প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৩ মার্চ, ২০২২ at ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে
চট্টগ্রাম পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প কয়েক যুগ যাবৎ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। উক্ত বিষয়ে হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ ২০১৩ সাল থেকে বারে বারে আবেদন নিবেদনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পকে ইসলামী কমপ্লেক্স হিসেবে সাজাতে নির্দেশনা দান করেন। চট্টগ্রাম পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প পুনঃরায় চালুকরণ এবং হজ্ব ক্যাম্পের ভবনসমূহ সংস্কার, একটি আধুনিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা প্রদান করেন। এতে বর্ণিত অবস্থায় চট্টগ্রাম বিভাগের হজ্বযাত্রীদের জন্য চট্টগ্রামের পাহাড়তলীস্থ হাজী ক্যাম্প পুনরায় চালুকরণ এবং হজ্ব ক্যাম্পের ব্যবহার যোগ্য ভবন সমূহ সংস্কার ও একটি আধুনিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রধান। ঢাকাস্থ হজ্ব অফিস চিঠি প্রাপ্ত হয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে যান।
ঢাকাস্থ হজ্ব অফিস প্রধান স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর, সেগুনবাগিচা, ঢাকাকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চিঠি ইস্যু করেন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উক্ত নির্দেশনার বাস্তবরূপ জনগণের দৃশ্যমান হচ্ছে না। হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে একটি সম্পুর্ণ সেবামূলক সংগঠন। এ সংগঠন কোন কাফেলা এজেন্সী নয় এবং এর কোন বাণিজ্য কার্যক্রম নেই। মহান আল্লাহ পাকের দাওয়াতী মেহমান হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে কাজ করাই এ পরিষদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে। পরিষদের সদস্যরা নিজেদের অর্থ ও শ্রম দিয়ে হজ্বযাত্রীদের কল্যাণে কাজ করেন।
এমনিতে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষের হজ্বের সাথে আলাদা সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে হজ্ব বিষয়ে নানা অবদানে চট্টগ্রাম যে এগিয়ে তা হয়ত হাজার বছর পার হয়ে যাবে। চট্টগ্রামের দুই দানবীর হাজী চাঁন্দ মিয়া সওদাগর ও মুহাম্মদ ইসলাম খান পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পবিত্র মক্কার দুইটি বেদখল হয়ে গেলেও পবিত্র মদিনার মুসাফির খানা দুইটি আজও হজ্বযাত্রীগণের সেবায় রয়েছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, জনপ্রতিনিধি যে যেভাবে পারে ধর্মীয় কর্মকান্ডের পাশাপাশি হজ্বযাত্রীর কল্যাণে অবদান রাখতে সচেষ্ট থাকে।
ব্রিটিশ আমলে শুধুমাত্র মুুম্বাই হয়ে সাগরপথে হজ্বে যেতে হত। চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধি আমিরুলহজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর বারে বারে প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার রাজি হয় কলকাতা বন্দর দিয়ে হজ্বযাত্রী যেতে। এতে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আবদুল বারী চৌধুরী তার শিপিং লাইন থেকে “ইংলিশতান” জাহাজ প্রদান করে কলকাতা বন্দর দিয়ে হজ্বযাত্রী যেতে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার পরের বছর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ককে সামনে রেখে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে।
৯.৩৫ একর বিশাল এরিয়া নিয়ে হাজী ক্যাম্পে ১ তলা বিশিষ্ট প্রকান্ড মসজিদ, দ্বিতল বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন এবং হজ্বযাত্রীগণ সাময়িক অবস্থান করতে ৭টি দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয় সে সময়।
রমজান ঈদের পর পর দুই ট্রিপে ২টি জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি জেদ্দা যেত। প্রতি জাহাজে প্রায় ১৩ শ’ হজ্বযাত্রী বহন করত। চট্টগ্রাম-করাচি নিয়মিত যাত্রীবাহী জাহাজ সামস ৭ শত জন করে হজ্বযাত্রী নিয়ে করাচি বন্দরে পৌঁছে দিত। তথা হতে পশ্চিম পাকিস্তানীসহ ৪ হাজার হজ্বযাত্রী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ ‘সফিনায়ে হুজ্জাজ’ করাচি থেকে জেদ্দা যেত।
পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা যাওয়া জাহাজ দুটি হল ‘সফিনায়ে আরব’ ও ‘সফিনায়ে আরাফাত’। ভাড়া ছিল ডেক শ্রেণীতে ১৯১৯ টাকা। তৎমধ্যে সৌদি আরবে থাকা-খাওয়া ১ হাজার টাকা, জাহাজ ভাড়া ও আনুসঙ্গিক খরচ ৯১৯ টাকা। ২য় শ্রেণী সর্বমোট খরচ ৪ হাজার টাকা প্রায়। ১ম শ্রেণীতে সর্বমোট খরচ ৭ হাজার টাকা প্রায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ১৯১৯ টাকা দিয়ে ডেক শ্রেণীতে হজ্বের আবেদন করেছিলাম, কিন্তু লটারীতে নাম উঠে নাই। পরবর্তীতে ১৯৭৪, ১৯৭৫ সালে লটারীতে আমার নাম না উঠায় ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে হজ্ব করার সুযোগ হয়।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে ভারতীয় বিশাল আকারের মুহাম্মদী জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা হজ্বযাত্রী পরিবহন করে, জাহাজটি ছিল অত্যধিক পুরানো।
১৯৭৩-৭৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছর হজ্ব কার্যক্রম এ পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প থেকে পরিচালিত হত। কিন্তু লটারীর মাধ্যমে নির্ধারণ হওয়া মাত্র ৩ হাজার জন হাজী বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা থেকে জেদ্দা যাওয়া-আসা করত। সে লক্ষ্যে ঢাকায় সরকারী নির্মাণাধীন ভবনকে সাজিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হত।
১৯৭৭ সাল থেকে প্রায় ৫/৬ বছর চট্টগ্রাম থেকে হিযবুল বাহার পরবর্তী নাম শহীদ সালাহ উদ্দিন প্রায় ১৮ শত জন হজ্বযাত্রী জেদ্দা যাওয়া-আসা করছিল। তখন আবারও পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প উৎসব মুখর হয়ে উঠে। অতঃপর ১৯৮০ দশকে হজ্বের দাপ্তরিক কার্যক্রম ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় প্রতিষ্ঠাতা লাভ করে আশকোনা হাজী ক্যাম্প।
সেই ১৯৮০ দশক থেকে প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছরের অধিক সময় পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প থেকে ১ একর জমি নিয়ে পাশাপাশি ৫/৬ তলা বিশিষ্ট ২ টি ভবন নির্মাণ করে। একটি ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমী, আরেকটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়।
দ্বিতল বিশিষ্ট হজ্বযাত্রী অবস্থানের ৭টি দালান থেকে ২টি দালান কোন মতে মেরামত করে একটি জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, আরেকটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকী ৫টি দালান ও ১ টি প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতল দালান সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। একতলা বিশিষ্ট প্রকান্ড জামে মসজিদ স্থানীয়রা ইমাম, মুয়াজ্জিন নিয়োগ দিয়ে পরিচালনা করছে।
ব্রিটিশ ভারতের হজ্বের প্রধান দপ্তর মুম্বাই। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর বর্তমান বিশাল ভারতের রাজধানী শত শত বছরের দিল্লি আজও স্বাধীন ভারতের রাজধানী রয়ে গেছে। কিন্তু ভারতের হজ্ব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে মুম্বাই থেকে। ভারতে প্রদেশ কেন্দ্রীক হজ্ব অফিস রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের হজ্বযাত্রীরা কলকাতা হজ্ব অফিসে বসে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে। কলকাতা বিমান বন্দর দিয়ে হজ্বে যাওয়া আসা করে থাকে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে ৭টি প্রদেশের হজ্বের সদর দপ্তর গুহাঠি। এ গুহাঠিতে হজ্বের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। গুহাঠি বিমান বন্দর দিয়ে হজ্বে যাওয়া আসা করে। শুধু তাই নয়, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই, আহমদাবাদ, ত্রিবন্দরাম, লক্ষ্মৌ, ভূপাল ইত্যাদি বড় বড় শহরগুলোর বিমান বন্দর হয়ে ঐ প্রদেশের হজ্বযাত্রীরা সৌদি আরবে যাওয়া-আসা করে।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ হলেও করাচি, লাহোর, কুয়েটা, পেশোয়ার ইত্যাদি বড় বড় শহরগুলোতে হজ্বের কার্যক্রম এবং ঐ শহরের বিমান বন্দর দিয়ে হজ্বে যাতায়াত করে থাকে।
আমাদের দেশের পরিধি ছোট হলেও জনসংখ্যা অত্যধিক। হজ্বযাত্রীর কোটা ১ লাখ ২৭ হাজার। তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা থাকে ২৫% বা ততোধিক। চট্টগ্রাম বিভাগের রয়েছে শতের অধিক এজেন্সী। এজেন্সীগুলোর আওতায় রয়েছে শত শত হজ্ব কাফেলা। সবাইকে হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করতে ঢাকায় যাওয়া-আসা করতে হয়। হজ্বের সময় আসলে হজ্বযাত্রী, এজেন্সী, কাফেলার টেনশন বেড়ে যায় চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা/পবিত্র মদিনা ফ্লাইট পাওয়া যাবে কিনা এ নিয়ে। না হয় ঢাকায় গিয়ে ফ্লাইট ধরতে হবে। আমাদের দেশে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রীক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা যাচ্ছে না। যেমনটা হজ্বের ক্ষেত্রেও।
হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ ২০১৩ সাল থেকে বারে বারে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ্ব অফিস হিসেবে কার্যক্রম চালু করতে। সে লক্ষে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক জন কর্মকর্তা, কর্মচারী চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে বদলি করে দিলে অনায়াসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ্ব অফিস চালু করা যাবে। হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদন নিবেদন সাথে সাথে লালদিঘী ময়দান ও প্রেস ক্লাবে শান্তিপূর্ণ মানব বন্ধন এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে একাধিক বার স্মারকলিপি প্রদান করে। এতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে নির্দেশনা দেওয়ার পর আজও পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পের উন্নয়ন কার্যক্রম দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
গত ২ বছর করোনা মহামারীর কারণে হজ্বযাত্রী যেতে পারেননি। চলতি বছর থেকে হজ্বযাত্রী যাওয়ার সম্ভাবনা। এতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ্বের কার্যক্রম যাতে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পে করা হয় সে লক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নির্মিত ২টি দালানের একটি থেকে ২/১ কয়েকটি ফ্লোর নিয়ে নিলেই অনায়াসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ্ব অফিস চালু করা যাবে।
চট্টগ্রামে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। চট্টগ্রামবাসী হজ্বের ইতিহাসে অবদান নিয়ে গর্ব করতে পারে। আজ সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রীক মানসিকতায় চট্টগ্রামকে চরম অবহেলা করা হচ্ছে। যা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অতএব অবিলম্বে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পকে বিভাগীয় হজ্ব অফিস হিসেবে চালু করা হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০১৬ সালের নির্দেশনা মতে বহুবিধ ধর্মীয় কার্যক্রমে নির্মাণ কাজ শুরু করা হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসিদ্দিকুর রহমান বাহাদুর