ্টি টিষ্টি হয় কি না এসময়ে এদিকে। সাথে জুড়ে দিলাম স্বগত মন্তব্য, যে রকম গুমোট আবহাওয়া দেখছি, বৃষ্টি যদি হয় তবে আমাদের মহাপ্রাচির ভ্রমণের তো বাজবে বারোটা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার প্রশ্ন আর প্রশ্নের সাথে করা সম্পূরক মন্তব্যের জবাবে লি খাঁ শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকানো ব্যতিত আর কিছুই না বলাতে বুঝলাম, সকলি গরল ভেল! ফলে ইংরেজি বাদ দিয়ে খাঁটি বাংলায় তুমুল হাত পা নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম চাচা মিয়া বাড়ির খবর কী? কে কে আছে বাড়িতে আপনার? সব ভাল তো? আপনার শইলডা ভালা?

কাজ হল এবার মনে হয়। কারণ উত্তরে এবার লি চাচার মুখে এক চিলতে হাসির সাথে শোনা গেল চিং চাং চুং চাং। মনে হল যেন খুব বুঝি, বুঝেছে বুঝি আমার বাংলা! কিন্তু না, সাথে সাথে ঐ যে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের যে জায়গাটায় দিয়ে হিটারের গরম বাতাস বেরুচ্ছে, ওখানে যে একটা নাইলনের সুতায় বোনা থলিতে ঝুলিয়ে রাখা আছে তার দ্বিভাষিক মোবাইল ফোন, স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে ওটা নির্দেশ করে ফের লি খাঁ চুং চাং করতেই বুঝলাম বলছে সে যে, আমি যা জিজ্ঞেস করছি তা যেন ঐ ডিজিটাল দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করি তাকে। একবার ভাবলাম যা বলেছে চাচা, করি সেটাই। ফের মনে হল নাহ, কোনই দরকার নেই। বউ বাচ্চা পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে এই ধোঁয়াশা বিরান ধূসর রাস্তায় এভাবে ডিজিটাল দোভাষী মারফত বাৎচিত চালাতে গিয়ে, চাচার মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটলে, দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। অতএব মূলতবি করে দিলাম লি চাচার সাথে আড্ডা মারার তুমুল ইচ্ছাটিকে।

এরই মধ্যে অবশ্য কয়েকবার ড্রাইভিং সিটের দিকে কাত হয়ে স্পিডোমিটারের দিকেও নজর দিয়েছি অভ্যাসমাফিক। নাহ, লি চাচা বয়সের কারণে হোক আর নিয়ম মানার কারণে হোক, স্পিডোমিটারকে কখনোই ১০০ কি মিটারের দাগ পার হতে দিচ্ছেন না। কে জানে এই রাস্তার স্পিড লিমিট কতো? তবে চাচার গাড়ি চালানোর দেহভঙ্গিতে একদিকে বোজা যাচ্ছে যেমন তার কোনও তাড়াহুড়ো নেই, তেমনি আর বোঝা যাচ্ছে চাচা হলেন আইনমানা লোক। বেশির ভাগ সময়েই থাকছে গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা ৮০ /৯০ কিলোমিটারের মধ্যেই। স্বস্তি পেলাম তাতে। কারণ স্পিডপুলিশিং করতে হবে না আর আমার তার এ পাশে বসে থেকে।

ফলে জ্ঞানার্জনে মনোযোগ দিলাম ফের ইতিমধ্যে কোলের উপর স্থান নেয়া মিস রিনার দেয়া সেই প্যাম্পলেটটি থেকে। ঐটি পড়ে বুঝলাম যে, মিং রাজারা মুতিয়ানু অংশের মহাপ্রাচিরের অংশটি তৈরি করেছিল গ্রানাইট পাথর দিয়ে, আর প্রায় ২১/২২ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ মহাপ্রাচিরের এই অংশটি এখন পর্যন্ত ভালোভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় থাকা মহাপ্রাচিরের নানান অংশের মধ্যে অন্যতম।

সাথে সাথে মনে কেন জানি সেই ছোটবেলায় করা যাদব বাবুর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে উঠার অংকে মনোযোগ দিল। ভাবলাম প্রায় দুইহাজার বছর ধরে গড়া এই মহাপ্রাচিরের ক্ষেত্রে যদি ঐ রকম উত্থান পতন ঘটতো এই দেয়ালের, তাহলে কি এতো বৃহৎ একটা স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব হতো চায়নিজদের? মনে মনে মানসাংক কষে এর মধ্যেই একটা হিসাব দাঁড়িয়েছে মনে মহাপ্রাচীরের ব্যাপারে, তা হলো নানান রাজবংশের রাজারা ২ হাজার বছর ধরে এই মহাপ্রাচিরটি যে বানিয়েছে, সে হিসাবে বছরে গড়ে তৈরি হয়েছিল এই প্রাচীরের দশ কিলোমিটার! ক্রেন বোলডোজার ইত্যাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া, শুধুমাত্র মানবশ্রমে মানুষের হাতে বছরে দশ কিলোমিটার এরকম প্রাচির তৈরি করা চাট্টিখানি ব্যাপার তো নয়। অতো শ্রমে ঘামে রক্তে এক বছরে দশ কিলোমিটার দেয়াল তোলার পর পরের বছর যদি নয় কিলমিটার ভেঙে পড়তো, তাহলে এখন সেই দেয়ালের কতোটাই বা থাকতো ?

এ সময়ে অংকের ফাঁক গলে মনের ভেতর ঢুকে পড়ল মানবিক বিষয়। ভাবছি, আহারে কতো মানুষের যে প্রাণ গেছে এই দেয়াল তৈরি করতে গিয়ে, তার তো কোনও কিছুই লেখা নেই ইতিহাসে। আচ্ছা, তখন কি এই চায়নাতেও ক্রীতদাস প্রথা ছিল নাকি? প্রাচীন মানবেতিহাসের বড় বড় সব স্থাপনাগুলো তো তৈরি হয়েছিল অসংখ্য ক্রীতদাসের রক্তে আর ঘামেই! আজ যে আমরা টিকিট কেটে কেটে নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এরকম স্থাপনা গুলো দেখছি মহাসমারোহে, তখন কি কেউ তাদের কথা মনে করছি? বরং ইতিহাস থেকে শুরু করে এই ধরনের প্যাম্পলেট আর গাইডদের মুখের মুখস্থ কিম্বা বানানো গল্পের মধ্যেতো সততই উচ্চারিত ঘোষিত হয় ঐ সব রাজরাজড়াদেরই কথা যাদের চাবুকের চাবকানিতেই দাস নামের মানুষদের হাতে নির্মিত হয়েছিল এইসব স্থাপনা। প্রাচীন মানবসভ্যতা তো আসলে দাসেদের রক্ত ঘাম আর প্রাণের বিনিময়েই গড়ে উঠেছে।

নাহ, চলন্ত গাড়িতে বসে ছোট ছোট অক্ষরে উষ্ঠা খাওয়া ইংরেজিতে লেখা এই প্যাম্পলেটটি একটানা বেশিক্ষণ পড়া সম্ভব নাহ! কারণ মাথা কেমন যেন ঘোরাচ্ছে আর চোখেও পড়ছে চাপ, তার উপর আমার আছে মাইগ্রেনের বাতিক। সে ঝুঁকি তো নেয়া যাবে না। ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি সবুজের দিকে তাকালে নাকি চোখের বিশ্রাম হয়, কিন্তু এদিকটায় তো বেশির ভাগই খটখটে মেটে বাদামি দেখেছিলাম। তারপরও পড়া বাদ দিয়ে উইন্ডস্ত্রীনের ওপাশে দৃষ্টিকে পার করে দিলাম যদি মেলে সবুজের দেখা সেই খোঁজে।

কপাল ভাল ব্যর্থ হয়নি এবারের সে প্রচেষ্টা। এখন দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু সবুজের আভাস, রাস্তার আশেপাশে। বাদামি বা ধুসর মেটে ম্যাটম্যাটে ভাব নেই আর চারিদিকে। চারিদিকের ধোঁয়াশা ভাবটাও মনে হচ্ছে কিছুটা খোলতাই হয়েছে। সামনের দিকে কোন সুদূরে আপাতত সরল রেখায় গড়িয়ে যাওয়া এই রাস্তার শেষ যে কোথায়, তা তো জানি না। তবে মনে হচ্ছে দূরে কোথাও রাস্তার শেষ মাথায় আকাশের গায়ে একটা লম্বা আঁকাবাঁকা রেখার আভাস দেখা যাচ্ছে, যার নীচের জমাট কালচে গাঢ় রং দেখে মনে হল, আসলেই মেঘ জমলো নাকি আকাশে ?

পাশ জানালা দিয়ে এসময় নজর ফেলতেই রাস্তার অদূরে পাহাড় না বলা ভাল টিলাকারের প্রাকৃতিক স্থাপনা গুলো নজরে পড়তেই ভাঙলো ভুল। এসে পড়েছি আসলে পাহাড়ি এলাকায়। তাতে বুঝলাম সামনের দিকে দূরের আকাশের গায়ে যে জমাট রং দেখছি, ওটা কোনও মেঘের আভাস নয়। বরং এ হল ঐ যে আমাদের বিদ্রোহী কবি বলেছেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়, ব্যাপার আসলে এখানে ওটাই।

দূরের ঐ পাহাড়গুলোর মতোই, গাড়িতে পুত্রদ্বয় ঘুমাচ্ছে মনে হয়। বেশ কিছুক্ষণ হচ্ছে শোনা যায়নি তাদের কথাবার্তা বা নড়াচড়া। রাস্তায় হঠাৎ ঘটে যাওয়া ফেরারি উত্তেজনার পর, রাস্তায় বা আশেপাশে তাদের জন্য আর তেমন কোনও উত্তেজনাকর ঘটনার অবতারণা না ঘটায়, চলন্ত গাড়ির গতিজড়তার ঘোরে চোখেও মনে লেগেছে ওদের ঘুমেরই ঘোর। নাহ, শুধু ওরাই না, পেছনে ঘুমাচ্ছে মনে হয় সবাই। কারোই কোনও সাড়া শব্দ নেই। গাড়ির ইঞ্জিনের আর হিটারের থেকে বের হওয়া গরম বাতাসের সঙ্গী অতিমৃদু ঝিম ঝিম আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ আসছে না কানে।

এসময় আপাত এ নৈশব্দ ভেঙে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে আত্মমগ্ন লি খাঁর মগ্নতা ভেঙে এবার তাকে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম , হাউ ফার?

ওকে ওকে’।

যাক উত্তর পাওয়া গেল এবার। কিন্তু এই ‘ওকে’ ‘ওকে’ এর মানে যে কী বুঝতে পারলাম না। কিন্তু তাতে করার তো আর কিছু নেই। পড়েছি তো খাস চায়নিজের হাতে, তার কথার অর্থ বুঝি, আর না বুঝি চলতে তো হবে তারই সাথে। মিস রিনা করলোডা কী কামডা? এ পর্যন্ত আমাদের সহযোগিতা করার ব্যাপারে তার আন্তরিক চেষ্টায় কোনও খাদ না থাকলেও, কি যে ধরিয়ে দিল এক ড্রাইভার! অতএব ফের মনোযোগ দিলাম প্যামপ্লেটের উষ্ঠা খাওয়া ইংরেজি অনুবাদে।

পড়ছি এখন গ্রানাইট নির্মিত মহাপ্রাচিরের মুতিয়ানু অংশের দৈর্ঘ প্রস্থ উচ্চতা বিষয়ক বর্ণনা। এ পড়তে গিয়ে এতক্ষণে একটা ব্যাপারে হুশ হল আমার। তা হল ব্যাপারটা এমন নয় যে গাড়ি গিয়ে থামবে এক্কেবারে মহাপ্রাচিরের পাদদেশে। গাড়ি থেকে নেমে টিকিট কিনে সাথে সাথেই উঠে যেতে পারব আমরা তরতর করে মহাপ্রাচীরে। বরং ঘটনা হলো ঐ প্রাচিরে উঠতে হলে ডিঙ্গোতে হবে পাহাড়। কারণ মহাপ্রাচির নির্মিত হয়েছে ঐ পাহাড়ের উপরেই। অবশ্য পাহাড় বেয়ে উঠার ঐ আপাত দুঃসংবাদের সাথে কিঞ্চিৎ সুখবরও আছে। তা হল পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি বানানো আছে। উঠতে হবে সেই সিঁড়ি বেয়ে মহাপ্রাচিরের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছানোর জন্য।

হায় কী হবে তাহলে লাজুর? বেচারির পায়ে তো সমস্যা। উঠবে কীভাবে ও। আর এমনিতেও সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠার ব্যাপারে ওর আছে তুমুল আপত্তি। ঘটনা যদি শেষে এমন দাঁড়ায় যে, ও ওখানে গিয়ে বলে নাহ, ‘আমি উঠতে পারবো না অতো সিঁড়ি বেয়ে। তোমরা যাও, আমি বসে থাকি অপেক্ষায়’, যেমন বলেছিল সে বছর কয়েক আগে শ্রীলংকার সিগিরিয়া লায়ন রকের সামনে গিয়ে।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅহংকার মানুষের পতন ঘটায়
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর