দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

তারকাখচিত হোটেল। সহজ করে বললে ফাইভ স্টার। স্টারের বহু কিছুর সাথে আমাদের কোন সংশ্রব নেই। তবুও বিদেশে এই ধরনের হোটেলই আমাদেরকে দেয়া হয়, রাখা হয়। ফাইভ স্টার হোটেলের রুম ভালো হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এত ভালো হবে আশা করিনি। চীনের এই হোটেলের ভাবসাবই মনে হচ্ছে একটু আলাদা। দারুণ সব আয়োজন। চমৎকার করে সাজানো গোছানো বিছানা। আসবাবও অনেক। রাত কাটানোর কিংবা জীবনধারণের জন্য এতকিছুর দরকার হয়না। অথচ রুমে সব জিনিসই দিয়ে রাখা হয়েছে। জুতা পালিশ করার ব্রাশ থেকে শুরু করে কফি খাওয়ার মেশিন পর্যন্ত। ছোট্ট ফ্রিজে মিনিবার। মদ বিয়ারে ভর্তি ফ্রিজ। সাথে বাদাম, বিস্কিট, চিফস। মদ খাওয়ার জন্য যা যা লাগে তার সবই রয়েছে ছোট্ট ফ্রিশটির কুঠুরিতে। ঠান্ডা বিয়ার আরো ঠান্ডা করে খাওয়ার জন্য বরফকুচিও। মদ বিয়ারে আমার কোন আসক্তি নেই। আসক্তি নেই অন্যান্য খাবারগুলোর প্রতিও। ফলে মিনিবার নিয়েও কোন আগ্রহ নেই। অবশ্য চড়া দামের এসব পণ্য খেতে বুকের পাটাও লাগে। ছোট্ট একটি উদাহারণ দিই। একটি ২০ টাকা দামের চিফস এই ধরনের মিনিবারের ছোঁয়ায় একশ’ টাকারও বেশি হয়ে যায়। ছোট্ট এক প্যাকেট বাদামের দাম কখনো কখনো ৫শ’ টাকা। ১৫/২০ টাকার পানির দাম ৭৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা। অতএব এত বিলাসিতা আমাকে মানায়না, আমি এসবের দিকে কখনো হাতও বাড়াইনা। তবে কফির প্রতি বরাবরই দুর্বল আমি। কফির ব্যাপারে পারতপক্ষে কোন আপোষ করিনা। দর নিয়েও খুব বেশি ভাবি না। তবে এক্ষেত্রে রুমে মাগনায় কফি খাওয়ার প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম দেখে শুধু আশ্বস্তই নয়, খুশীও হলাম।
বিছানায় গা এলিয়ে দিতে গিয়ে মনে হলো এত সুন্দর বিছানাটি নষ্ট করে ফেলবো! চমৎকার করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ধবধবে সাদা একটি বিছানা। রুমের মিষ্টি আলোতে বিছানাটির রূপ যেন আরো খুলে গেছে। কী যে মোহনীয় লাগছে! সাদা বিছানার উপর রঙিন তোয়ালের সাহায্যে বানানো হয়েছে ‘হার্ট’। রঙিন ‘লাভ’ সাইনের পাশে বর্ণিল ফুল! বিছানা জুড়ে কী অসাধারণ নান্দনিকতা! রঙিন তোয়ালে দিয়ে বানানো ‘হৃদয়ে’র আকুতি যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। ফুলে ফুলে কী অনন্য আয়োজন। আমি বেশ স্মরণ করতে পারি যে, আমার বাসর রাতের বিছানাও এত জমকালো ছিল না। আমি হলফ করে বলতে পারি যে, আমার দেশের লাখো কোটি মানুষের বাসর রাতের বিছানাও এত সুন্দর হয়না। মোহনীয় এই বিছানায় শুয়ে কেমন সুখ লাগবে জানি না, তবে দেখে যে হৃদয় ভরে গেছে তা বেশ টের পাচ্ছিলাম। এমন বিছানা শুধু দেখতে হয়, চোখ জুড়িয়ে মন ভরিয়ে অনুভব করতে হয়। শুয়ে পড়লেই তো নষ্ট হয়ে গেল। এমন আয়োজন হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে হয়, নষ্ট করার কোন মানে হয়না!
ইন্টারকম বাজছিল। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে লায়ন ফজলে করিম ডিনারে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলেন। বললেন, বের হন, আমি আসছি। করিম ভাই জানালেন যে, ‘এখানে রাত ৮ টার মধ্যে ডিনার শেষ হয়ে যায়। তবে আমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় মাঝরাতে ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশি কিছু থাকবে না। গরম ভাতের সাথে চিকেন বা হাঁসের মাংস দিয়ে সারাতে হবে। সাথে কোন একটি ভেজিটেবল।’ কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। রুমে আপেল কমলা এবং কলার একটি ব্যুকেট দেয়া রয়েছে। আমি একটি আপেল খেয়ে রাত কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু করিম ভাই বললেন যে, আমাদেরকে যারা ট্যুরে এনেছে ডিনার না করলে তারা মনে কষ্ট আনবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস মেশিনারীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জ্যাকের অতিথি আমরা। এত বড় কোম্পানির অতিথি না খেয়ে ঘুমালে তাদের ইজ্জত থাকে ! অতএব…।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখলাম খাঁ খাঁ করছে। তবে আসার পথে বারে প্রচুর লোক দেখলাম। অগুনতি নারী পুরুষ, তরুণ তরুণী হল্লা করছে। ডিসকোর আওয়াজও কানে আসছিল। রাত মাথায় তোলার জমকালো নানা আয়োজন ডিসকোর আলো আঁধারীতে। ডিসকো বা বার নিয়ে আমাদের কারো কোন চাঞ্চল্য দেখা গেল না। আপাতত পেটে ভাত পরলেই আমাদের চলে। রেস্টুরেন্টের চারদিকে রুম। ছোট ছোট রুম। দশ বারোজন মানুষ বসে খাওয়া দাওয়া করতে পারে এমন সব রুম। চীনা সংস্কৃতির এমন রেস্টুরেন্ট বিশ্বের আর কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না কিংবা খেয়াল করিনি। চীনের যে ক’টি রেস্টুরেন্টে খেতে ঢুকেছি সবগুলোতেই খোলা চেয়ার টেবিলের পাশেই ছোট ছোট অনেকগুলো রুম। পরিবার বা স্বজনদের নিয়ে এসে নিজেদের মতো করে লাঞ্চ ডিনার করার এমন আয়োজন সত্যিই সুন্দর। প্রাইভেসি রক্ষার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে হৈ হল্লা বা উৎসব করলেও কারো কিছু বলার থাকে না। কারো কোন অসুবিধাও হয়না। ব্যাপারটি দারুণ।
ডাল ভাত সবজি। আমরা বিভিন্ন পাত্র থেকে নিজের মতো করে প্লেটে খাবার তুলে নিলাম। হাঁসের মাংস খেতে ইচ্ছে করলো না। তাই মাংসের ধারে কাছেও গেলাম না। চীনা রেস্তোরায় বসে ডাল সবজির বাঙালী খাবারে ডিনার সারলাম।
কখন যে সকাল হয়ে গেছে টের পাইনি। রুমের জানালায় এত ভারী পর্দা যে বাইরের কিছু বুঝারও উপায় নেই। ইন্টারকমের পাখির ডাকের মতো রিং টোন না বাজলে ঘুমই ভাঙতো না। লায়ন ফজলে করিম ভাইর ফোন। তিনি আমাকে দ্রুত তৈরি হওয়ার তাগাদা দিলেন। বললেন, ‘নয়টার মধ্যে রেবিয়ে যেতে হবে। নাস্তা সেরে নিতে হবে। দ্রুত করুন।’ বের যে হতে হবে তা জানি। আমাদেরকে আজ সকালে বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রোগ্রাম আগেই দেয়া আছে। তাই দ্রুত তৈরি হয়ে রেস্টুরেন্টে ছুটলাম। নাস্তা করতে হবে। নাস্তার আয়োজন কেমন কে জানে! রাতের মতো হলে কপালে দুঃখ আছে।
রেস্টুরেন্টে প্রচুর লোক। দরোজায় আমাদের রুম নম্বর জিজ্ঞেস করা হলো। অর্থাৎ আমরা রুমে ছিলাম, নাকি নাস্তা করতে আসা কাস্টমার। আবার আমাদের রুমে গেস্টের সাথে নাস্তার টাকা দেয়া আছে নাকি নাস্তার টাকা না দিয়ে রুম নেয়া হয়েছে তা এই একটি কাজের মাধ্যমে চেক করা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের রুম নম্বর একটি কাগজে টুকে নিল তরুণী। অপর এক তরুণী আমাদেরকে একটি টেবিলে নিয়ে বসার ইঙ্গিত করলো। এখন আর আমাদেরকে কোন ছোট্ট রুমে নেয়া হলো না। রেস্টুরেন্টেই খোলা জায়গায় একপাশে টেবিল দেয়া হলো। টেবিলে পানির বোতল, টিস্যু, কাঠি এবং চামুচ দেয়া আছে। খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে অপরপাশের বিশাল টেবিলজুড়ে। টেবিলটিও বেশ সুন্দর, কয়েকটি স্তর, যেন কয়েকতলা। একটির পর একটি তাক, যেন একটির উপর অপর টেবিল। প্রতিটি তাকে সাজানো হরেক রকমের খাবার। একপাশে রাখা হয়েছে প্লেটও। ওখান থেকে প্লেট নিয়ে খাবার তুলে নিতে হবে। অতপর প্লেটে নিয়ে টেবিলে বসে খেতে হবে। যেখানে হাত, চামুচ কিংবা কাঠি দিয়ে খেতে পারেন। দুইটি কাঠি ব্যবহার করে কী করে যে সব খাবার এমনকি মাছও খাওয়া যায় তা গতরাতে দুই চীনার কাছ থেকে দেখেছিলাম। তারা বেশ ধৈর্য ধরে আমাকে কাঠি দিয়ে খাবার খাওয়ানো শেখাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি কাঠি শক্ত করে আঙ্গুলে আটকে রাখতে হয়, সব খেলা চলে অপর কাঠিতে। অবশ্য আমি পুরোপুরি শিখতে পারিনি, কিছুটা পেরেছিলাম। যাক, কাঠি না হলেও সমস্যা নেই। হাত কিংবা চামুচের অপশনও রয়েছে। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট, যতক্ষণ ইচ্ছে যতভাবে ইচ্ছে নাস্তা করা যাবে। এই নাস্তার টাকা রুম ভাড়ার সাথে নিয়ে নেয়া হয়েছে,অন্যভাবে বললে রুমের সাথে নাস্তা ফ্রি। (অবশ্য ব্রেকফাস্ট ছাড়াও রুম ভাড়া নেয়া যায়। তখন ভাড়া কম পড়ে। এতে করে নাস্তা ফ্রি ভাবার কোন সুযোগ নেই।) সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নাস্তা করতে হয়। অবশ্য এই নাস্তা রেস্টুরেন্টে বসেই খেতে হয়, রুমে বা বাইরে নেয়া যায় না। যা নেয়ার পেটেই নিতে হয়, প্যাকেট বা পকেটে নয়। তবে রুমে বসেও নাস্তা করার সুযোগ আছে। তার জন্য প্রচুর বিল গুনতে হয়। রুমে বসে ব্যুফের ফ্রি নাস্তা খাওয়ার কোন সুযোগ নেই। শুনেছি যে এই ধরনের পাঁচতারকা হোটেলে গিয়ে আমাদের দেশের ব্যাংক মেরে দেয়া বহু ঋণখেলাপী রুমে বসে নাস্তা করেন, রেস্টুরেন্টে যান না। অবশ্য ব্যাপারটি কতটুকু সত্য তা আমি জানি না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদে সড়কে চলতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ