দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ শংকা নিয়ে ফুটওভারব্রিজটি পার হলাম। যে পথ মাড়াচ্ছি সেটিই কী আমার পথ! নাকি অন্যদিকে, কে জানে! জীবনে কখনো এই পথ মাড়াইনি। তাই পথ দেখে পথ চেনার কোন সুযোগ নেই। শুধু আন্দাজের উপর পথ চলছিলাম। ফুটওভারব্রিজ পার হয়ে অপরপাড়ে গিয়ে মনে হলো, পথ ভুল হয়ে গেছে। যে মানের হোটেল আমার জন্য বুকিং দেয়া হয়েছে সেই মানের কোন ভবনই রাস্তাটির ধারে কাছে দেখা গেলো না। অবশ্য রাস্তাটিতে প্রচুর মানুষ হাঁটছে, ধারে কাছে প্রচুর দোকানপাটও। তবে তারকাখচিত হোটেলের মতো কোন অবকাঠামো নেই। এই রাস্তা ধরে দূরে কোথাও গেলে ভালো মানের কোন ভবন আছে কিনা জানি না, তবে আমার জন্য বুকিং দেয়া হোটেলটি রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই বলা হয়েছে। অতএব হোটেলটি যে এই রাস্তায় নয় সেটি বুঝার জন্য খুব বেশি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়লো না। আমি বুঝতে পারছিলাম যে হারিয়ে গেছি, তবে হারিয়ে যাওয়াতে কষ্ট থাকলেও ভয় পাচ্ছিলাম না। প্রচুর মানুষ, এত মানুষের ভিড়ে কোন ছিনতাইকারী বা চোর ডাকাত নিশ্চয় আমার পথ আটকাবে না! আমি তড়িঘড়ি উল্টো পথ ধরলাম। জাস্ট ইউটার্ন!

ফুটওভারব্রিজের উপর দিয়ে আমি পুনরায় স্টেশনের ভিতরে চলে এলাম। আবারো অনেকগুলো পথের সামনে পড়লাম। চারদিকে পথ, অচিন পথ। এবার অন্যদিকের অপরিচিত অপর একটি পথ ধরে সামনে এগুতে থাকলাম। এ পথেও প্রচুর মানুষ। কখনো নিচতলায়, কখনো দোতলায়, আবার কখনো টানেলের মতো পথ ধরে সামনে হাঁটলাম। অনেকক্ষণ হাঁটার পর যখন স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম খোলা একটি চত্বরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। স্টেশনের বাইরের ভবনের মুল ফটকের উপর বড় বড় হরফে লিখে রাখা হয়েছে ‘বেইজিং ওয়েস্ট রেলওয়ে স্টেশন’, ইংরেজীতে। আমার মনে হলো, এটিই স্টেশনের মুল প্রবেশ পথ। আরো অনেকগুলো পথ হয়তো আছে, তবে এটিই প্রধান। এখানে পৌঁছার কথাটি যত সহজে মাত্র লাইন কয়েকে লিখে ফেললাম আসলে ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না। আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে, পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ইতোমধ্যে কয়েক কিলোমিটার পথ আমার হাঁটা হয়ে গেছে। স্টেশনের ভিতরেই এতপথ!!

রাস্তায় কয়েকজনের পথ আটকে হোটেল বুকিংএর কাগজটি দেখালাম। হোটেলটি কোনদিকে জানতে চাইলাম। সবাই দাঁড়ালেন, কাগজও দেখলেন, কিন্তু হাত উল্টে হাঁটতে শুরু করেন। কেউ কিছু বলতে পারলেন না। আমি ইংরেজীতে যতই হোটেলটির সন্ধান করছিলাম, মানুষগুলো ততই যেনো বিরক্ত হচ্ছিলেন। চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইংরেজী অজ্ঞতা কিংবা ইংরেজীর প্রতি বিতৃষ্ণা আমাকে শংকিত করে তোলে। এমন বেহাল অবস্থায় কি করে আমার সামনের দিনগুলো কাটবে তা নিয়ে নতুন করে শংকিত হলাম! এক পর্যায়ে মানুষের সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়ে আমি চত্বরটি থেকে চারদিকে যাওয়া রাস্তাগুলোর প্রত্যেকটিতে হেঁটে হেঁটে আমার বুকিং দেয়া হোটেল খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভরসার জায়গা হচ্ছে যে, হোটেলটি স্টেশনের সন্নিকটে, এতে করে এই চত্বর থেকে যাওয়া রাস্তাগুলোর কোন না কোনটিতেই থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

বেশ আলোকোজ্জ্বল পথ, চারদিকের ভবনগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো। স্টেশন থেকে প্রথমে যে রাস্তাটিতে বের হয়েছিলাম সেখানে এত আলো ছিলনা, কিছুটা ছায়া ছায়া অন্ধকার ছিল। এদিকে মনে হচ্ছে আলোর বান ডেকেছে।

মাত্র কয়েকগজ হাঁটার পরই আমার চোখ চিকচিক করে উঠলো। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিল প্রত্যাশিত হোটেল। চমৎকার নিয়ন সাইনে হোটেলটির নাম প্রদর্শিত হচ্ছে। হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা হলো আমার। এ যেনো শুধু হোটেল পাওয়াই নয়, বড় ধরনের হয়রানি থেকেও বেঁচে যাওয়া! ব্যথা হয়ে যাওয়া পা দুটোকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া!! দ্রুত হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম। লবিতে গিয়ে লাগেজটি বেল বয়কে দিয়ে রিসিপশনে গিয়ে পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। আমার জন্য একটি রুম বুকিং রয়েছে বলে জানালাম।

নো প্রবলেম’, ‘নো প্রবলেম’ বলে চীনা তরুণী কম্পিউটার টিপতে লাগলেন। আমার পাসপোর্ট এবং ভিসার ফটোকপি করলেন, একটি পেপারে সাইনও নিলেন। নগদে বেশ মোটা অংকের ইউয়ান বুঝে নিয়ে আমাকে চাবি দিলেন। এখানে একটি ব্যাপার ভবিষ্যতে চীনে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের জন্য বলে রাখতে চাই যে, আমার জন্য গুয়াংজু থেকে যে দরে হোটেলটির একটি রুম বুকিং দেয়া হয়েছে রিসিপশনে একটি নিয়ন সাইনে ‘টুডে’জ রেট’ লিখে তার থেকে বেশ কমে রুম ভাড়া দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটি দেখে আমার মাথায় বাজ পড়ার মতো হলো। এত কষ্ট করে যে হোটেল খুঁজে নিলাম সেটাতে কী এভাবে ঠকে গেলাম। বুকিং এর কথা না বলে এখন রুম ভাড়া নিলে তো আমার অনেকগুলো টাকা বেঁচে যেতো! কিন্তু ব্যাপারটি এরূপ কেন হলো তা আমার মাথায় ঢুকলো না। গুয়াংজু থেকে রুম বুকিং দিয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। প্রদর্শিত রেট এবং আমার থেকে নেয়া ভাড়ার হেরফেরে বিষয়টি রিসিপশনের তরুণীকে বললাম। তিনি বললেন, অনলাইনে রুম ভাড়া বেশি! আরো কি কি সব তিনি বললেন, আমি ভালো বুঝলাম না। তবে এটুকু বুঝলাম যে, প্রতারিত হয়েছি। চাবি নিয়ে লিফটের দিকে অগ্রসর হলাম। একটি বিষয় আমি নিজে নিজে চিন্তা করে বের করলাম। অবশ্য ব্যাপারটি সত্যি সত্যি এমন কিনা সেটা আমি জানি না। হোটেলে কাউকে জিজ্ঞেসও করিনি। আমার জন্য রুম বুকিং দেয়া হয়েছিল একদিন আগে। তখন রুম ভাড়া হয়তো বাড়তি ছিল। এখন রাত, আর একটু পরই এই রুম আজকের জন্য গুরুত্ব হারাবে। তাই মাছ বাজারে শেষ সময়ে দাম কমিয়ে দেয়ার মতো তারকাখচিত হোটেলটিতে রাতে রুম ভাড়া (শুধু ওই রাতের জন্য) হয়তো কমিয়ে দেয়া হয়েছে! অবশ্য আবারো বলছি যে ব্যাপারটি এমন কিনা সেটা ঠিক আমি জানি না!

রুমে ঢুকে মনটি ভালো হয়ে গেল। চমৎকার একটি রুম। কাপল বেড। ধবধবে সাদা বিছানা, লেপ। বিছানার উপর চমৎকার একগুচ্ছ ফুল, রঙিন। সোফা, চেয়ার টেবিল, ওয়্যারড্রপসহ ওয়েল ফার্নিশ্‌ড। ভারী পর্দার আচ্ছাদনেও রয়েছে আভিজাত্য। সুসজ্জিত এমন রুমে আয়েশের ছড়াছড়ি। টেবিলের উপর দুই বোতল পানি, আপেল, কমলা, আঙ্গুর এবং কলা দিয়ে ছোট্ট একটি ফ্রুটস বুকেট। ফল দেখে মনটি ভালো হয়ে গেল। বাড়তি রুমভাড়ার কষ্ট উবে গেল। রাতে ফল দিয়ে চালিয়ে দেয়া যাবে। রাতের খাবার নিয়ে আর টেনশন করতে হবে না।

ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো সকালের ব্যাপারে কোন একটি ব্যবস্থা না করে ঘুমিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। আসলে ঘুমের উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণই ছিল না। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতেও পারিনা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। চট্টগ্রামে এখনো রাত গভীর হয়নি। বেইজিং এ রাত এগারটা ছুঁই ছুঁই করলেও চট্টগ্রামে রাত নয়টার কাছাকাছি। তাই কোনকিছু চিন্তা না করেই আমি হোয়াটসআপে (ভিপিএন দিয়ে চালু করা) কল করলাম আমাদের বন্ধু অথেনটিক ট্যুরিজমের লায়ন আনোয়ারুল আজীমকে। ইতোপূর্বেও বিভিন্ন দেশে তিনি আমাকে ট্যুর প্যাকেজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিদেশে তিনি প্যাকেজ কিনে দেন, দেশে ফিরে আমি টাকা পরিশোধ করি। বিদেশে দিব্যি রাজার হালে ঘুরলেও টাকাকড়ি নিয়ে কোন চিন্তা করতে হয়না। আজীম ভাই ফোন ধরে বললেন, রাত তো বেড়ে গেছে। ওরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়। তবুও দেখি কি করতে পারি! ঘন্টা খানেক পর এক তরুণী ফোন করে আমাকে জানালেন যে, সকাল সাতটায় হোটেলের সামনে থেকে আমাকে বাসে তুলে নেয়া হবে। পরবর্তী তিনদিন ওই তরুণী আমাকে বেইজিং ঘুরিয়ে দেখাবেন বলেও জানালেন, ইংরেজীতে। খুশি হওয়ার মতো ব্যাপার বটে!

এত রাতেও লায়ন আনোয়ারুল আজিম ভাই সব ম্যানেজ করে ফেলায় মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। কিছুক্ষণ পরই আজীম ভাই হোয়াটসআপে আমাকে ট্যুর অপারেটরের প্যাকেজ ট্যুরের সিডিউল, কোন কোন ট্যুরিস্ট স্পর্টে ঘুরাবে, খাওয়া দাওয়ার কি হবে তার বিস্তারিত পাঠিয়ে দিলেন। আজীম ভাইকে ধন্যবাদ দিলাম। টাকা পয়সার ব্যাপারে দেশে আসলে কথা হবে বলে জানালাম। অতএব একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বেইজিং শহরে নিশুতি রাতে আমি ফ্রুটস বুকেট খুলে বসলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১২.৯৪ কোটি টাকা