নিরাপদে সড়কে চলতে চাই

এমিলি মজুমদার | বুধবার , ৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

আমরা সবাই জানি বিপদ বলে কয়ে আসে না। এক মুহূর্তেই একটা সাজানো গোছানো সংসার তছনছ হয়ে যেতে পারে। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই নজরে আসে অনেক দুর্ঘটনার খবর, যার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা সংখ্যায় অন্যতম। কখনও বাসের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষ, কখনও প্রাইভেট কারের সাথে, টেম্পোর সাথে রিঙার, বাস চাপা দিচ্ছে মানুষকে, কখনও বা খাদে পড়ে গেছে গাড়ি, ট্রেইনের সাথে বাস, রিঙা, টেম্পোর ধাক্কা, বাস কিংবা ট্রাকের নীচে মোটর সাইকেল ইত্যাদি ইত্যাদি। দিন দিন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। এর মূল কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমাদের দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা, অদক্ষ/ অশিক্ষিত চালক, ফুটপাত দখল ইত্যাদি। প্রতিদিন খবরের কাগজে, টিভির খবরে সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনে আঁতকে উঠি, স্বজনের কান্নায় আমাদেরও মন ভারি হয়, সময়ে চোখ ভিজে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই তা ভুলে গিয়ে আমাদের নিত্য কাজে লেগে পড়ি! যেন এতে আমাদের কোনো দায় নেই! কিন্তু যে পরিবার তার স্বজন হারায়; অথবা যার স্বজন পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এই দুর্ঘটনার কারণে, যে পরিবার হারিয়েছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে, যে মা হারিয়েছে তার অন্ধের যষ্টি’কে, তারাই কেবল জানে কীভাবে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের জীবন দুর্ঘটনা বেড়ে চললেও তা কমিয়ে আনার জন্য তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নজরে আসছেনা সাধারণ মানুষের। ফুটপাতগুলো এখন পুরোপুরি ব্যবসাকেন্দ্র। প্রশাসন তো আছে কিন্তু নেই শুধু নজরদারি! নজরদারি আছে তবে তা টু’পাইস ইনকামের জন্য, ফুটপাতকে ব্যবহারযোগ্য করতে নয়। দোকানের প্রায় অর্ধেক জিনিস দোকানের বাইরে রেখে, পুরো ফুটপাত জুড়ে হকার বসিয়ে পথচারীদের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় ফুটপাত পেরিয়ে রাস্তার প্রায় অর্ধেক হকারদের দখলে। এর ফলে পথচারীরা বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে চলাচল করে। সেখানেও বিপত্তি, নির্দিষ্ট পার্কিংয়ের জায়গা না হলেও অনেক জায়গার রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে রিঙা, ট্যাঙি, বাস, পার্ক করে রাখা হয়, মাঝে মাঝে মনে হয় ঠিক যেন কাঁকড়ার ঝাক! সব ক্ষেত্রে ট্রফিক পুলিশেরা মৌনতা অবলম্বন করে, অথবা কালো চশমায় সব তাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়! ট্রাফিক পুলিশের কড়া নজরদারি আর ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকলে চিত্র বদলে যেত বলে আমাদের বিশ্বাস। চোখের সামনে কালো ধোঁয়ায় রাস্তা অন্ধকার করে গাড়ি চলে যায়, অথচ রাস্তার মোড়ে মোড়ে যে আইনের লোকগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, তারা দেখেও কিছু দেখেন না। যেখানে সেখানে লোকাল পরিবহনগুলো লোক ওঠানামা করাচ্ছে, সামনে কালো চশমা চোখে এটে আামাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা! কিছু গাড়ির ঝন্‌ ঝন্‌ আওয়াজ শুনলে মনে হয় এক্ষুনি ভেঙে পড়বে।
ড্রাইভারের কথায় যদি আসি, গ্রাম থেকে রোজগারের আশায় শহরে এসে মহিলাগুলো বেশীরভাগ হয় গার্মেন্টসে যোগ দেয় নতুবা বাড়ির কাজে লেগে পড়ে। পুরুষেরা খুব সহজে একটা রিক্সা কিংবা সি এন জি নিয়ে বের হয়ে যায়। এদের কারোরই না থাকে হাতে কলমে কোনো ট্রেনিং, না থাকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা। বাস ট্রাকের হেল্পাররাও ঠিক একইভাবে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে একদিন বসে যায়। বেশীরভাগ দুর্ঘটনার পর চালককে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রয়োজনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলেও, পালানোতে এরা এঙপার্ট! করোনাকালে কাজের অভাবে দর্জি, হোটেল বয়, রাজমিস্ত্রী ইত্যাদি আরো অনেকে কাজের ব্যবস্থা না করতে পেরে ড্রাইভিং শুরু করে। আনাড়ির হাতে গাড়ি দিলে দুর্ঘটনা তো বাড়বেই। রেলের সাথে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণহানির খবর প্রায়ই দেখা যায়, কিন্তু এ ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
মোট সড়ক দুর্ঘটনার একটা বড় অংশ হচ্ছে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা। আর এই মোটরবাইকে যারা প্রাণ হারায় তাদের বেশীরভাগই তরতাজা যুবক। মায়ের বুক খালি করে সন্তান যখন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, অথবা কেউ সন্তান যখন জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকে, ভুক্তভুগী ছাড়া সে যন্ত্রণা কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়।
দীপ, আমার মামাতো বোনের ছেলে। সুঠাম দেহী সুদর্শন ২১ বছর বয়সী শান্ত স্বভাবের এক যুবক। গ্র্যাজুয়েশন করছে ঢাকার এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এক বোন এক ভাই, বোন অত্যন্ত মেধাবী, বুয়েট থেকে বের হয়ে বুয়েটেই শিক্ষকতা করছে, বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে, বর আমেরিকায় পি এইচ ডি করছে। বাবা সবে রিটায়ার করে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরেছে। বদলির চাকরী হওয়াতে ইচ্ছে রিটায়ারমেন্টের পর পুরো সময়টা পরিবারকে দেয়া। মা-বাবা দুজনেই সংসার অন্তপ্রাণ। পরিবারের চারজনের মাঝেই এদের জগৎ, মা-বাবা ছেলেমেয়ের মাঝেই খুঁজে পায় সমস্ত সুখ।
২০১৯ সাল, জুন মাসের ৮ তারিখ, বিকাল সারে চারটার দিকে, আমি অফিসে কাজ করছি। এমন সময় একটা ফোন আসে, আমার মামাতো বোন ছোটটার বর ফোন করেছে ঢাকা থেকে। ফোনের কথাগুলো শুনে আমার হাত-পা কাঁপছিল, বোনের বর জানালো দীপ মোটরসাইকেল এ্যাঙিডেন্ট করেছে কঙবাজার থেকে আসার সময়, ও আর নেই। ওকে চাঁদগা থানায় রাখা হয়েছে। দীপের মা-বাবাকে তখনও খবরটা জানানো হয়নি। আমাকে থানার পুলিশ অফিসারের নাম্বার দেয়া হলো যোগাযোগের জন্য। খবরটা শুনে শরীর অসার হয়ে পড়েছিল, ফোনে আমার হাজবেন্ডকে ডেকে নিয়ে তখনই রওয়ানা হই থানার দিকে। রাস্তায় ২-৩ বার ওসি’র ফোন আসে, ওরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ হস্তান্তর করতে চায়। আমরা যখন থানায় পৌঁছাই তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। থানায় ঢুকতেই হাতের বামে একটা টেম্পো দাঁড়ানো ছিল। আমাদের দুজনকে ওসির কাছে নিয়ে যায় একজন। আমার গা-হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল, কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছিলামনা। ওসির টেবিলের সামনে তিনটা ছেলে আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতেই ওরা যেন বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। এরাই ছিল আমার বোনের ছেলের যাত্রা সঙ্গী। ওরা আমাকে জানালো আরেক বন্ধু চিটাগাং মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত, সে দীপের পেছনে বসা ছিল। ওসি আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দীপের ডেডবডি দেখাতে। গেইটের পাশে যে টেম্পোটা দেখেছিলাম সেটাতেই রাখা হয়েছে দীপকে। এগিয়ে যেতেই আমার নজরে আসে অর্ধেক বের হওয়া সাদা ব্যাগ, দীপ লম্বা হওয়াতে পায়ের দিকটা টেম্পো থেকে বের হয়ে ছিল। আমি আর সহ্য করে সামনে যেতে পারিনি। মায়ের অতি যত্নে লালিত দীপ এভাবে পড়ে আছে একা একটা ব্যাগের ভেতর, সত্যিই ঈশ্বর এ দৃশ্য কোনো শত্রুকেও যেন না দেখায়! পাশেই রাখা হয়েছে দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া দীপের অত্যন্ত সখের মোটর বাইকটা। মা কিনে দিতে রাজী হচ্ছিল না বলে, মায়ের ওপর রাগ করে দুদিন খায়নি কিছুই। আজ সেই বাইক তার জীবন কেড়ে নিল! বাইক শুধু দীপকেই কেড়ে নেয়নি, দীপের মা-বাবা বেঁচে তো আছে, তবে জীবন্মৃত। প্রতিক্ষণ দীপের স্মৃতি তাদের কাঁদায়। বুকে জ্বলছে দীপের চিতা। মা-বাবা যতদিন বাঁচবে, এ আগুন নিভবে না-
শখে, প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে দিন দিন মোটরবাইকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সব ধরনের যানবাহন বাড়লেও সে অনুযায়ী রাস্তার ব্যবস্থা হয়নি এখনো। এমনি ভাবে প্রতিদিন খালি হচ্ছে কত মায়ের বুক, কত স্ত্রী হচ্ছে স্বামীহারা, কত সন্তান হচ্ছে মা’হারা, কত পরিবার উপার্জনক্ষম সদস্য হারিয়ে পথে বসেছ, একজনের পঙ্গুত্বের কারণে পুরো পরিবারটাই মানসিক/আর্থিক উভয়দিকে পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে মানবতর জীবন কাটাতে হচ্ছে হাজারও পরিবারকে।
অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি চালকদের বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে মূল্যবান প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে, তা কোনো ভাবেই মেনে নায়া যায় না। কতগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় দুর্ঘটনা বেশী হয়, কিন্তু সেখানে দুর্ঘটনা রোধ করতে তেমন কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। দুর্ঘটনার পর কতৃপক্ষ একটু নড়েচড়ে বসে, নিউজ হয়, কিছু আর্থিক সাহায্যের হয়তো ব্যবস্থা করা হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু রাত পোহালেই আবার সব ভুলে আমরা সবাই আ্যালজাইমার পেশেন্ট!
একটা গল্পে পড়েছিলাম এক নাপিত মানুষের ফোঁড়া কাটতো। গ্রামবাসী ফোঁড়া হলে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নাপিতের কাছে যেতো। ডাক্তারেরা দেখলো মহাবিপদ! এভাবে ফোঁড়া কাটলে যে কোনো সময় রোগীর প্রাণ বিপন্ন হতে পারে। তখন সব ডাক্তাররা ধরে বেঁধে সেই নাপিতকে কিছু বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করে (কী কেটে গেলে কি হতে পারে ইত্যাদি)। নাপিত বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার পর সে আর ফোঁড়া কাটতে পারছিল না আগের মত। আগে তো বিপদ না জেনেই ঘচাঘচ্‌ চাকু চালিয়ে দিত নির্দ্বিধায় কারণ সে জানতই না, ছুড়ি একটু এদিক ওদিক চলে গেলে কী হতে পারে! ঠিক সেভাবে আমাদের ড্রাইভারদের শিক্ষিত করে রাস্তায় ছাড়তে হবে, তারা যেন প্রাণের মূল্য বোঝে। নির্বিচারে আাশপাশের যানবাহন ও পথচারীর ওপর তাদের গাড়ি না চড়িয়ে দিতে পারে।
দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, দুর্ঘটনা যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল কারণ বের করতে হবে, ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি প্রয়োগ করতে হবে এবং দ্রুত অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করতে পারলেই দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যাবে। সড়কে যেন আর কোনো মূল্যবান প্রাণ না ঝরে যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযেনো মনে রাখি- ‘সাহিত্য চর্চা : প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে’
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে