তার বুকের প্রদীপ জ্বলুক আমাদের সকল শিশুর অন্তরে

ববি বড়ুয়া | বুধবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। আমরা তিন ভাইবোনের পর আরোও একজন নতুন সদস্য যোগ হবে পরিবারে। এই সংবাদে যেন আমাদের আনন্দের সীমা থাকলো না। দিন ঘনিয়ে আসে নতুন সদস্যটি পৃথিবীতে আসার। সৃষ্টিকর্তার কাছে রাতদিন প্রার্থনা ছিল আমাদের যেন একটি ভাই আসে এবং একই সাথে আমাদের পিতার মতো সমাজ ও দেশ আলো করতে পারা মেধাসম্পন্ন গুণী মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর শেষে চট্টগ্রামের সে সময়ের নামী হাসপাতাল হলি ক্রিসেন্টে আমাদের মাকে ভর্তি করানো হয়। আমরা ঘরেই ছিলাম। অবশেষে সুসংবাদ আসলো আমাদের একটি ফুটফুটে ভাই এসেছে। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। আর বড় বোন হিসেবে প্রথম আমার কোলেই চাই তাকে। কী আনন্দের বন্যা বয়ে গেছিল সেদিন আমাদের মনে, আমাদের পরিবারে। একজন নতুন সদস্য মানেই যেন একটি প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাময় আলোর বার্তা।
অনেক বছর পর হঠাৎ সেই দিনগুলোর কথা ভীষণভাবে মনকে আলোড়িত করছে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিকাতর লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে উল্লেখিত তাঁর স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৬৪ রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজো ফুফুমার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগেওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজো ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণপর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালো চুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।” লেখাটা পড়ে বারবার মনে আসছিল পৃথিবীর সব বোনেদের ছোট ভাই বোনদের প্রতি ভালোবাসার রঙ বোধকরি একই হয়। অনুভূতির রঙের ছোঁয়া অভিন্ন।
চার সন্তানের পর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম গ্রহণ করলে পিতা তাঁর প্রিয় লেখক খ্যাতিমান দার্শনিক ও নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে পরিবারের নতুন সদস্যের নামরাখেন ‘রাসেল’। একটি সন্তান পৃথিবীতে আসা মানেই পিতা-মাতা, ভাই বোনের হাজারো স্বপ্ন, জল্পনা কল্পনার আকাশে আবিরমাখা বাস্তবতা। আর পরিবারে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য মানেই বাড়তি ভালোবাসার আধার।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা রাসেল মাত্র দেড় বছর বয়স থেকেই তার পিতাকে কাছে পেয়েছে কারাগারে রসিকের ওপারে। যেসময়টা একটি শিশুর পিতার বুকের গন্ধ নাকে নিয়ে ঘুমানোর কথা ছিল, নানা আবদার আর বায়নার ঝড় তোলার কথা ছিল তাকে বুঝে নিতে হয়েছিল কারাগারই তার পিতার ঘর। পিতার গায়ের গন্ধ দূর থেকেই নিতে হয়, পিতা কোনো বায়না করার মানুষ নয়। বরং দূরের আকাশের তারার মতো দূর থেকে দেখার মানুষ। কিন্তু তাতেও কি তার পিতৃহীন অতৃপ্ত শিশুমন ক্ষান্তি পেলো? মাত্র সাত বছর বয়সে ১৯৭১ সালে তাকেও পরিবারের সাথে একটি ঘরে বন্দী জীবন বরণ করে নিতে হয়।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রাসেলের ভুবন ছিল তার মাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামালকে ঘিরে। আর পিতাকে কাছে পাওয়ার সৌভাগ্য হতো অনেকটা ঈদের চাঁদটির মতো। সব কিছুর পরেও মন্দের ভালোই কাটছিল শৈশব। মিষ্টি দুরন্তপনা আর গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সবার মন কাড়ছিল। কিন্তু তার জীবনে বেঁচে থাকার সুখটুকুও থাকলো না বেশি দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তে পরিবারের অন্য সকলসদস্যের সাথে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। ধপ করে নিভে গেলো উজ্জ্বল প্রজ্জ্বলিত শিখায় জ্বলে ওঠা কোমল প্রদীপ। সময়ের সাথে একটি সময় হয়তো পিতার সমস্ত গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করে হতে পারতো পিতার মতো কিংবদন্তি নেতা। যার হাতেই হয়তো থাকতো বিশ্ব দরবারে আলোকিত বাংলাদেশের বিজয় মশাল।
আজ সেই ছোট্ট শিশু রাসেল পৃথিবীতে নেই। কিন্তু শিশু রাসেলকে দেখতে পাই দেশের সকল শিশুর পথিকৃৎ হিসেবে। শিশুদের কথার প্রসঙ্গে ‘বিশ্ব শিশু দিবস’এর কথা বলতে হয়। এই দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়ে পালিত হলেও বাংলাদেশেঅক্টোবরের প্রথম সোমবার পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। তবে বাংলাদেশ সরকার একই সঙ্গে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে পালন করে ‘শিশু অধিকারসপ্তাহ’।
গত ২ সেপ্টেম্বর, দৈনিক আজাদী তে প্রকাশিত এই পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক রাশেদ রউফ-এর “শেখ রাসেলের জন্মদিনকে শিশুঅধিকার সপ্তাহ’র সঙ্গে যুক্ত করা হোক” শিরোনামে লেখা পড়েছিলাম। বিষয়টি বেশ সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। আর তাই তাঁর লেখার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরতে চাই। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘শিশু অধিকার সপ্তাহ’র উদ্বোধন নির্দিষ্ট তারিখে হয় না। সরকারের সুবিধা মতো সময়ে সেটার আয়োজন হয়ে থাকে। যেমন ২০২১ সালে ‘শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন হয়েছে ৪ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত; ২০২০ সালে শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্বোধন হয় ৫ অক্টোবর; ২০১৯ সালে উদ্বোধন হয় ৯ অক্টোবর; ২০১৭ সালে শিশু অধিকার সপ্তাহ শুরু হয় ১১ অক্টোবর। এখানে উল্লেখ করতে পারি, সকল শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রত্যয়ে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাজানো হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপনের কর্মসূচি।
আমরা অবশ্যই অবগত আছি যে, আমাদের শিশুদের ভালোবাসার প্রতীক শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর। তাই এইদিনটাকে রেখে শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা গেলে সামগ্রিকভাবে এই সপ্তাহ পালনের সার্থকতা আসবে বলে আমরা মনে করি। একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে।
বেঁচে থাকার অধিকারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। শেখ রাসেলকে হত্যা করে তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করেছে ঘাতকরা। এজন্য আমাদের সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চাই, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে রেখে শিশুঅধিকার সপ্তাহ পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হোক। ১২ অক্টোবর শিশু অধিকার সপ্তাহ উদ্বোধন হলে ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনটা শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হবে নিঃসন্দেহে। এ লক্ষ্যে গত ৩০ আগস্ট আমি বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির পক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিবের কাছে তাঁর মন্ত্রণালয়ে লিখিত আকারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেছি। মাননীয় সচিব সেটাকে ‘উত্তম প্রস্তাবনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং সে-বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।’’
শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশের একজন শিশুসাহিত্যিক সাংবাদিক রাশেদ রউফ-এর এমন যৌক্তিক ও সময়োচিত দাবি নিঃসন্দেহে প্রশংসার বলতে হয়। কারণ বিশ্ব শিশু দিবস, শিশু অধিকার দিবস ও শিশুদের পথিকৃৎ শেখ রাসেলের জন্মবার্ষিকী একত্রিত করে সমগ্র দেশে নানা কর্মসূচিতে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সপ্তাহ জুড়ে পালন করা হলে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শিশুর মনো বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে বলে মনে করছি। একই সাথে সকল শিশুর মনোদেশে শিশু রাসেলের নাম অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। আর দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে উপরে উল্লেখিত বিষয়টিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সরকার মহলে আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
সবশেষে বলতে চাই, যে শিশুটি পৃথিবীর রঙে পরিপূর্ণ রঙিন হওয়ার আগেই আঁধারে মিলালো, তার বুকের প্রদীপ জ্বলুক আমাদের সকল শিশুর অন্তরে। বেঁচে থাকুক আমাদের রাসেল আমাদের ভালোবাসায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, চট্টগগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দর্শনই শেখ হাসিনার দর্শন
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে