দেবী পূজ্য, নারী ত্যাজ্য?

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

শহরজুড়ে সদ্য শেষ হওয়া দুর্গা পুজোর রেশ। বিশ্বাসী ভক্তদের চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিয়েছেন দেবী, আবার ফিরে আসবার আশ্বাস দিয়ে। বাঙালি হিন্দু যখন পুজো উদযাপনে ব্যস্ত, ইরানের নারীপুরুষ তখন মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে স্বাধীনভাবে বাঁচার আধিকারের জন্য। সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে পুলিশি হেফাজতে একজন নারীর মৃত্যু জাগিয়ে তুলেছে সব মানুষের ভেতরে গুম হয়ে বসে থাকা ক্ষোভকে। কেবল নারী বা পুরুষ নয়, মানুষ মাত্রই তার উপরে চাপিয়ে দেয়া কোনো বিষয়কেই আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে না। নারীর হিজাব এখন ধর্মীয় জীবনাচরণ ছাপিয়ে রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে এক ছোট ভাই যে কী না হাফেজ মাওলানা, হতাশা প্রকাশ করে বলছিল, পর্দা কেবল নারীর জন্য আসেনি, এবং পর্দা মানে কেবল পোশাকের কথা বলেনি। নারীপুরুষ উভয়কেই চোখের এবং মনের পর্দা করতে বলা হয়েছে। ছোট ভাইটি বলছিল, যখন কোনো পুরুষ নারী কি পোশাক পরেছে তা নিয়ে অভিযোগ করে, সে কী করে দেখল নারী কি পরেছে না পরেছে? ধর্মীয় নিয়ম কোন পর-নারীর দিকে না তাকানোর কথা বলেছে। নারী হিজাব পরলো কি পরলো না সেটি খেয়াল করা মানেই তো ধর্মীয় জীবনাচরণ লঙ্ঘন। আবার ফ্রান্স, ইন্ডিয়াসহ কয়েকটি দেশে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করার জন্য মামলা হয়েছে। ফ্রান্সে কয়েক মাস আগে নিষিদ্ধ করেছে বুরখিনি পরিধানকে। বুরখিনি হল সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা সাঁতারের পোশাক। এভাবে পোশাক নিয়ে দেশে দেশে চলছে নানা ঘটনা। কিন্তু, হিজাব বা পোশাক হল ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, যা রাষ্ট্রের বিষয় হওয়া সমুচীন নয়। এই পোশাকের ক্ষেত্রে সর্বত্র মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে যায় নারীর পোশাক।
স্পাইসি রোডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান্নিক, সদস্য নীনা, এলিনার সাথে ২০১৭ সালের ভ্রমণের সময় কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের নানা বিষয়ে। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এসেছিল বর্তমান বিশ্বে হিজাব নিয়ে যে রাজনীতি চলছে সেটি নিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছোটবেলায় মা-খালাদের দেখেছি বাইরে বের হলেই মাথায় কাপড় দিতে। এর যতটা না ছিল ধর্মীয় বিধান তারচেয়েও বেশি ছিল আঞ্চলিক প্রথা। ১৯৯৬ সালের দিকে স্কুলের এক সহপাঠীকে প্রথম ব্যবহার করতে দেখেছিলাম বর্তমানে যেভাবে হিজাব পরে সেই হিজাবে। এরও প্রায় ৪/৫ বছর পরে আমার বন্ধুরা মাথায় ওড়নার পরিবর্তে আস্তে আস্তে হিজাব পরা শুরু করল, কারণ ওড়না মাথা থেকে পড়ে যায়, কিন্তু হিজাব নিয়ে সেই চিন্তা নেই। ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা কখনই আরোপিত মনে হয়নি। কিন্তু, হিজাব অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল আরোপিত। হয়তো এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত বাড়ার কারণে আস্তে আস্তে মধ্যপ্রাচ্যের এই সংস্কৃতি এখানেও প্রবেশ করেছিল। আবার অন্যদিকে পাশ্চাত্যের পোশাকের প্রচলনও বেড়ে গেল ওই সময়টাতেই। তবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বদৌলতে সস্তায় পশ্চিমা পোশাক পাওয়া যেত বলে অথবা চলাফেরায় সুবিধা বলে এর জনপ্রিয়তাও বেড়ে গেল। সময়ের সাথে সাথে এই দুই পোশাকের সম্মলিত ব্যবহারও জনপ্রিয় হল। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মেয়েরা যে কেবল স্ব ইচ্ছায় নিজের পোশাক নির্বাচন করতে পারল তা কিন্তু নয়। অনেককে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে পারিবারিক বা সামাজিক চাপে পড়ে হিজাব পরতে হল, আবার অন্যদিকে অনেকে বন্ধুদের প্রভাবে পশ্চিমা পোশাক পরতে শুরু করল। এই পোশাকের বিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনাই করা যায়। কিন্তু, আসল কথা হল, কেবল নারীর পোশাক হয়ে গেল আলোচনার একটি অন্যতম বিষয়। এটি সবসময়, সব সমাজেই বিদ্যমান ছিল। তবে অঞ্চল ভিত্তিক না হয়ে, পোশাক হয়ে গেল ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক। আবার পশ্চিমা সমাজ ঝুঁকল নারীর খোলামেলা পোশাকের দিকে। নারীর শরীর হয়ে গেল ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম। এই পোশাকের বাণিজ্য এবং রাজনীতি, নারীর মেধা মননের সাথে যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামলো।
একটি আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল কয়েকজন ইরানি নারীর সাথে। তাদের কাছ থেকে জেনেছিলাম, রাস্তায় বের হলে তাদের মাথা ঢাকতেই হয়, কিন্তু অফিসে এসে তারা সেই ওড়না বা হিজাব খুলে ফেলে। প্রশ্ন হল, এই যে রাষ্ট্র হিজাবের বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দিল নারীর উপর তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তাতে কি তাদের পুণ্য হয়ে যাবে? পুরুষের চোখের পর্দার বিষয়টি তাহলে কোথায় যাবে? এ নিয়ে কারো কোনো কথা নেই।
পাড়ার ছেলে-মেয়েরা পুজো দেখতে যাবে। এ নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তার শেষ নেই। যদি ভিড়ের ভেতরে কোনো মেয়েকে অশোভন আচরণের মুখোমুখি হয়? ভিড়ের ভেতরে সক্রিয় থাকে বিকৃতমনস্ক পুরুষেরা। সুযোগ পেলেই তারা হেনস্তা করে মেয়েদের। এ দেশে শারীরিক লাঞ্ছনা যেন ভিড়ের একটি চরিত্র। এক্ষেত্রেও দায়ী নারীর পোশাক। যত দোষ নন্দঘোষের মত, নারীর পোশাক এবং নারীর ঘরের বাইরে যাওয়া যেন সকল লাঞ্ছনার জন্য দায়ী। অথচ, এই পুরুষই আবার দেবী দুর্গার সামনে হাত জোর করে প্রার্থনায় দাঁড়ায়। প্রশ্ন জাগে মনে, দেবী যদি ভিড়ের লাইনে দাঁড়ায়, তবে কি তিনি লাঞ্ছনার হাত থেকে রক্ষা পাবেন?
পরিচিত অনেকেই হিজাব পরা শুরু করেছিল রাস্তাঘাটে লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচার জন্য। তাতে যে খুব বেশি কোনো লাভ হয়েছে তা কিন্তু নয়। বিকৃত মানুষকে ধর্মের নিয়ম আটকে রাখতে পারে না।

নোট: স্পাইসি রোড একটি হিচহাইকিং এর মাধ্যমে জার্মানি থেকে ভিয়েতনাম ভ্রমণের উদ্যোগ, যেটির উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীর অধিকার এবং নারীবাদ বিষয়ে এর সদস্যদের জানার পরিধি বাড়ানো এবং ভ্রমণসঙ্গীদের সাথে অর্জিত জ্ঞান ভাগ করে নেয়া। লেখক তাদের সাথে ২০১৭ সালের কিছু সময় ভ্রমণ করেছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুতিনের পারমাণবিক হুমকি সবচেয়ে বড় ঝুঁকি : বাইডেন
পরবর্তী নিবন্ধনারীর প্রতি সম্মান