দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

জয়িতা নারী : তোমাদের জন্য বিশ্ব বাঙালির অভিনন্দন

ইতিহাস কি ভাবে লেখা হয়? ইতিহাস রচিত হবার আগে তা ভাবাও যায় না। আমাদের মেয়েরা ঝিমিয়ে পড়া কলহমুখর ক্রীড়া জগতে যে ইতিহাস রচনা করে দেখালো তার তুলনা মেলা ভার। এদের কথা বলার আগে বলি, দেশে ক্রিকেট ক্রেজ মারাত্মক। অনেকটা সংক্রামক রোগের মতো। মিডিয়া সরকার জনগণ সব মিলে ক্রিকেট ই এগিয়ে। কেন এগিয়ে ? তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারবে না। এমন না যে এই খেলায় দু একটি বিজয় ধরা দেয় নি। কিন্তু সেগুলো এতো অল্প আর এতো দুস্প্রাপ্য যে এর পেছনে লগ্নিকৃত টাকা আর পাওয়ার গেমের কাছে তা নিতান্ত ই তুচ্ছ। উপমহাদেশে ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ক্রেজ যে এ বিষয়ে অবদান রাখে, তা বলাই বাহুল্য। সাথে আছে ক্রিকেট নিয়ে জুয়া আর উন্মাদনা । সে তুলনায় ফুটবল বা সকার এখন একেবারেই পরিত্যক্ত একটি খেলা । পুরুষ ফুটবল একদা আমাদের ঘুম কেড়ে নিতো। মোহমেডান আবাহনী ব্রাদার্স ইউনিয়ন বা ওয়ার্ন্ডাস ক্লাবের সোনালী অতীত এখন ধূসর পান্ডুলিপি । কোরামিন দিয়েও জাগানো যায় নি তাকে।
সাফ ফুটবলে নিরঙ্কশ বিজয়ী আমাদের মেয়েরা। তারাই এখন হট টপিক। শুরুতে আসুন সাফ ফুটবল চ্যম্পিয়ন নারী দলের নিলুফার সাথে পরিচিত হই । বাছিরন বলছিলেন, ‘সংসারে অভাব-অনটন ছিল। অভাবেুকষ্টে মানুষ করিচি। ও (নিলুফা) যদি কোনো দিক (ফুটবল) ভালো করতে পারে করুক। বাধা দেব না। মানুষ যত খারাপ বলে বলুক, শেষ দেখে ছাড়ব।’
এসএসসির পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজে ভর্তি হন নিলুফা। সেখান থেকেই এইচএসসি পাস করেন। এরপর খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিলফার খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পেছনে থানাপাড়া এলাকার আরেকজনের অবদানের কথা জানালেন বাছিরন। সেই ব্যক্তি হলেন আবু ফাত্তাহ। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। আবু ফাত্তাহ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা ছিলেন। কুঠিপাড়া এলাকায় চরে নিলুফার ফুটবল খেলা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ, ঢাকায় ভর্তিসহ যাবতীয় কাজে তিনিই সহযোগিতা করেন। সোমবার বেলা ১১টার দিকে নিলুফা বাড়িতে ফোন করেছিলেন। মাকে বলেছিলেন, ‘দোয়া কোরো মা। খুব টেনশন হচ্ছে। নামাজ পোড়ো আর কালকে (মঙ্গলবার) রোজা রেখো।’ মেয়ের কথামতো আজ রোজা রেখেছেন বাছিরন।
গতকাল সন্ধ্যায় বাছিরন মুঠোফোনে বাংলাদেশ দলের খেলা দেখেছেন। নিলুফা ফাইনালে মাঠে নামেনি। তবে এতে বাছিরনের আফসোস নেই। হেসে বললেন, ‘দলের সব মেয়েই আমার মেয়ে। সংগ্রামে মেয়ে বড় হয়েছে। আমার মেয়েদের বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। এটা আমার গর্ব।’
কয়েক বছর আগে পাকিস্তানকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে নিলুফা অর্থ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ওই টাকা দিয়ে নিলুফা জমি কিনেছে। যে বিদায় নেওয়ার সময় নিলুফার মা বললেন, একসময় যাঁরা মেয়ের খেলোয়াড় হওয়া নিয়ে নানা কথা শোনাতেন, তাঁরা এখন ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন। কটুকথার জন্য আফসোস করছেন। কেউ কেউ ক্ষমাও চাচ্ছেন। মেয়েকে বরণ করতে ঢাকায় যাবেন না, এমন প্রশ্নে বাছিরন মৃদু হেসে বললেন, ‘ইচ্ছা তো হয়। যদি ডাকে, তবে যাব।’
দেশে কঠিন চাপে থাকে নারী ফুটবল। বাস্তবতায় প্রমিলা তথা মেয়েদের ফুটবল? সেতো নানা কারণে এমনিতেই বাধাগ্রস্ত। এর সামনে পেছনে দুশমনেরা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে। মনে রাখতে হবে আমরা বলছি সামাজিক ভাবে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের কথা। সংবিধান আর খাতা কলমে আপনি একে গণতান্ত্রিক আর সেক্যুলার বলে মনে মনে শান্তি লাভ করতেই পারেন। বাস্তবে এটি এখন কোনমুখি সেটা সবাই জানেন। পোশাক খাদ্য সহ নারীদের ব্যাপারে চরম স্পর্শকাতর সমাজে মেয়েদের খেলাধুলা সবসময় বিপদের মুখে। আমরা ভুলে যাবো না পোশাকের ধূয়া তুলে নারী ফুটবল নিষিদ্ধ করার জন্য মিছিলও করা হয় দেশে। কুড়িগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ করা হয়েছে । অথবা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এমন সমাজে কলসুন্দর গ্রামের মেয়েদের হঠাৎ আলোর ঝলকানি বলে দিয়েছিল তারা আসছে। সে সব মেয়েরা? যারা কি চায়? এর জবাবে জানিয়েছিল দুবেলা খেতে চায়। আর কি চায়? এর উত্তরে ও তারা দু বেলা ভাতের কথা জানিয়ে প্রমাণ করেছিল কতটা কষ্টে আছে তারা ।
আমরা নিশ্চয় ই ভুলে যাই নি এদের সাধারণ বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার কথা। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসে ও যধাযোগ্য সম্মান পায় নি তারা। তাদের জয় তাদের অর্জনে মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও মুখ খোলে নি অনেকে। একটা কথা বলতেই হবে সবকিছুর সাথে সাথে আমাদের মিডিয়া ও পরিবর্তনের শিকার হয়েছে। তারা নারীদের খেলাধূলা নিয়ে তেমন কোন প্রচার প্রচার করে না। এর দুটি কারণ থাকতে পারে , প্রথমত: সমাজের উগ্র অংশটিকে রাগাতে চায় না বা ম্যানেজ করে রাখতে চায়। অন্য কারণটি বাণিজ্যিক। সাকিব তামিম নামের ষ্টারেরা জুয়া খেললে বা ঘর থেকে বাইরে পা রাখলেই ক্যামেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাদের খবর জানতে বাধ্য হয় জনগণ । আর নারীরা জয় করে ফিরলেও তাদের কথা বলে না কেউ।
গতকাল নেপালের কাঠমুন্ডু দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ ফুটবলে শিরোপা জিতে নেয়া মেয়েদের কথা জানুন। তাহলে বুঝবেন কোথা থেকে এসেছে তারা? কষ্ট থেকে উঠে আসলেও এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলেন বাংলাদেশের সাবিনারা। বয়সভিত্তিক ফুটবলে শিরোপা জেতা বাংলাদেশ দলের কাছে সিনিয়র পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল আকাশের চাঁদ। গতকাল কাঠমাণ্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সেই আকাশই ছুঁয়ে দিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা, কৃষ্ণার জোড়া গোল আর শামসুন্নাহারের ম্যাজিকে।একসময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিল যাঁদের নিত্যসঙ্গী, সেই মেয়েদের হাতেই আজ উড়ছে ফুটবলের পতাকা।
বাংলাদেশ দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনও সহায়-সম্বলহীন মেয়েদের পরিশ্রমে গড়া শিরোপাসৌধের কথা বলেছেন, ‘এই মেয়েরা এসেছে খেটে খাওয়া পরিবার থেকে। ফুটবল না হলে হয়তো তারা অন্য কিছু করত গ্রামের বাড়িতে। ফুটবলের সৌভাগ্য তাদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছে, এর বিনিময়ে এই মেয়েরাও ফুটবলকে দুহাত ভরে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ’
কাল দশরথ স্টেডিয়ামে সাবিনা-কৃষ্ণারা রচনা করেছে অসম্ভবের গল্প। তবে দশরথ বলেই ভয় ছিল। ঘরের মাঠে গ্যালারি উপচে পড়ে, নেপালি সমর্থকদের চিল-চিৎকারে প্রতিপক্ষ দলের খেলায় মনোযোগ ধরে রাখা যেন দ্বিতীয় লড়াই। এই উত্তুঙ্গ সমর্থনও গতকাল তাতিয়ে রাখতে পারেনি রেশমি-অনিতাদের। জীবনযুদ্ধে জয়ী সাবিনা-মনিকা-শামসুন্নাহার-কৃষ্ণারা গ্যালারির প্রতিকূল গ্রোতের বিপক্ষে সাঁতরে তীরে উঠেছেন অবলীলায়।
ছোটবেলা থেকেই তাঁরা জীবনসংগ্রামের মধ্যে এবং ফুটবলই দিয়েছে তাঁদের নতুন জীবনের দিশা। সেখানে দশরথের ভয়ে তাঁরা কুঁকড়ে যাওয়ার মেয়ে নন। দলের উইঙ্গার সানজিদা যেমন ম্যাচের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, ১১ জনের যোদ্ধা দল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব।’
এইসব মেয়েদের কি বলবেন আপনি? আমরা যারা বাংলাদেশী আমরা জানি কতটা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তারা এ জায়গায় এসেছে। জোড়া গোল করা কৃষ্ণার মা বিদ্যুতের অভাবে খেলা দেখতে পারেন নি। তার বাবা পাশের গ্রামে গিয়ে খেলা দেখেছেন। ভাই উপোস করেছিল দিদি আর দেশের জয়ের জন্য।
এরা আমাদের দেশের গর্ব। আমাদের জাতির অহংকার। আর এদের বিরুদ্ধে যারা তাদের কাজ হচ্ছে নারীর শক্তিকে আঘাত করা। তারা জানে নারী শক্তিই আমাদের দেশ জাতিকে এগিয়ে রেখেছে। যার কারণে মৌলবাদ অন্ধত্ব আর আগ্রাসীরা কোণঠাসা। থাক ওদের কথা। আজ আমাদের আনন্দের দিন। দেশে বিদেশে বাংলাদেশীদের জয় পতাকার উড্ডীন দিন। সে দিনটি যারা এনে দিয়েছে সেই অবহেলিত মেয়েদের জানাই স্যালুট। তারা পারে তারাই পেরেছে। তারাই পারবে। কন্যা জায়া জননীদের অভিবাদন জানায় সমগ্র বাঙালি জাতি।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধকুরআন ইহলৌকিক মুক্তি ও পারলৌকিক সৌভাগ্য লাভের একমাত্র গ্যারান্টি