দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৩ মার্চ, ২০২২ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

হুয়াংফু নদীর পাড় ধরে হাঁটাহাটি করছিলাম আমরা। মিষ্টি এক আবহ চারদিকে। হাঁটাহাঁটির জন্য মোহনীয় পরিবেশ। সিচুয়ান ফুডে জমকালো আয়োজনে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়েছে আমাদের। এখন নদী পাড়ের মিহি হাওয়া আমাদের গা-গতরে আদুরে পরশ বুলাচ্ছিল। আহ, কী শান্তি! কী যে মুগ্ধতা! বেজায় খাওয়া দাওয়ার পর শরীর একটু আয়েশ খুঁজছিল। ইচ্ছে করছিল কোথাও হেলান দিতে কিংবা বিছানায় গা লাগাতে। যেখানেই হোক না কেন গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিতে পারলে দারুণ হতো! কিন্তু মনের স্ববিরোধীতায় চোখ বন্ধ হচ্ছিল না। এমন অপরূপ রূপের মাঝে চোখ বন্ধ করা সত্যিই কঠিন! আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে, মুগ্ধতার পাশাপাশি আমার মনের ভিতরে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এই অস্থিরতা না থাকার, এই অস্থিরতা কষ্টের, অতৃপ্তির।
বেশ লম্বা পার্ক। নদী পাড়ের পার্ক এমন লম্বাই হয়। পার্কের ভিতরে গড়ে চমৎকার ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটছিলাম আমরা। সবুজে সবুজে একাকার হয়ে উঠা দারুণ এক প্রকৃতি। কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে হুয়াংফু, শান্ত স্নিগ্ধ একটি নদী। স্বচ্ছ জল নদীতে, স্রোত আছে কিনা কে জানে! ছোট্ট এই নদীটিকে পুঁজি করে কী অবলীলায় না গড়ে তোলা হয়েছে সাংহাইর মতো জগতবিখ্যাত শহর, বন্দর। একটি নদী কী করে একটি জনপদ তৈরি করে তা সাংহাই না দেখলে কল্পনা করাও কঠিন। আবার একটি নদীকে পুঁজি করে কত সহজে যে একটি জনপদের জীবনমান পাল্টে দেয়া যায়, অর্থনীতি বদলে ফেলা যায় তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই হুয়াংফু, এই সাংহাই। সাংহাইর মতো অতুলনীয় একটি শহরের জয়যাত্রার বহু কিছুই এই হুয়াংফুর উপরই নির্ভর করে রয়েছে।
যাক, নদীকাহিনী লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। নদী নিয়ে গবেষণার মতো জ্ঞান কিংবা বিদ্যা-বুদ্ধিও আমার নেই। অতি সাধারণ মানের একজন ট্যুরিস্ট হিসেবে খোলা চোখে যা দেখছিলাম তারই গল্প শুনাতে এই লেখা। আমাদের এত কিছু থাকার পরও তাদের মতো কিছু না থাকার কষ্ট শেয়ার করার জন্যই এই লেখা। হুয়াংফুর মতো নদী আমাদের রয়েছে, কিন্তু সাংহাইর মতো শহর আমাদের নেই। হুয়াংফুর মতো নদী আমাদের থাকলেও নদীকে কাজে লাগানোর নিয়মকানুন পুরোটা আমাদের জানা নেই। তাই অনেককিছু থেকেও আমাদের যেন কিছু নেই। পার্ক থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম আমরা। শহরে ঘুরবো, শহর দেখবো। সাংহাই শহরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি এবং ল্যান্ডমার্ক টাইপের স্থাপনাগুলো দেখানোর জন্য ফজলে করিম ভাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ড্রাইভারকে ফোন করা হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের গাড়ি এসে থামলো সামনে। আমরা দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লাম।
চীনের সাংহাই শহরের রাস্তা। বিশাল, চওড়া। ফ্লাইওভারেরও যেন অভাব নেই। যেখানে সেখানে ফ্লাইওভার, ওভারপাস। হাজার হাজার গাড়ি, অগুনতি মানুষ। কিলবিল করছে সাংহাই শহর। রাস্তার দুইপাশে ভবন, সুউচ্চ সব ভবন। ভবনগুলোর কোন কোনটিতে মানুষের বসতি, কোনটি অফিস। কোনটি রেস্টুরেন্ট কিংবা আবাসিক হোটেল। কতগুলো চেইন হোটেল যে দেখলাম! এক সাংহাই শহরে ক’হাজার ফাইভ স্টার হোটেল রয়েছে তার যেন কোন ইয়ত্তা নেই। দুনিয়া থেকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা গণচীনের অন্যতম প্রধান এই শহরটিতে আন্তর্জাতিক চেইন শপের ছড়াছড়ি!
আমাদের গাড়ি ছুটছিল। শহরের রাজপথ ধরে ছুটছি আমরা।
১৩০ তলা উচ্চতার সাংহাই টাওয়ারসহ বড় বড় সব ভবন দেখছিলাম আমরা। কোন কোন ভবনের শীর্ষ দেখতে গিয়ে ঘাঁড় নব্বই ডিগ্রি বাঁকা করতে হচ্ছিল। ভবন দেখতে এত কষ্ট!! কোন ভবনের পাশ দিয়ে গেলাম, কোন ভবনের নিচ দিয়ে। কোথাও ফ্লাইওভারে, কোথাও বা ওভারপাসে। কোথাও এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে, কোথাও বা ব্যস্ত সড়কে। দারুণ সময় কাটছিল আমাদের। গল্পে গল্পে সময় কাটাচ্ছিলাম আমরা। মাইক্রোবাসটি দারুণ, রাস্তাও চমৎকার। কোথাও কোন খানাখন্দ নেই, নেই ভাঙ্গাচোরা। কী মসৃণ সড়ক, কালো পিচঢালা। প্রায় তিন কোটি মানুষের শহর। কিন্তু কোথাও তেমন যানজট চোখে পড়লো না। চোখে পড়লো না কোন ট্রাফিক পুলিশও। অটো ট্রাফিক সিস্টেম, অটো সিগন্যাল। হাজার হাজার গাড়ি রাস্তায়, কিন্তু কোথাও যেন কোন বিশৃংখলা নেই। চীনের মানুষও যে ইউরোপ আমেরিকার মতো সড়কের আইন মানে তা আমার জানা ছিল না।
লায়ন ফজলে করিম দলপতি হলেও গাড়ির অতি আরামের ফ্রন্ট সিটে বসানো হয়েছে আমাকে। অবশ্য এটা বিশেষ কোন খাতির করে নয়, মোটা শরীরের মানুষটিকে ফ্রন্ট সিটে না দিলে তাদেরই বিপদ। তাই ফ্রন্ট সিটে আমাকে ‘সাইজ’ করে নিজেরা পেছনের সিটগুলোতে আরাম করে বসেছে। অবশ্য গাড়িটিতে আমাদের সবার আয়েশ করে বসার পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
আগেই বলেছি যে সাংহাই শহর আমাদের চট্টগ্রামের মতো নয়। এরূপ কয়েকশ’ চট্টগ্রাম অনায়াসে ঢুকে যাবে সাংহাইর পেটে। তাই সাংহাই শহর মন ভরে দেখতে কয়েকদিন সময় দরকার। আমাদের হাতে অত সময় নেই। তাই বিশেষ দর্শনীয় জিনিসগুলো দেখেই মন ভরাতে হবে। নদী, নদীর পাড়ের পার্ক, নদীর বুকের জাহাজ, বন্দর কিংবা সুউচ্চ কয়েকটি ভবন দেখার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ আমাদের সাংহাই সফর। অবশ্য একাধিক ভিউ পয়েন্ট থেকে সাংহাই দেখার সুযোগ নিয়েছি আমরা। এতে কম সময়ে অনেক বেশি দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। বিশেষ করে লায়ন ফজলে করিমের সাংহাই সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা এবং চীনা গাইড আমাদেরকে কম সময়ে বেশি আনন্দে মাতার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। আকাশে আলো আঁধারীর চমৎকার এক দৃশ্যপট চিত্রায়িত হচ্ছে। মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে হুয়াংফু নদীর উপর দিয়ে, ভবনের গা ঘেঁষে ছুটছে মেঘের কাফেলা। কোন কোন ভবনের চূড়া ঢুকে যাচ্ছে মেঘের ভিতরে, হারিয়ে যাচ্ছে। মেঘ ছুয়ে থাকা এক একটি ভবন ভরে যাচ্ছে আলোয় আলোয়। অপরূপ এক শোভা চারদিকে। আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতে শুরু করেছে সাংহাই। এত আলো! এক একটি ভবনের দেয়াল জুড়ে চলছে আলোর ঝলকানি। ভবনের পুরো দেয়াল যেন হয়ে উঠেছে সিনেমার পর্দা। বড় বড় বিজ্ঞাপন চিত্র প্রদর্শীত হচ্ছে ভবনের দেয়ালে। আলোয় আলোয় চিত্র, আলোয় আলোয় কথামালা। টিভির মতো, সিনেমার মতো ছবি প্রদর্শীত হচ্ছিল ভবনগুলোর দেয়ালে দেয়ালে। পাশাপাশি কয়েকটি ভবনের দেয়াল নিয়ে একটি দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। যেন আসমান জমিন জুড়ে একটি মাত্র টিভির পর্দা, পুরো দুনিয়া যেন এক আস্ত রঙ্গশালা। কত রঙের আলো যে খেলছে সড়কে, ভবনে, দেয়ালে, আকাশে!!
ফেরার জন্য তাড়া দিলেন আমাদের গাইড। লায়ন ফজলে করিম ভাইও তাগাদা দিলেন। বললেন, হোটেলে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যাবে, পরে খাবার পাবেন না। এখানে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ডিনার শুরু হয়। রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ডিনার শেষ করেন চীনারা। আমাদেরকেও আর্লি ডিনারের জন্য তৈরি হতে হবে। রাত বেশি হয়ে গেলে স্যান্ডউইশ খেয়ে কাটাতে হবে রাত। অবশ্য রুমে ফ্রি কফি এবং মিনিবারে বিস্কিট চিফস থাকবে।
আমাদের হোটেল সাংহাই শহর থেকে বেশ দূরে। সাংহাই এবং জেঝিয়াং প্রদেশের মাঝামাঝি জিয়াঝিং সিটির একটি পাঁচতারকা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের। সাংহাই থেকে একশ’ দশ কিলোমিটার দূরে আমাদের হোটেল। পৌঁছাতে ঘন্টা দুয়েক সময় লেগে যাবে বলে জানালেন আমাদের গাইড। তিনি গুগল ম্যাপে রাস্তার অবস্থা জেনে নিয়ে বললেন, সন্ধ্যায় ঘরমুখো মানুষের চাপ আছে। তাই রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। সময় বেশি লাগবে।
সাংহাই-জেঝিয়াং মহাসড়ক ধরে ছুটছে আমাদের বাহন। বিশাল রাস্তা। কত লেনের তা ঠাহর করতে পারছিলাম না। কোথাও চার লেন, কোথাও ছয় লেন আবার কোথাও মনে হচ্ছে আট লেন। হাজার হাজার গাড়ি রাস্তা জুড়ে। প্রচুর পণ্যবাহী গাড়ি। সাংহাই বন্দর থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে শিল্পসমৃদ্ধ জেঝিয়াং এর দিকে ছুটছে কাভার্ড ভ্যান, কন্টেনার মুভার, ট্রাক। যাত্রীবাহী বাস তেমন একটি চোখে না পড়লেও হাজার হাজার প্রাইভেট গাড়ি দাবড়াচ্ছে বিশাল চওড়া ব্যস্ত মহাসড়ক। আমাদের মহাসড়কের চামড়া যখন তখন চলে গেলেও চীনের এই সড়কটি একেবারে মসৃণ, নখের পিঠের মতো। একটিও খানাখন্দ না থাকা রাস্তাটি যেন পরম মমতায় পার করছে এক একটি পণ্যবাহী গাড়ি, যানবাহন। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের চেতনার স্বরূপ সন্ধান
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ