দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

রাত বিরাতে গাড়ি নিয়ে হেথায় হোথায় চলে যাওয়া আমার বেশ পুরানো একটি শখ। নিজের ‘ভাঙ্গাচুরা’ পুরানো মডেলের একটি গাড়ি হওয়ার পর এই শখ আরো চাঙ্গা হয়েছে। বিশেষ করে গত অন্তত বিশ বছর ধরে এই শখের সযতনে লালন করছি আমি। মানুষ লং ড্রাইভে যায়, আমি শর্ট ড্রাইভে। ইচ্ছে করলে নিশীরাতে পতেঙ্গা থেকে ঘুরে আসা, কিংবা শহরের বুকে এরাস্তা ওরাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, অথবা কোন বন্ধুর বাসায় হানা দেয়া! শহরে ফ্লাইওভার তৈরি হওয়ার পর শুধু শুধু একটু এদিক ওদিক করা, নিশিরাতের রেস্টুরেন্ট চালু হওয়ার পর হুট করে রাত একটার সময় বেরিয়ে পড়ে ধুমায়িত এক কাপ কফি খেয়ে আসার ঘটনা প্রায়শ ঘটাই আমি। এর আগে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য কুমিল্লায় চলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছিলাম। বন্ধুবান্ধবেরা মিলে কুমিল্লায় গিয়ে রেস্টুরেন্টে চা নাস্তা খেয়ে ফিরতি পথ ধরেছি অনেকবার। নিশীরাতে পতেঙ্গার সাগরপাড়ে বেড়াতে যাওয়াতো অনেকটা নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এতে করে মাঝরাতের রাস্তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা অনেকদিনের। যেন প্রতিটি বাঁকই আমার চেনা! চীনের শেনজেনগুয়াংজু মহাসড়কে নিশীরাতে চলতে গিয়ে একেবারে ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। এই নিশুতি রাতেও অসংখ্য গাড়ি। আমাদের রাস্তা জুড়ে দেখি ট্রাকের কাফেলা। অথচ এই মহাসড়কজুড়ে চলছে প্রাইভেট কার এবং জীপের মিছিল। হাল ডিজাইনের শত শত গাড়ি! এত রাতে এরা কী ঘরে ফিরছে, নাকি কাজে ছুটছে! কায়সার ভাই বললেন, কেউ কাজ থেকে বাসায় ফিরছেন, কেউবা কাজে যাচ্ছেন। শিফটিং ডিউটি চলে সব কলকারখানায়। বিশ্বের মেগা কারখানা খ্যাত চীনের ফ্যাক্টরীগুলোর মেশিন বন্ধ হয়না, রাতে দিনে চলে। শুধু মেশিনের পেছনের মানুষগুলোই পাল্টে যায়। শেনজেন গুয়াংজু সড়কের দুইপাশে থাকা বহুতল ভবনগুলোর জানালা থেকে ছিটকে আসা আলোকরশ্মি কায়সার ভাইর বক্তব্যের সত্যতার জানান দিচ্ছিল। আকাশছোঁয়া এক একটি ভবনের জানালা থেকে ছিটকে ছিটকে আসছে আলো। এসব ভবনে বহু ধরনের কারখানা রয়েছে। অধিকাংশই প্রযুক্তি নির্ভর বলেও জানালেন কায়সার ভাই।

রাস্তায় অনেক আলো। গাড়ির হেডলাইটের পাশাপাশি পুরো রাস্তায় এমনভাবে স্ট্রিট লাইট জ্বলছে যে, অন্ধকারের কোন চিহ্ন নেই রাস্তায়। আমাদের গাড়ি ছুটছে, গুয়াংজুর দিকে।

বেশ রাতে ঘরে ফিরলাম আমরা। ইউছুপ আলী ভাই এবং ভাবী চলে গেছেন। আমার বিছানা শিফট করে ওনাদের বেডরুমে দেয়া হয়েছে। চীনা গৃহপরিচারিকা বিছানাপত্র ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে গেছেন। কায়সার ভাই বললেন, ‘আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। ততক্ষণে আমরা খাবারগুলো গরম করে নিই। ডিনার করে ঘুমাবো।’

আমি মাথা নাড়লাম। ‘উইন্ডো অব দ্যা চেঞ্জে’র সামনে যখন ফ্রেঞ্চ ফ্লাই, চিকেন ফ্রাই এবং কফি খাচ্ছিলাম তখন মনে হয়েছিল রাতে আর কিছু খেতে হবে না। এখন এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে মনে হচ্ছে কিছু একটা খেতে খারাপ লাগবে না।

নানা পদের তরকারিতে টেবিল ভর্তি। ভাবীর হাতের রান্নাও আছে। রান্না আছে চীনা নারীর। কায়সার ভাই এবং জোবায়ের ওভেনে গরম করে নিয়েছেন। খাওয়া দাওয়ার পর রকমারি টাটকা ফলও খেলাম। রাতে কলা খেতে না করা হয়, কিন্তু এমন টাটকা কলা যে না খেয়ে পারলাম না। বেশ আয়েশ করে চমৎকার স্বাদের একটি কলাও খেয়ে নিলাম। আহ, কী মনভরিয়ে দেয়া গন্ধ! আমাদের পার্বত্যাঞ্চলের সূর্যমুখী কলার মতো গন্ধ, কিন্তু দেখতে সাগর কলার মতো!

চা কফি কিছু খাবো কিনা জানতে চাইলো জোবায়ের। মাথা নাড়লাম। এত রাতে আর বেচারাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছিল না। বাইরে গিয়ে খেয়ে আসতে পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু কিছুই যে শহরে চিনি না সেখানে রাত বিরাতে ঘর ছাড়া ঠিক হবে না। সকালে তাড়াহুড়োর কিছু না থাকায় বেশ নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করলাম।

সকালে আমাকে কেউ ডাকে নি। তাই আমার ঘুমও ভাঙ্গেনি। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে জাগার পর চীনা গৃহপরিচারিকা ব্রেকফাস্টের কথা বললেন। তিনি যে কী বললেন তা আমি কিছুই বুঝলাম না। শুধু ব্রেকফাস্ট শব্দটি বুঝতে পেরে বাকিটা বুঝে নিলাম। নাস্তার টেবিলে ব্রেড বাটার এবং ফলমুল দেখে বেশ খুশী হলাম। মনে হলো এতেই চলে যাবে। আর কিছু না হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই চীনা মহিলা পরোটার সাথে ডাবল ডিম পোজ এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখলেন। রাজকীয় নাস্তার জন্য আর বাড়তি কিছুর দরকার হয় না।

নাস্তা সেরে বাসা থেকে বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম অফিসে। ইউছুপ আলী ভাইর গুয়াংজু অফিসে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার এসেছি। এতে করে গুয়াংজু শহরের তেমন কিছু না চিনলেও বাসা থেকে অফিস পর্যন্ত রাস্তাটি চিনি। ফলে বাসা থেকে অফিসে পৌঁছতে আমার কোন সমস্যা হলো না। অফিসে জাহেদ ভাইসহ সবাই আছেন। জাহেদ ভাই ইউছুপ আলী ভাইয়ের ভায়রা ভাই। আমার সাথেও দারুণ সখ্যতা। তিনি আমাকে দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হলেন। বললেন, কোথায় কোথায় ঘুরেন, আপনার তো দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। আমি হাসলাম। তিনি দুই কাপ কফি বানিয়ে টেবিলে বসলেন। অফিসে একটি মেশিন আছে। যেটিতে কল ঘুরালেই চা কফি বেরিয়ে আসে। যার যার ইচ্ছেমতো চা কফি নিয়ে টেবিলে বসে। এখানে বেল টিপে পিয়ন ডাকার কোন সিস্টেম নেই।

আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। আমার যে কজন একসাথে চীনে গিয়েছিলাম তারা সকলেই দেশে ফিরে গেছেন। আমার বন্ধু লায়ন ফজলে করিমের নেতৃত্বে চীনে গিয়েছিলাম আমরা। ইউছুপ আলী ভাই জোর করে আমাকে রেখে দিয়েছেন, অন্যরা দেশে ফিরেছেন। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে আমি ফোন করে আমার প্রিয় এডিটর স্যার এম এ মালেকের সাথে কথা বলেছি। আটকে যাওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, সমস্যা নেই। বেড়িয়ে আস। আবার কখন যাবে বা আদৌ আর কোনদিন যাবে কিনা তার তো ঠিক নেই। দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক ভাইর সাথেও কথা হয়েছে। তিনিও একই কথা বলেছেন। অতএব অফিসে ফেরার তাড়া নেই। ছুটি বা চাকরি নিয়েও সমস্যা নেই। তাহলে কী বেইজিং চলে যাবো! ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বেইজিং এর মতো জায়গায় একা গিয়ে সবকিছু কি সামাল দিতে পারবো! দেখে শুনে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবো!! বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে পারবো, আবার মনে হচ্ছে কঠিন হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই একা একা ঘুরেছি। কিন্তু চীনে ভাষাগত সমস্যায় সবকিছু যত কঠিন হয়ে উঠেছে অন্য কোথাও তেমনটি হয়নি। তাছাড়া চীনে খাবার দাবারের সমস্যাও বেশ প্রকট। শিয়াল কুকুর ব্যাঙ শাপ জোঁক থেকে শুরু করে এমন কোন কুখাদ্য নেই যা যখন তখন টেবিলে পাওয়ার আশংকা থাকে না। অর্ডার দিতে না জানলে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কী যে ভোগান্তি হয় তার বহু গল্প বিভিন্ন সময় শুনেছি। তবে ঠিকঠাকভাবে অর্ডার করতে পারলে চীনের বহু খাবারের স্বাদই মন প্রাণ ভরিয়ে দেয়।

জাহেদ ভাইকে অনুরোধ করলাম আমার সাথে বেইজিং যেতে। বললাম, চলেন, দিনকয়েক বেড়িয়ে আসি। কিন্তু তিনি হাত তুলে দিয়ে বললেন, অফিসে প্রচুর কাজ। অনেক কাজের অর্ডার। এখন গুয়াংজু ছাড়া কঠিন। একইভাবে হাত তুললেন কায়সার ভাই। জোবায়ের চীনা ভাষা খুব ভালো জানে না। সুতরাং তাকে সাথে নেয়া আর না নেয়া একই। বাকি থাকে ইউছুপ আলী ভাইর অফিসের চীনা তরুণী। তাকে সাথে নিয়ে বেইজিং যাওয়ার কথা বলাওতো যাবে না!

জাহেদ ভাই আমাকে সাহস দিয়ে বললেন, আরে ভাই, চলে যান। কি আর হবে! একা মানুষ। আসাযাওয়ার টিকেট অনলাইনে করে নিন। হোটেল এখান থেকে বুকিং দিয়ে ফেলুন। গিয়ে হোটেলে উঠবেন। হোটেলেই বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর প্যাকেজ দেয়। একটি নিয়ে তাদের সাথে ঘুরবেন। বেড়াবেন। ফেরার সময় ঠিক সময়মতো ট্রেনে চড়ে বসবেন। গুয়াংজুতে এসে নেমে পড়বেন। জাহেদ ভাই বললেন, ট্রেন জার্নি অনেক মজার, তবে যদি বিমানে যেতে চান তাও পারেন। কায়সার ভাইও জাহেদ ভাইয়ের কথায় সমর্থন দিয়ে বললেন, ‘ট্রেনে যান। চীনের ট্রেন জার্নি অনেক মজার। তিনশ’ কিলোমিটার বেগে ট্রেন ছুটবে। আনন্দ পাবেন।’ (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযত্নে থাকুক নগরীর টুকরো সবুজ সজীব কেন্দ্রগুলো
পরবর্তী নিবন্ধঅনন্যা শেখ হাসিনা