থামছে না আমদানির স্ক্র্যাপ লুট

চালক-চোরাইচক্র যোগসাজশে গায়েব হয়ে যাচ্ছে কোটি টাকার পণ্য।। বন্দর থেকে সীতাকুণ্ডের ৩০টি স্পটে ঘটছে বেশিরভাগ ঘটনা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে ইস্পাত শিল্প। ইস্পাতের কাঁচামালের পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আর কাঁচামাল হিসেবে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ বন্দর থেকে খালাস করে কারখানায় নেওয়ার পথে লুট ও চুরির ঘটনা ঘটছে অহরহ। স্ক্র্যাপ লুটে বাধা দিতে গিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে সিটি গেট এলাকায় খুন হয় এক পাহারাদারও। এ ঘটনায় নগরীর আকবর শাহ, হালিশহর, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং এবং সীতাকুণ্ড থানায় অর্ধ-ডজনের মত মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় ৩০ জনের অধিক গ্রেপ্তারের পরও থেমে নেই আমদানির কোটি কোটি টাকার এসব স্ক্র্যাপ লুট। অভিযোগ রয়েছে, পথিমধ্যে স্ক্র্যাপ চুরি ও লুটের ঘটনায় বেশিরভাগে চালকের যোগসাজশ রয়েছে। আবার লুট কিংবা চুরির ঘটনার পর সমঝোতা করার জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধেও।
জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ইস্পাত শিল্পের বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। গত ১০ বছরে ইস্পাতের চাহিদা বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। বরাবরের মতোই ইস্পাত শিল্পের নেতৃত্ব চট্টগ্রামের হাতেই। ইস্পাতের বৃহৎ কারখানাগুলোর বেশিরভাগও চট্টগ্রামে। তম্মধ্যে নগরীর নাছিরাবাদ, জেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া সীতাকুণ্ড, শীতলপুর, কুমিরা, জোরারগঞ্জ এলাকায় রয়েছে বিএসআরএম, কেএসআরএম, একেএস, জিপিএইচ, এসএআরএম, আরএসআরএমসহ বড় বড় ইস্পাত শিল্পের কারখানা। দেশের মোট ইস্পাত উৎপাদনের ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে। বর্তমানে বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন স্ক্র্যাপ আমদানি হয়ে থাকে।
সূত্রে জানা গেছে, বন্দর থেকে নাছিরাবাদ ও সীতাকুণ্ড-মীরসরাইস্থ ইস্পাত কারখানাগুলোতে যেতে নগরীর সদরঘাট, মাঝিরঘাট স্কেলের প্রবেশ মুখ, বিশ্বরোডের মোড়, ধনিয়ালা পাড়া বায়তুশ শরফ মাদ্রাসার সামনে, দেওয়ান হাট ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে (তায়েফ হোটেলের সামনে), ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মোড়, নয়াবাজার হাক্কানী পেট্রল পাম্প, সল্টগোলা ক্রসিং, টোল রোডের টোলপ্লাজা সংলগ্ন চোচালা ব্রিজ, চিটাগাং ফিলিং স্টেশনের পর, জেলেপাড়া তেলের দোকান, শুকতারা পয়েন্ট, বাংলাবাজার বেড়ি বাঁধ, ডিএবি গ্যারেজের সামনে, চৌধুরী ঘাটা, কুমিরা রয়েল গেইট, এমএমটি গ্যারেজ, বারবকুণ্ড আনোয়ারা জুটি মিল, সুলতানা মঞ্জিল, সীতাকুণ্ড শেখ পাড়া, বড় দারোগা হাট স্কেল ও মীরসরাই ফিলিং স্টেশনসহ প্রায় ৩০টির মতো স্পটে লরি আটকিয়ে স্ক্র্যাপ লুট চলে। বিভিন্ন সময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ ব্যবস্থা নিলেও এসব লুট থামছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষতিগ্রস্ত এক কারখানার ঊর্ধ্বতন নির্বাহী বলেন, বন্দর থেকে সীতাকুণ্ড কারখানায় স্ক্র্যাপ নেওয়ার সময় রাত, ভোর কিংবা দিন দুপুরে গাড়ি আটকিয়ে স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে চালকের যোগসাজশে স্ক্র্যাপ চুরি। চোরাই চক্রের সাথে জড়িত চালক বন্দর টোল রোডের একটি স্থানে গাড়ি থামিয়ে দেয়। অন্য আরেক চালক এসে লরিকে পাশের গোডাউনে নিয়ে সিল ভেঙে স্ক্র্যাপ নামিয়ে নেয়। এরপর আরেকটি একই ধরনের নকল সিল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর গাড়ির চালক কারখানায় মালামাল আনলোড করে দেয়। চলতি মাসে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
এ ধরনের এক মামলার বাদী ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী মো. জুয়েল দৈনিক আজাদীকে বলেন, টোল রোডের জালিয়া পাড়া, বাইপাস হয়ে বিশ্বরোডের ফৌজদারহাট, বানু বাজার, ভাটিয়ারী, কদম রসুল, মাদামবিবির হাট, শীতলপুর, বার আউলিয়াসহ সীতাকুণ্ড এলাকার প্রত্যেকটি স্পটে ট্রাক থামিয়ে স্ক্র্যাপ লুট করা হয়। অনেক ঘটনায় ট্রাকের চালকরা জড়িত থাকে। মোট চোরাইয়ের ৯০ শতাংশ লুট হয় ফৌজহারহাট থেকে বার আউলিয়া পর্যন্ত এলাকার স্পটগুলোতে। তিনি বলেন, আমরা কেরিং কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করি। এখানে অনেক চালক চোর চক্রের সাথে মিলে পথে স্ক্র্যাপ বিক্রি করে দেয়। এ ধরনের ঘটনায় চালক ও স্ক্র্যাপ ক্রেতাদের ধরে থানায় নিয়ে গেলে পুলিশ সমঝোতার জন্য বাধ্য করে। কয়েকদিন আগে ফৌজদারহাট ফাঁড়ির তিনজন চালক ও কয়েকজন চোরাই স্ক্র্যাপ ক্রেতাকে নিয়ে গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পুলিশ উল্টো আমাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
বিএসআরএমের ম্যানেজার (লজিস্টিক) জাহেদুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্দর থেকে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ কারখানায় নেওয়ার পথে বেশ কয়েকটি স্পটে চুরির ঘটনা ঘটছে। তবে গাড়িতে আমাদের এস্কট থাকে। তাছাড়া খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের নিজস্ব সিকিউরিটির লোকজন স্পটে যাওয়াতে আমাদের গাড়িগুলোতে চুরি কিছুটা কম হয়। কয়েকটি ঘটনায় চুরি যাওয়া স্ক্র্যাপও উদ্ধার হয়েছে। তারপরেও চুরি থামছে না। যানজটে পড়লে চুরি বেশি হয়। বন্দর থেকে প্রত্যেকটি লট খালাসের পর হিসেব করলে চুরির কারণে প্রতি জাহাজে ৩শ থেকে ৫শ টন কম পাওয়া যায়।
জানা যায়, বন্দর থেকে বোঝাই স্ক্র্যাপ বোঝাই ট্রাক সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এলাকার কারখানায় যাওয়ার পথে গত ৬ সেপ্টেম্বর সিটি গেট এলাকায় গাড়িতে থাকা এস্কটকে (পাহারাদার) শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে ট্রাক লুট করে সংঘবদ্ধ চক্র। ওইদিন দিবাগত রাত ৩টার দিকে আবুল খায়ের স্টিল মিলের কারখানায় স্ক্র্যাপবাহী ডাম্পার ট্রাকে আবুল হাসেম নিরব (১৯) নামে নিহত এস্কটের লাশ পাওয়া যায়। পরের দিন নগরীর আকবর শাহ থানায় মামলা হলে পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে। উদ্ধার হয় লুট হওয়া লোহাও।
আবুল খায়ের স্টিলের সিনিয়র ম্যানেজার (এইচআর) ইমরুল কাদের ভূঁইয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, জাহাজ থেকে ফ্যাক্টরিতে নেয়ার পথে টনে টনে স্ক্র্যাপ চুরি হয়। জ্যামে ট্রাক দাঁড়ালে টোকাই প্রকৃতির চোরাই চক্রের সদস্যরা গাড়িতে উঠে মালামাল নামিয়ে ফেলে। পথিমধ্যে এসব স্ক্র্যাপ কেনার বড় সিন্ডিকেটও রয়েছে। তাছাড়া পথিমধ্যে ট্রাক থামিয়েও স্ক্র্যাট লুট করা হয়। কিছুদিন আগে আমাদের একজন ঠিকাদারের শ্রমিককেও হত্যা করে স্ক্র্যাপ লুটের ঘটনা ঘটেছে।
সীতাকুণ্ড মডেল থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেকক্ষেত্রে ট্রাক চালকের যোগসাজশে স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় গত সপ্তাহে আমরা একটি মামলাও নিয়েছি। জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চোরাইকৃত মালামালও উদ্ধার হয়েছে। জড়িতদের আটক করে ফাঁড়ি পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরেও সমঝোতায় বাধ্য করার অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি।
আকবর শাহ থানার ওসি মোহাম্মদ জহির হোসেন বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে একজন পাহারাদারকে হত্যা করে স্ক্র্যাপ লুটের মামলায় আমরা ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তদ্মধ্যে ৩ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
সিএমপির উপ-কমিশনার (পশ্চিম) মো. আবদুল ওয়ারীশ বলেন, বন্দর থেকে ইস্পাত কারখানাগুলোতে আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ নেওয়ার পথে লুট ও চুরির ঘটনায় গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি অক্টোবর পর্যন্ত চার থানায় ৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্ক্র্যাপ চুরি কিংবা লুটের ঘটনায় আরো যারা জড়িত তাদেরও গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালিশহর-পতেঙ্গা ইলেকট্রনিক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সভা
পরবর্তী নিবন্ধদলের কঠিন সময়ে যারা থাকেন তারা মূল্যায়িত হবেন