মনুষ্যঘটিত প্রভাবে বদলে যাচ্ছে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও নদ–নদীর রূপতত্ত্ব। রেল লাইনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বদলে যাচ্ছে ভূমির ব্যবহার ও এর ডেল্টা বা অববাহিকা। আর এসব পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর এবং কক্সবাজার উপকূলের ইকোসিস্টেমস বা বাস্তু সংস্থানতন্ত্র। দেশের বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এমন মন্তব্য করেন।
বিজ্ঞানীরা জানান, বহুবর্ষজীবী পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ভূমিতেই গড়ে ওঠে পৃথিবীর সকল সভ্যতা। পানিকে সমস্ত প্রকৃতির চালিকাশক্তি বলা হয়। সকল জীবন্ত প্রাণি ও উদ্ভিদের জন্য জ্বালানী হিসাবে বিবেচিত হয় পানি। কিন্তু পানি নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা ধেয়ে আসছে কক্সবাজার জুড়ে। মাত্র দুই দশক আগেও কক্সবাজার শহরসহ জেলাব্যাপী সর্বোচ্চ ৬০ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়ে স্বচ্ছ পানীয় জল পাওয়া যেত, আর এখন বাঁকখালী নদী তীরে ৩৬০ ফুট গভীরে বসানো নলকূপ থেকেও পানি ওঠছে না। এমনকি ৩৮০ ফুট গভীরে বসানো শত শত নলকূপ গত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে বিকল হয়ে গেছে। এখন প্রায় ৪শ ফুট গভীরতায় নলকূপ বসিয়ে শহরের বৃহত্তর অংশের বাসিন্দারা পানীয় জলের সংস্থান করছেন। তবে জেলা সদরের চেয়ে শোচনীয় অবস্থা উখিয়া–টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এখানে ভূ–গর্ভস্থ পানি এত দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে যে, প্রতিবছরই হাজার হাজার নলকূপ বিকল হয়ে যাচ্ছে। মাত্র ৫ বছর আগেও কুতুপালং–বালুখালীসহ পুরো উখিয়া–টেকনাফজুড়ে ৫০ থেকে ৮০ ফুটের মধ্যে নলকূপ বসিয়ে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে পানির জন্য ৭শ থেকে ৮শ ফুট গভীরে নলকূপ বসাতে হচ্ছে এখানে।
বাঁকখালী কক্সবাজার জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বারোমাসি জলধারার নদী। এই নদী তীরের গড়ে ওঠেছে কক্সবাজার শহর। শহরের আরেক পাশে সমুদ্র সৈকত। সৈকত এলাকার চেয়ে নদী তীরবর্তী এলাকাতেই ভূ–গর্ভস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। অথচ কক্সবাজারে বাঁকখালী নদীর মতোই ছোট বড় শতাধিক বারোমাসি জলধারার নদী, খাল বা ছড়া রয়েছে। এ জলধারাগুলো একদিকে দখলের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে ভয়াবহ দূষণের।
সাম্প্রতিক সমুদ্র দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের পানিতে নানা ধরনের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রাণির মৃত্যুর ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। গত মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দরিয়ানগর–হিমছড়ি পয়েন্ট সৈকতের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নানা ধরনের বর্জ্য ভেসে আসে। যেখানে প্লাস্টিকের জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, দড়ি, জাল, ককসিট, কাঠ, বাঁশ এবং প্লাস্টিকের টুকরা ছাড়াও মরা কচ্ছপ, সাপ ও মস্তকবিহীন মৃতদেহও ছিল।
গত ২০ মার্চ টেকনাফ সৈকতে ওঠে একটি মরা ডলফিন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতেও টেকনাফ সৈকতে দুটি মরা ডলফিন ভেসে আসে। এর কয়েকদিন আগে ডলফিন দুটিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলী সৈকতে খেলা করতে দেখা যায়। গত বছর এপ্রিল মাসে পরপর দুইদিনে দুটি মরা তিমি ভেসে আসে হিমছড়ি সৈকতে। একই সৈকতে ২০২০ সালের জুলাই মাসে দুই দফায় বর্জ্য–বন্যা দেখা দিলে বর্জ্যের সাথে মরা কচ্ছপ, সাপসহ আরো বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণির মৃতদেহ ভেসে আসে।
কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী জানান, গত পাঁচ মাসে শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারিঘাটে যে পরিমাণ মাছ সাগর থেকে ধরে আনা হয়েছে, তা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। এমনকি, এমন আকাল গত ২৫ বছরেও দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল আলম সাগরের পানিতে মাইক্রোবায়াল পলিউশন বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূষণ বেড়ে যাওয়ার কারণে পর্যটন শিল্পও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশংকা করেন। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে গত কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার উপকূলে সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার হার দ্রুত কমে আসছে বলে জানান নেকমের ব্যবস্থাপক সমুদ্র বিজ্ঞানী আবদুল কাইয়ুম।
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ মামুন জানান, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও নদী দখলের ঘটনায় প্রভাবশালীরা জড়িত। এজন্য তাদের কবল থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। কেবল গত দুই মাসে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় প্রায় ৬শ হেক্টর জমি দখল ও ভরাট করে ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ কেটে শতাধিক টিনের ঘর ও পাকা ভবন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। গাছপালা উজাড় হওয়ায় ২০৫ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া নদীর অন্যান্য এলাকায়ও দখলও ভরাটের কারণে নদীর গতিপথ সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য আলাউদ্দিন বলেন, ‘বাঁকখালী নদী দিয়ে আদালতে ৮টি রিট রয়েছে। দেশের আর কোনো নদী নিয়ে এত রিট নেই। বাঁকখালী নদী দখল হওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা আছে। আছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। অনেক প্রভাবশালী নদী দখলে জড়িত। একদিনে এ নদী দখল হয়নি। স্থানীয় প্রশাসন বলুন, আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলুন প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে দখল প্রক্রিয়ায় যুক্ত। অনেক জমির খতিয়ান হয়েছে, নামজারি হয়েছে–এটি কিভাবে হল?
রাজধানীর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর রাগিবউদ্দিন আহমদ বলেন, রেল লাইনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণেও বদলে যাচ্ছে ভূমির ব্যবহার ও এর ডেল্টা বা অববাহিকা। আর এসব পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে কক্সবাজারের ইকোসিস্টেমস বা বাস্তু সংস্থানতন্ত্র। তিনি বলেন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং এর আশেপাশের এলাকার দ্রুত রূপতত্ত্ব পরিবর্তনের প্রভাবে কক্সবাজার উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরের বাস্তু সংস্থানতন্ত্র বা জীববৈচিত্র্যও বদলে যাচ্ছে। যা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য মোটেই সুখকর বার্তা নয়।