স্কুল পড়ুয়াদের করোনা টিকা বাবা-মা’র যা জানা প্রয়োজন

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | বুধবার , ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সহসা ‘স্কুল শিক্ষার্থীদের করোনা টিকাকরণ’ শুরু করা হবে বলে সংবাদমাধ্যমে মত প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে সতর্কতা মূলক নানা বিধিমালা মেনে দেশের বিদ্যালয়সমূহে ছাত্র- ছাত্রীরা ক্লাসে হাজির থাকছে। শিশুর সার্বিক বিকাশে বিদ্যালয়ের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, করোনা অতিমারিতে বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের নিরাপদ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা তেমনই চ্যালেঞ্জের বিষয়।
একসময় ধারণা করা হলেও সামপ্রতিক তথ্য মতে – বিদ্যালয় কর্মসূচির কারণে সমাজে করোনা সংক্রমণ বিস্তৃত হওয়ার উল্লেখযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। তবে করোনা অতিমারিতে শিশু- কিশোর- কিশোরীর আক্রান্ত হওয়ার হার নেহাৎ কম নয়। বয়স্কদের তুলনায় শিশুবয়সে করোনার প্রকোপ কম, কিংবা করোনার উপসর্গাদি মৃদু মাত্রার হলেও, শংকার নানা জায়গা থেকে যায়। যেমন-১. কোভিড সংক্রমণে শিশু কিশোর কিশোরীও আক্রান্ত হচ্ছে। ২. তারা-ও বড়দের মতো অসুস্থ হচ্ছে। বিশেষত যে সব শিশু আ্যাজমা, থ্যালাসেমিয়া, ডায়বেটিস ও অন্যান্য দীর্ঘ মেয়াদি রোগে ভুগছে, কিংবা অপুষ্টিগ্রস্ত বা অন্যান্য কারণে রোগ প্রতিরোধ শক্তিতে দুর্বল, তাদের করোনা ঝুঁকি অত্যধিক। কোভিড আক্রান্ত শিশু ‘মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম’ এর মতো মারাত্মক জটিলতার শিকার হচ্ছে। করোনা সংক্রমিত হয়ে মারাত্মক অসুস্থতাসহ আইসিও কেয়ারে যাওয়া বা মৃত্যুর শিকার হওয়া শিশুর সংখ্যাও অনেক। ৩. করোনা টিকা না নেওয়া শিশুরা, ঘরে ও সমাজে উপসর্গহীন থেকেও বড়দের মতো করোনা সংক্রমণ ছড়ায়। এইসব কারণ বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগস এডমিনস্ট্রেশন(এফডিসি), এবং সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল( সিডিসি), ১২ থেকে ১৭ বছরের স্কুল বয়সীদের করোনা টিকাকরণের জরুরি অনুমতি প্রদান করে। এইসব সংস্থা এই বয়সীদের ওপর টিকা প্রয়োগের এই পর্যন্ত প্রাপ্ত সকল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করেছে। করোনা প্রতিষেধক এই টিকার নিরাপদ মাত্রা এবং কার্যকারিতা বিবেচনা করে এই বয়সীদের টিকাকরণের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাকরণের সুফলসমূহ : শিশুস্বাস্থ্য ও রোগ সংক্রমণ তত্ত্ববিদ বিজ্ঞানীরা এই বয়সী স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাকরণের নানা সুফল উল্লেখ করেছেন। যেমন- ১. করোনা টিকাকরণ শিশুর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। এবং শিশুকে করোনা সংক্রমণজনিত মারাত্মক অসুস্থতা, রোগ পরবর্তী জটিলতা ও দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গ হতে নিস্তার পাইয়ে দেয়।
২. শিশুর করোনা প্রতিষেধক টিকাকরণ শিশুর পরিবার ও সতীর্থদের মধ্যে তার মাধ্যমে কোভিড -১৯ রোগ ছড়ানো প্রতিরোধ করে বা তার ঝুঁকি কমিয়ে আনে। ৩. শিশুকে করোনা প্রতিষেধক টিকা দানের সাহায্যে সার্স- কোভিড-২ ভাইরাসের নতুন নতুন রুপান্তর ও অধিক সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন মিউটেশন ঘটবার ঝুঁকি কমায়। ৪. স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাকরণ স্কুলে কর্মরত লোকজনদের করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। সমাজেও করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি হ্রাস পায়।
টিকাকরণ সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া : ফাইজার এর করোনা ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে এই বয়সের লক্ষ লক্ষ শিশুকে দেওয়া হয়েছে। সমপ্রতি মর্ডানা টিকাও ১২ বছর এবং তার বেশি বয়সী শিশুকে দেওয়ার জরুরি অনুমোদন পেয়েছে। এই বয়সীদের জন্য এই দুটো টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপদ মাত্রা সন্তোষজনক।
খুব অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে এই দুই এমআরএন – এ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ পরবর্তী হার্টের মাংসপেশির প্রদাহ (মায়োকার্ডাইটিস) ও হার্টের চারপাশের আবরণের প্রদাহ ( পেরি কার্ডাইটিস) হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এই প্রতিক্রিয়া সাধারণত বয়ঃসন্ধি ও তরুণদের মধ্যে এবং পুরুষ জনগোষ্ঠীতে বেশি ঘটে। তবে টিকাজনিত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাওয়া এই অসুখ সাধারণভাবে মৃদু মাত্রার থাকে এবং সহজে নিরাময়-যোগ্য।
শিশুকে করোনা টিকাকরণজনিত অন্যান্য সচরাচর প্রতিক্রিয়া হলো – টিকা দেওয়ার স্থান ব্যথা, ফোলা ও লাল হয়ে যাওয়া। এর বাইরে কোন কোন শিশু অতিরিক্ত ক্লান্তি, শিরঃপীড়া, গা হাত পায়ে ব্যথা, জ্বর নিয়ে ভুগতে পারে। এইসব উপসর্গ ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সেরে যায়।
টিকাকরণ সম্পর্কিত সাধারণ তথ্যাদি : স্কুল শিক্ষার্থীদের ফাইজার- বায়োএনটেকের দুই ডোজ করোনা ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে করোনা টিকাকরণ করার কথা। সেক্ষেত্রে যেসব বিষয় মেনে চলা উচিত –
১.নির্দিষ্ট টিকাদান কেন্দ্রে শিশুকে বসা বা শোয়ানো অবস্থায় এই টিকা প্রয়োগ করা হয়।২. টিকাকরণ সময় ও তার আগের এবং পরের ঘটনা সম্পর্কে শিশুকে ভালো ভাবে অবহিত করে নিতে হবে, যেন সে ভয়-ভীতি মুক্ত পরিবেশে থাকে।
৩.টিকাদানের পর ১৫- ৩০ মিনিট টিকা কেন্দ্রে অবস্থান করা। এতে করে কোন পার্শ্ব – প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা যাবে। প্রয়োজনে ত্বরিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও দেয়া সম্ভব হবে।
উপসংহার : করোনা অতিমারিতে বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করতে স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাকরণ, স্কুল শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের টিকাকরণ হলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে যোগদান, খেলাধূলায় ও গ্রুপ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য করোনা টিকাকরণ অপরিহার্য। এর সাথে হ্যান্ড হাইজিন ও সামাজিক দূরত্ব এর মতো সকল কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সাথে যেসব শিক্ষার্থীর হাম কিংবা অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধক টিকা গ্রহণের কথা আছে তা যেন নিয়ম মেনে যথাসময়ে শিশুকে প্রয়োগ করা হয় – বাবা-মা ‘র উচিত সে বিষয়ে খেয়াল রাখা।
লেখক : প্রফেসর, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু-স্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধযেসব ডিভাইসে কাজ করবে না জিমেইল-ইউটিউব-গুগল ম্যাপ