কবিতায় যেমন ধরা দেয় জীবনের বেদনা, প্রেম, আত্মিক মেলবন্ধন তেমনি আর্থসামাজিক কিংবা কবির অন্তর্নিহিত দার্শনিক চেতনাও কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। এ ধরনের মিশ্র চেতনায় ঋদ্ধ ছিলেন কবি ত্রিদিব দস্তিদার। মাত্র ৫৩ বছরের ঝোড়ো জীবনের অধিকারী এই কবি কবিতাকে এমনভাবে ধারণ করেছেন, যেখানে বর্ণিল পঙক্তিমালার অনবদ্যতায় কবিতাগুলো প্রকাশিত।
আমরা যারা কবিতার পাঠক, ত্রিদিব দস্তিদারের মতো কবিকে পাঠ করা সঙ্গত কারণেই দরকার কারণ প্রেম, বিরহ, বাস্তবতা এবং মাটি মানুষের বক্তব্য তাঁর কবিতায় প্রতিভাত।
ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতায় প্রবেশের আগে তাঁকে কিছুটা হলেও জানা দরকার। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। পিতামাতার তিন ভাই বোনের মধ্যে একমাত্র ভাই ত্রিদিব স্বভাববৈরাগী , উদাসীন ও বোহেমিয়ান স্বভাবের ছিলেন । শৈশবে মাতৃহীন কবি প্রতিপালিত হন মামাবাড়িতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেন।
১৯৭৬ সালে আত্মীয় স্বজনের সাথে বন্ধন ছিন্ন করে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি উদাসীন কবির ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক আন্দোলন’ পত্রিকায় প্রথম কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম অবশ্য জানা যায়নি। এ–সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৩২ বছর তিনি লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কবি প্রথম জীবনে ভালোবেসেছিলেন পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত মেরী এন রদ্রিগসকে ।
কারো মতে তিনি তাকে বিয়েও করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেরী কানাডা (মতান্তরে জার্মানি) চলে যান । ক্রমে তাঁদের সম্পর্কে ছেদ ঘটে। এরপর আমৃত্যু কবি সংসারহীন জীবন যাপন করেন ।
কবি ত্রিদিব দস্তিদার এমনই একজন কবি যিনি সমস্ত ভালোবাসাকে জীবন্ত এক দুঃসাহসী পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের কবিতা ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’র মতো এমন উচ্চারণ আর কারো কন্ঠেই কি এমন শোভা পায় ? কিন্তু কবি একদিকে যেমন নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত, এমন কি চরম দেউলিয়া কিংবা ফতুর হয়েও ভালোবাসার পায়ে তিনি মুখ ঘষে যাবেন, তেমনি অপর পক্ষকেও তিনি ফতুর না করে যাবেন না :
‘আমি তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে
ফতুর করে দেবো
তোমার ভালোবাসা একসময় ফুরিয়ে যাবে
আমার ভালোবাসার আজন্ম উত্তাপে
বাষ্পায়িত হবে তোমার ভালোবাসা।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত কবিতা ‘বিজয় হারিয়ে গেছে’ । কবি বিজয়কে দেখেছেন তাঁর বন্ধু হিসেবে , দেখেছেন যুদ্ধে বিজয়ের অংশ হিসেবে :
‘বিজয় , বিপ্লব আর আমি
স্কুল জীবনে একই বেঞ্চিতে বসতাম
তখন চলেছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
……………
আমি এখন বিজয়কে খুঁজছি
মন্যুমেন্টের নিচে বিজয়কে আর দেখছিনা
মন্যুমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে তার ইট–সুরকির গর্ব নিয়ে।’
কোন একসময় বিজয় হারিয়ে গেছে, যাকে তিনি খুঁজেছেন একান্ত আপন সঙ্গী হিসেবে। বিজয়কে তিনি খুঁজে নিয়েছেন , তিনি আশঙ্কা করেছেন বিপ্লবকে নিয়ে বিজয় হয়তোবা আবার সংগ্রামে নেমে গেছে। তাইতো কবি বিজয়কে এখনো খুঁজছেন ।
‘মানুষের গল্প অনেক হলো
এবার পিঁপড়ের গল্প শুরু হয়েছে পৃথিবীতে
…………
একদিন মধ্যদুপুরে একটি পিঁপড়ে
মানুষের ফাঁক বেয়ে
উঠে এলো ২৪ তলার এক মসৃণ স্বপ্ন বাড়ির ছাদে
…………
এবার পিঁপড়ে তেনজিং স্বীয় মানচিত্র খুলে
দাঁড়ালেন বিজয় ভঙ্গিতে
অবলোকন করলেন মানুষের পৃথিবী ’
এই ‘পিঁপড়ের গল্প’ কবিতার দর্শন হলো রূপান্তরের। এই রূপান্তরের মাধ্যমে পিঁপড়ের অবয়বে পৃথিবী ও মানুষকে দেখার চেষ্টা । এ–ধরণের দেখা অনেকটাই ফ্রানতস কাফকা অনুসৃত ‘মেটামরফোসিস’ এর বিষয়গত চেতনা থেকেই উদ্ভূত বলা যেতে পারে , যা আধুনিক মননসম্পন্ন কবি ত্রিদিব দস্তিদার তাঁর কাব্যভাষায় রূপান্তর করেন ।
কবি তাঁর নিজস্ব বন্ধুর প্রকৃতি বিশ্লেষণে এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যেখানে তিনি নিজেকে ভাবেন একজন বন্ধুহীন কবি হিসেবে । ‘কবির বন্ধু থাকে না ‘ কবিতাটি তাঁর কবি জীবনের প্রকৃত বন্ধুহীন জীবনের কোন বৈষয়িক প্রত্যাশার প্রতিফলন বলেই উল্লেখ করেছেন :
কবি হাঁটেন একা মানুষের ভীড়ে
যদিও কবি ও মানুষ সমাজতান্ত্রিক জীব
তবু কবি সমাজ ও তন্ত্রের চোখে একা, পাগল পরাণ
……………
পাঠকের অনিমেষ যাত্রার পদরেখা
কবিকে তুলে নিতে হয় বুকে
এরাই বন্ধুবর কবির প্রকৃত নিষ্ঠার যাপন।
প্রকৃত অর্থেই তিনি একাকীত্ব বোধ করেন না , তিনি মনে করেন তাঁর প্রকৃত বন্ধু পাঠক এবং এই পাঠকের কাছেই তাঁর প্রত্যাশা, তিনি কোন কবি বন্ধুর সঙ্গ প্রত্যাশা করেন না ।
‘যুদ্ধক্ষেত্রে একটি কবিতা ‘এতে কবিতাকে কবি দেখেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে একজন যোদ্ধা হিসেবে। ‘দেহ থেকে বেয়নেটের ফালিগুলো যেন/ তরমুজ ঋতুর একান্ত আহ্বান / হাত থেকে রাইফেলের উদাত্ত গর্জন / আর বিজয়ী পতাকার কাঁপন / রক্তাক্ত দেহে কবিতাটি তখনও বলে চলেছে … জয়বাংলা, জয়বাংলা …। ’ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কবি কবিতাকে রক্তাক্ত হয়ে বলতে দেখেছেন ’জয়বাংলা’, সে কবিতাই আবার শত্রুদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রে। এখানে কবিতা নিয়ে কবির বোধ প্রকাশিত হয়েছে, যে ছিল রণাঙ্গনের এক যোদ্ধা। ।
‘গৃহপালিত পদ্যেরা’ গ্রন্থের কবিতা ব্ল্যাকবোর্ড। আমাদের ইতিহাস, বীরগাথা, ঐতিহ্য আমাদেরই সম্পদ। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে চায়। কবি আমাদের বাংলা বর্ণকে তুলনা করেছেন শিশুর সাথে। কেউ একজন মুছে দিয়ে যায় আমাদের ইতিহাস, কিন্তু বর্ণ শিশুরা অসহায় হয়ে বসে থাকে আগ্রহ নিয়ে :
কে যেন অদৃশ্য ডাস্টার হাতে
আমাদের সব বীরগাঁথা মুছে দিয়ে যায়?
আগামীর শিশুরা শুধু বসে থাকে
চিবুকে দু’হাত রেখে
চোখের সামনে নিয়ে এক বিবর্ণ ব্ল্যাকবোর্ড।
‘ভালোবাসার শাদা ছড়ি’ কাব্যগ্রন্থটির একটি কবিতা:
এ সমাজ কবিকে রাখবে কোথায়?
পরিত্যক্ত ট্রেনের বগিতে, সোহরাওয়ারদির উন্মুক্ত উদ্যানে
সংসদ ভবনের সিঁড়িতে না ভাসমান লঞ্চের কেবিনে
নিরর্থক সাড়ে তিনহাত জমির বরাদ্দ কে দেবে তাকে
ঠিকানার নিশ্চিত ভালোবাসা?
শেষ গন্তব্যে থাকে শুধু আনজুমান ই মফিদুল ইসলাম।
কবির নিজস্ব বোহেমিয়ান জীবনের আত্মকথন এটি, কবিতায় তাঁর গন্তব্যের ভাবনা ফুটে উঠেছে। কবিতা ছাড়া তাঁর আর সঙ্গী কে? তাঁর প্রথম গন্তব্য যেমন কবিতা, শেষ গন্তব্যও তেমনি কবিতা।
কোনো এক দুঃসময়ে স্বদেশকে নিয়ে কবি ভেবেছেন, যখন তিনি দেখেছেন পঁচাত্তরের হত্যাকান্ড , ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রনায়কদের আস্ফালন কিংবা অন্যায়ে ভেসে যাওয়া সময়ে মানুষের হাহাকার। এসব কিছুই যেন কবির কাছে নিরর্থক সময়ের প্রতিচ্ছবি, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে হতাশায় নিমজ্জনের ছবি।
বাংলাদেশ, তুমি অভিশপ্ত কিনা জানিনা
তবু মনে হয় তুমি আজ অভিশপ্ত
তোমাকে বারবার দিচ্ছে শুধু রক্তের তৃষ্ণা
অভিশপ্ত কাঙালের মতো তুমি শুধু
দেখে যাচ্ছো তাদের আচরণ
কবি ত্রিদিব দস্তিদার ছিলেন চিরকবি। কবিতায় যেমন তাঁর অনুরাগ, তেমনি তিনি ছিলেন সংসারবিবাগী, অজাতশত্রু । এই কবির কাব্যপ্রেম ছিলো অবারিত , নিখুঁত। তাঁর আত্মসমর্পণ শুধু কবিতায়, কবিতাগুলো বিষয়গত চেতনা, প্রেম এবং দ্রোহের সংমিশ্রনে উদ্ভাসিত। কবিতায় দর্শনের অস্তিত্বের কথা বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন । তিনি সঞ্জীবিত হয়েছেন ভালোবাসায় , উচ্চকিত হয়েছেন দেশপ্রেমে।
সত্তর দশক থেকেই কবি নিয়মিত লিখেছেন । কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো গ্রন্থিত হয়েছে অনেক পরে, নব্বই দশকে , ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে ‘গৃহপালিত পদ্যেরা’ , ‘অঙ্গে আমার বহু বর্ণের দাগ’, ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেবো’, ‘ভালোবাসার শাদা ঘুড়ি’ , ‘পোড়াবো তাজমহল।’
কয়েকটি শব্দের প্রতি কিংবা একক চিত্র রচনার প্রতি ত্রিদিব দস্তিদারের বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে যাকে তাঁর অভ্যেস না বলে মমতা দেখানোর প্রশ্রয় বলে বর্ণনা করা যায়। এ– বিষয়গুলোর ভেতর দিয়েও তাঁর নান্দনিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায় ।
যেমন , ‘গৃহপালিত’, ‘পিঁপড়ে’ ,’ কীটপতঙ্গ ‘, ‘মধ্যবিত্ত’, ‘পোস্টমর্টেম’ , ‘প্রেম’, ‘প্রেমিক’ ইত্যাদি। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য তিনি এসেছিলেন পৃথিবীতে। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর তিনি প্রস্থান করেন। কিন্তু যে কবিতামালা তিনি রচনা করে গেছেন আধুনিক কবিতায় তা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে নিঃসন্দেহে। উত্তর প্রজন্মের অনেক পাঠকই তাঁর কবিতার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাননি। তাই তাঁর রচনাবলী প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় ।