দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

খাবারের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। তবে তার কোন প্রভাব ছিল না আমাদের আড্ডায়। আমরা বেশ খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটির সাথে একটি জোড়া দিয়ে চলছিল নানা গল্প, কথা। পুরো পৃথিবী চক্কর দিচ্ছিল আমাদের গল্প। কখনো ইউরোপ তো কখনো আমেরিকা, আবার কখনো চীন তো কখনো কলকাতা। কোন দেশের সাথে কোন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন তা থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য সবই নিয়ে গল্প করছিলাম আমরা। আবার কোন কোন দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু কিংবা ফলমুল নিয়েও কথা হচ্ছিল আমাদের। দুনিয়ার নানা দেশের নানা স্বাদের খাবার দাবার নিয়েও কথা বলছিলাম। মেক্সিকোর অতি ঝাল খাবারের গল্প যেমন আমরা করছিলাম, তেমনি জাপানের মিঠা মিঠা খাবারের স্বাদ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ইউরোপের আধা সবজি কিংবা আলু থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডের দারুণ সব রেসিপি আমাদের আড্ডায় আলোচিত হচ্ছিল। খাবার নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা চলছিল ঠিকই, কিন্তু কেএফসিতে আমাদের অর্ডার দেয়া খাবার সার্ভ করা হচ্ছিল না। এতক্ষণতো লাগার কথা নয়, কি করছে এরা! কোলকাতা নিউমার্কেটের সন্নিকটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কেএফসিতে বসে আছি আমরা। অপেক্ষা করছি খাবারের। অর্ডার দিয়েছি অনেকক্ষণ হলো। এতক্ষণ লাগার কথা নয়। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি সময় লাগছে বলেও আমার মনে হচ্ছিল। একই সাথে এত মানুষের এত অর্ডারের জন্য মনে হয় তাদের প্রস্তুতি ছিল না। তাই একসাথে অনেকগুলো অর্ডার সামলাতে তাদের বাড়তি চাপে পড়তে হয়েছে! তবে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছিল ওই দুই সুদর্শন যুবকের আচরণ। একজন পূর্ব দেয়ালে হেলান দিয়ে পশ্চিম দেয়ালের কাছাকাছিতে থাকা অপরজনের সাথে ইশারায় কথা বলে যাচ্ছিলেন। নানা ঢঙ্গে অঙ্গভঙ্গি করছিলেন তিনি। কেএফসির চেইনশপে এমন একটি দৃশ্য অকল্পনীয়। তবে আমার চোখের সামনেই তা ঘটছিল। আমি আড়চোখে তা দেখছিলাম এবং শুধু আশ্চর্যই নয়, কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলাম।
টুংটাং শব্দে বেল বাজতে শুরু করলো। আমাদের অর্ডার নম্বর দেখা গেলো ডিজিটাল ডিসপ্লেতে। অর্থাৎ আমাদের খাবার তৈরি, ক্যাশ কাউন্টারের টেবিলে দেয়া খাবারের ট্রে নিজেদের কালেকশন করে টেবিলে নিয়ে বসতে হবে। খাবারের পর কাগজের প্যাকেটসহ অন্যান্য ময়লা গুছিয়ে বিনে ফেলতে হবে এবং নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হবে ট্রে। আমরা কয়েকজন কাউন্টার থেকে খাবার ভর্তি ট্রে তুলে আনতে গেলাম। অনেকগুলো ট্রে আমাদের। হঠাৎই আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, ওই দুই যুবক আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন। কয়েকটি ট্রে তারা দুজনে তুলে নিলেন। আমরা শুধু কোল্ড ড্রিংকসগুলো নিয়ে আমাদের টেবিলে এসে বসলাম। ওই দুই যুবক আমাদের সবার সামনে ট্রে সাজিয়ে রেখে দিলেন। এতক্ষণ তাদের উপর যে বিরক্ত তৈরি হচ্ছিল তা তাদের হাসিমুখের সেবা পেয়ে নিমিষেই উবে গেল। আমাদের টেবিলে খাবারের ট্রে এনে দেয়া তাদের দায়িত্বে ছিল না। তারা কাজটি না করেও নিজেদের মতো থাকতে পারতেন। কিন্তু তারা আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন। খাবার আমাদের সামনে দিয়েই তারা সরে পড়লেন, আবারো নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে লাগলেন। আমি আড়চোখে তাদের দেখছিলাম, কিন্তু আগের মতো আর বিরক্ত হচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কাজের সময় কাজ করে বাকি সময় যদি সহকর্মীদের সাথে একটু মজা করা যায় তো মন্দ কি!
যাক, আমরা আয়েশ করে কেএফসি খেতে লাগলাম। ফ্রাইড চিকেন, সাথে একেবারে তুলতুলে নরম বন, ফ্রেঞ্চফ্রাই। ডিনারের জন্য এর থেকে বেশি কিছু দরকার হয়না। আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বার্গার অর্ডার করবেন কিনা জানতে চাইলেন। অন্য কিছু খাবো কিনা তাও। আমরা সবাই সমস্বরে ‘না’ বলে উঠলাম।
উৎসবমুখর পরিবেশে আমাদের ডিনার পর্ব সাঙ্গ হলো। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বন এবং কোল্ড ড্রিংকসের চনমনে ডিনার। হোটেলে ফিরে এককাপ কফি হলেই পৃথিবীর কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না। তবে কফির ব্যাপারটি আমি মনে মনে রাখলাম। আমি মনে মনে আরো একটি জিনিস নিয়ে যোগ বিয়োগ করছিলাম। এডিটর স্যার আমাদের একটি নতুন জিনিস দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন কোন জিনিস তিনি দেখাননি, আমরাও দেখিনি। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, আমার স্যার নতুন জিনিস দেখানোর কথা ভুলে গেছেন। এতরাতে আমিও আর বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে স্যারকে বিব্রত করতে চাইলাম না। তাই কিছু না বলে নিজের মতো করে থাকলাম।
কেএফসি থেকে বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। আমরা পুরো দলটি দরোজার দিকে পা বাড়ালাম। কাঁচের বিশাল দরোজাটি ঠেলতে যাবো এমন সময় এডিটর স্যার আমার দিকে তাকালেন। নতুন কিছু দেখতে পেয়েছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি আকাশ থেকে পড়তে শুরু করলাম। প্রথমত নতুন জিনিসের কথাটি দুপুরে বললেও এতরাতেও স্যার তা ভুলেন নি। দ্বিতীয়ত নতুন জিনিস মিস করার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি নড়ে চড়ে উঠলাম। কারণ আমি তো নতুন কিছু দেখিনি। কেএফসিতে নতুন করে দেখবোই বা কী! কিছুটা আমতা আমতা করে চারদিকে চোখ বুলালাম। ওই দুজন তখনো হাত এবং চোখ নাচাচ্ছেন। আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়লাম। বললাম, ‘ না স্যার, নতুন কিছু দেখি নি।’
স্যার হাসলেন। আবারো জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছুই কী দেখো নি?’ আমি আবারো চারদিকে চোখ ঘুরালাম। না, নতুন কিছু নেই। সবই তো দুনিয়ার অন্যান্য কেএফসির মতো। টেবিলে টেবিলে অনেক নারী পুরুষের মুরগীর ঠ্যাং চিবুনোর অতি স্বাভাবিক দৃশ্য!
স্যার বললেন, কেএফসির এই ফ্রেঞ্চাইজিতে কর্মরত স্টাফদের একজন ছাড়া বাকি সবাই বধির, বোবা। এরা কেউ কথা বলতে পারে না। কানেও ভালো শুনে না। এদের মধ্যে শুধু একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ রয়েছে। ওই যে ক্যাশে বসে যে অর্ডার নিচ্ছে সে ছাড়া বাকি সবারই অবস্থা একই। তার পাশে বসা তরুণীও। বোবা এবং বধির মানুষগুলো কেএফসির অন্য দশটি ফ্রেঞ্চাইজির মতো এটিও পরিচালনা করে। খাবারের মান কিংবা সার্ভিসে একটুও কমবেশি হয়না। বোবা এবং বধির মানুষ যে সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ- সেটি দেখাতেই কেএফসি বিশেষ এই উদ্যোগ নিয়েছে। তারা জাস্ট একটি উদাহারণ দাঁড় করিয়েছে। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানও শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে। এটিই তোমাকে দেখাতে চেয়েছিলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে ফ্রেঞ্চাইজির ভিতরে নানা কাজে ব্যস্ত মানুষগুলোকে দেখলাম। ক্যাশে বসে থাকা তরুণীটিকেও দেখলাম। সবাই যে যার মতো কাজ করছিলেন। তাদের চলনে বলনে এবং কাজে কোথাও কোন সীমাবদ্ধতা ছিল না। কারো কোন সমস্যাও হচ্ছিল না। কেএফসিতে অনেক নারী পুরুষ। তারা নিজেদের মতো করে খাবারের অর্ডার করছেন, খাবার নিচ্ছেন, খাচ্ছেন, নির্দিষ্ট বিনে ময়লা এবং নির্দিষ্ট স্থানে ট্রে রেখে কাস্টমারেরা চলে যাচ্ছেন।
স্যারের সাথে বিদেশ ঘোরার মজাটাই আলাদা। এই মজা আসলে বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না। কত কিছু যে স্যার দেখেন, দেখান। পৃথিবীর দেশে দেশে কতকিছু যে দেখেছি ! কিন্তু আজ কোলকাতার কেএফসিতে নিজেকে একেবারে নতুন করে আবিস্কার করলাম। আমি বের না হয়ে উল্টো ক্যাশ কাউন্টারে চলে গেলাম। পুরো কেএফসি চালাচ্ছে বোবা এবং বধির লোকজন! কাউন্টারে বসা সুস্থ যুবকের সাথে একটু কথা বলার অনুমতি চাইলাম। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বোবা এবং বধির মানুষদের নিয়ে কাজ করতে তার কেমন লাগে জানতে চাইলাম। তিনি হাসলেন। এই ধরনের ফ্রেঞ্চাইজিতে কাজ করতে হলে ‘হাসি’ শিখতে হয়। চমৎকার করে হাসলেন তিনি। চোখ ফেরালেন পাশে বসা তরুণীর দিকে। পুতুলের মতো সুন্দরী মেয়েটিও বোবা এবং বধির। তার মুখেও হাসি। নিশ্চয় আমার প্রশ্নটি তরুণী শুনতে পেয়েছেন।
যুবক বললেন, আমি তো কখনো ওভাবে ভাবিনি। তারা আমার সহকর্মী। আমি যেভাবে কাজ করি, তারাও করে। একজন স্বাভাবিক মানুষ যা কাজ করেন, এরাও ঠিক তাই করে। তাদের কথা বলার তো কোন দরকার হয়না। কোন কাস্টমারের সাথে কথা বলতে হলে আমিই বলি। ওরা অন্যান্য কাজ করে। একজন স্বাভাবিক সহকর্মী যেভাবে সহায়তা করে ওরাও তাই করে। কোন কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি করে। নিজেদের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সজাগ থাকায় তারা একটু বেশি সচেতন থাকে বলেও তিনি মন্তব্য করলেন। যুবক বললেন, বোবা এবং বধির হলেও আমার সহকর্মীরা অত্যন্ত সচেতন। তারা তাদের দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আমি বেশ চমকিত হলাম। এত মানবিক একটি আয়োজন এত কাছ থেকে দেখতে পেয়ে অন্যরকমের ভালো লাগছিল আমার। মুগ্ধ হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম আমি। ওই দুই তরুণ তখনো হাত নাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে নিজেদের মতো করে খুনসুটি করছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের সারথি বাংলাদেশের প্রতিবিম্ব
পরবর্তী নিবন্ধস্কুল পড়ুয়াদের করোনা টিকা বাবা-মা’র যা জানা প্রয়োজন