প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

অধীনস্থদের প্রতি নবী পাকের (স.) দয়া

রহমতুল্লিল আলামিন নবী পাক (স.) নিজে অধীনস্থদের প্রতি দয়া, সহমর্মিতা দেখিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের প্রতিও দিক নিদের্র্শনা দিয়ে গেছেন।
যেমনঃ- নবী পাক (স.) আমাদের উদ্দেশ্য বলে গেছেন:
১. তাদেরকে নিজ ভাই বলে মনে কর ।
২. তাদেরকে গালিগালাজ করবে না।
৩. নিজেরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাবাবে।
৪. নিজেরা যা পরিধান করবে তাদেরকে তা পরিধান করাবে।
৫. তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ তাদের চাপিয়ে দিবে না।
৬. যদি কোন কাজ তাদের সাধ্যের বাহিরে হয় তাহলে তাদেরকে নিজে সহযোগিতা কর।
বহুকাল পূর্ব হতে বিশ্বে দাসপ্রথা চলে আসছিল। দাস-দাসীদের প্রতি যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার করা হত। তাদেরকে সমাজের মধ্যেই গণ্য করা হত না। অতি ইতর শ্রেণী হিসাবে তাদের সাথে পাশবিক আচরণ করা হত। তাদের ব্যাপারে মানবাধিকারের কোন প্রশ্নই উঠত না। ঘটনাচক্রে কেউ একবার দাস হলে পরবর্তী কালে সে ‘আযাদ’ হয়ে গেলেও কলংকের তিলক তার ললাট হতে মুছত না। কারও পূর্বপুরুষের কেউ ক্রীতদাস হলে পরবর্তী বংশধররাও দাসরূপে গণ্য হত। দাস-দাসীদিগকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হত। তারা ছিল মনিবগণের মনোরঞ্জনের পাত্র। মাতা ও কন্যা উভয়েই দাসী হলে মাতৃত্ব ও সন্তানত্বের ভেদাভেদ টুকুর প্রতি মর্যাদাও প্রদর্শন করা হত না। দাস-দাসীদের খোরপোষ দানও ছিল মনিবদের একান্ত অনুগ্রহের বিষয়। মনিবরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বিভোর রইলেও দাস-দাসীদের ভাগ্যে জুটত অর্ধাহার অনাহার।
মানবতার এই গ্লানিকর যুগে সাম্যের অনুপম এক আহ্বান নিয়ে এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হয়েছিলেন নবী পাক (স.)। তাঁর আহ্বান ছিল মানবাধিকার, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের। মনিব ও দাস, শুধু এই পার্থক্যের কারণে একজন অন্যজন হতে তুচ্ছ বা মর্যাদাশালী হবার অধিকার রাখে না। তাঁর শিক্ষা ছিল মনিবরা যা ভক্ষণ করবে দাস-দাসীদিগকে সেই আহার্যই দিতে হবে, মনিবরা যা পরিধান করবে দাসদিগকে তা পরাবে। শ্রেণীভেদ নিয়ে ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করার অবকাশ নাই। মহান আল্লাহ নবী পাক (স.) কে নির্দেশ দিয়ে বলেন:
“হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করও না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডাকিও না; ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এই ধরনের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয় তারাই যালিম।”
“হে মানুষ! আমি তোমাদিগকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে আমি তোমাদিগকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে; যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।”
নবী পাক (স.)’র দুইজন খাদেম/সেবক তথা কাজের লোক হলেন (১) হযরত যায়েদ (র.) (২) হযরত আনাস (র.)।
যায়েদ ইবন হারিছা (র.) বৃত্তান্ত ছিল নিম্নরূপ: হযরত যায়েদ ছিলেন বানূ কালব গোত্রের এক বালক। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মাতা স্বগোত্রীয় লোকগনকে দেখতে রওনা করেছিলেন। আকস্মিক তিনি অপহরণকারীদের কবলে পড়লেন। ডাকাত দল যায়েদ কে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তাকে উকায বাজারে বিক্রয় করে। হাকীম ইবনে হিযাম তাকে স্বীয় ফুফু হযরত খাদিজা (র.) এর জন্য চার শত দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করে নিলেন। নবী পাক (স.) হযরত খাদিজা (র.) কে বিবাহ করলে হযরত খাদিজা (র.) তাঁকে নবী পাক (স.)কে উপহারস্বরূপ দান করেন। পরবর্তীকালে যায়েদের পিতা ও চাচা পবিত্র মক্কায় আসলেন। তারা তাকে বিনিময় দানের মাধ্যমে নবী পাক (স.)’র নিকট হতে মুক্ত করতে চাইলেন। নবী পাক (স.) তখন তাঁকে এই এখতিয়ার প্রদান করলেন যে, সে চাইলে চলে যেতে পারে এবং চাইলে তাঁর নিকট থাকতে পারে। হযরত যায়েদ (র.) নবী পাক (স.)’র নিকট থেকে যাওয়াকে পছন্দ করলেন। ইবন মানদা কর্তৃক প্রণীত মা’রিফাতুস সাহারা গ্রন্থে বর্ণনামতে হযরত যায়েদ (র.)’র পিতা সেই সময়ে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। অতঃপর নবী পাক (স.) তাঁকে পালক পুত্র হিসাবে ঘোষণা করলেন।
যায়েদ ইব্‌নে হারিছা (র.) ছিলেন নবী পাক (স.) এর একজন দাস। নবী পাক (স.) তাঁকে এতই আদর স্নেহে লালন-পালন করতেন যে লোকজন তাঁকে নবী পাক (স.) এর পুত্র বলে আহ্বান করত। এমনকি তিনিও তাঁকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে আযাদ করে দিয়েছিলেন। বংশীয় আভিজাত্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি তদীয় ফুফাত ভগ্নি যায়নাব বিনতে জাহশা (র.) এর সহিত এই যায়েদ ইবনে হারিসা (র.)’র বিবাহ দিয়েছিলেন। ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর পরাকাষ্ঠা হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা (র.) কে মুতার যুদ্ধের সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। তিন হাজার সম্ভ্রান্ত বংশীয় মুহাজির ও আনসারের নেতা নিযুক্ত হলেন একজন সাবেক দাস। যেখানে রয়েছেন নবী পাক (স.)’র চাচাত ভাই জাফার ইবনে আবী তালিব (র.), অভিজাত আনসার কবি হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (র.), প্রসিদ্ধ বীর হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (র.) প্রমুখ। দাসদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উহার তুলনায় আর কি হতে পারে! অথচ তখন দাসদের সহিত পশুর মত আচরণ করা হত।
হযরত আয়েশা (র.) বলেন, নবী পাক (স.) যে বাহিনীতেই হযরত যায়েদ ইবনে হারিছাকে প্রেরণ করতেন উহাতে তাকে সেনাপতি নিযুক্ত করতেন।
হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা (র.) মুতার যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান।
হযরত আনাস বিন মালেক (র.): হযরত আনাস বিন মালেক (র.) ছিলেন হযরত নবী পাক (স.) ঘরের খাদেম। তাঁর আম্মা ছিলেন হযরত উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান (র.)। হযরত আনাস (র.)’র পিতা ইসলাম গ্রহণ না করায় স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেন। উম্মে সুলাইম (র.) ছিলেন একজন আদর্শ মা। তিনি আবু তালহা ইসলাম গ্রহণের শর্ত মেনে নেয়ায় তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। হযরত আনাস (র.) বলেন: নবী পাক (স.) যখন (পবিত্র) মদিনায় আসেন তখন তার বয়স ছিল ১০ বছর। তার মা হযরত উম্মে সুলাইম (র.) হযরত আনাস (র.) কে নিয়ে নবী পাক (স.)’র দরবারে যান এবং বলেন,“হে আল্লাহর রাসূল, আনসারের সব নারী-পুরুষ আপনাকে কোন না কোন হাদিয়া দিয়েছে। আপনাকে দেয়ার মত আমার কিছু নেই। আমার কাছে কেবল আমার সন্তান আছে। আপনি ওকে হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করুন, সে আপনার প্রয়োজনের সময় খেদমত করবে।” (মুসলিম শরীফ-২৪৮০)
হযরত আনাস (র.) কে ১০ বছর মতান্তরে ৮ বছর বয়সে নবী পাক (স.) খেদমতে ওয়াকফ করে দেয়া হল। তিনি একাধারে নবী পাক (স.) এর ১০ বছর খেদমত করেছেন। আর এতে নবী পাক (স.) এর দোয়ায় তার পরবর্তী জীবন সন্তান-সন্ততিতে, সম্পদে ভরপুর হয়ে যায়।
হযরত মারুফ বিন সুআইদ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি আবুযার গিফারী (র.) এবং তাঁর খাদেমকে একই চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি, আমরা তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল: আমি এক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছি আর সে আমার ব্যাপারে নবী পাক (স.) এর নিকট অভিযোগ করল। নবী পাক (স.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তার মাকে গালি দিয়েছ? অতঃপর তিনি বললেন: এরা তোমাদের ভাই বোন, যারা তোমাদের সেবা করছে। তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। অতএব যার ভাই তার অধীনস্থ হয়েছে, তার উচিৎ তার ভাইকে তাই খাওয়ানো যা সে নিজে খায়। তাকে তাই পরিধান করানো যা সে নিজে পরিধান করে। আর তাদেরকে এমন কাজের নির্দেশ দিবে না যা তাদের সাধ্যের বাহিরে। আর যদি কখনও এ ধরনের কাজের নির্দেশ দেয় তাহলে নিজে তাকে সহযোগিতা করবে। (বুখারী) হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (র.) বর্ণিত তিনি বলেন: নবী পাক (স.) তাঁর কোন খাদেমকে তথা কাজের লোক বা তাঁর স্ত্রীকে প্রহার করেন নাই। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের নির্বাচিত স্কুল সমূহের জ্ঞাতার্থে