তনয়ারা যেভাবে সংসারী হয়ে ওঠে

মিতা দাশ | শনিবার , ২০ মে, ২০২৩ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

বিয়ের জন্য কত পরিকল্পনা করে, নানা কষ্ট করে মা সব গোছাচ্ছিল, তনয়া এসে বেঁকে বসলো এই গয়না তনয়ার পছন্দ নয়। সেদিন বাবা না থাকা সত্ত্বেও তনয়ার মা তনয়ার জন্য আবার তনয়ার পছন্দ মতো গয়না কিনে দিয়েছিলো মায়ের নিজের গয়না বিক্রি করে।

শ্বশুর বাড়ি যেদিন চলে আসছিলো সেদিন তনয়ার হঠাৎ মনে হলো বুকটা একদম খালি হয়ে গেছে বুকের ভেতর যেন কিছুই নাই আর। এমন কান্না পেয়েছিলো সে অনেকক্ষণ কেঁদেছে। মাকে তো সে আসার সময় ছাড়তেই পারছিলো না। মা মেয়ের এমন কান্না কিভাবে এলো কিসের জন্য তা আজ বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে।

মায়ের সাথে ঘুমানো, তনয়া বাইরে গেলে তার পছন্দমতো রান্না করে রাখা, মাছের বড় টুকরোটা ভাই পিন্টুকে না দিয়ে তনয়াকে দেয়া, তনয়ার যা যা পরতে ভালো লাগে সব কিছু পরতে দেয়া। কোনদিন কোন কাজের জন্য না ডেকে শুধু পড়তে ও গান করতে বলা। কম্পিউটার শেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আরো কত মজার দিন ও স্মৃতি সব যেন এক নিমিষে ফেলে এসে এক লাফে সংসারে ঢুকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী হয়ে যাওয়া।

বিয়ের একমাসের মাথায় খুব রাগারাগি করে শাশুড়িস্বামীর সাথে ঝগড়া করে এক কাপড়ে চলে গিয়েছিল তনয়া বাপের বাড়ি। তনয়া মাকে বলে দিলো আমি আর শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাব না।

মা সেদিন কিছু বলেনি। চুপ করে ছিলো, যেন কিছুই হয়নি। বললো আচ্ছা থাক কয়েকদিন, মাথা ঠান্ডা কর। তনয়া রেগে বলেছিলো এমন বাজে জামাই এর কাছে আর যাব না, যে কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে।

কিন্তু মা কি করে এত শান্ত ছিলো বুঝতে পারেনি তনয়া। সব কথা শুনছিলো মন দিয়ে, তনয়া যেন ঠিক কাজটি করেছে এমন একটা ভাব করলো মা।

দুইদিন পর যখন তনয়ার স্বামী মিষ্টি, ফল নিয়ে এসে তনয়াকে একটু সরি বললো, কেমন যেন তনয়া গলে গেলো। তার এত রাগ কোথায় যে চলে গেলো খুঁজে পেলো না।

মাকে দেখলো তখনও মেয়ে জামাইকে কত আপ্যায়ন করছে, যেন কিছুই হয়নি।

পরদিন যখন তনয়াকে নিয়ে যেতে চাইলো ওর স্বামী তনয়া তখন স্বামীর কথায় রাজি। লজ্জায় মাকে বলতে পারছিলো না। একেবারে যাবে না বলা মেয়ে এখন স্বামীর সাথে যেতে রাজি কি করে যে মাকে বলবে!

তনয়ার মা তখনও কাজটা সহজ করে দিয়ে বললো, আমার মেয়েটা বড় আদরের ওকে দেখে রেখো। মেয়েরা ঘরের লক্ষী, ওদের গায়ে হাত তুলতে নেই। তনয়াকে বিদায় বেলা বলেছিলো, সবসময় রেগে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নেই। অনেক সময় কাউকে পরাজিত করতে হলে ঘরে থেকে বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে জয়ী করার ফন্দি আঁটতে হয়।

তনয়া তখন ততটা না বুঝলেও আজ ঠিক সব বুঝতে পারে। সেই থেকে তনয়া অনেক বার ঝগড়া করলেও, মার খেলেও বাড়ি ছেড়ে বের হয়নি। মায়ের কথামতো বুদ্ধি দিয়ে সামলে নিচ্ছে। এখন তনয়া দুই ছেলে মেয়ের মা।

ছেলে মেয়ে ছোট থাকার সময় একরকম, বড় হতে হতে অন্যরকম হতে থাকে সন্তান ও পরিস্থিতি। মা হওয়ার পর থেকে তনয়া বুঝতে পারে মা এর কত দায়িত্ব, কত কষ্ট ও চিন্তা। ছোট থাকা অবস্থায় বাচ্চাদের জন্য তনয়ার মা প্রায়ই অনেক জিনিসপত্র নিয়ে এসে ওদের জন্য থেকে যেতেন। তনয়া তখনও ছেলে মেয়েদের বড় করার ঝামেলা বুঝতে পারেনি। মা ওদের বড় করে দিয়েছেন বলা যায়। ছেলেমেয়ে দুটোই দাদী বলতে পাগল। তনয়ার মা ও ওদের জন্য কত কি করেছেন বলে শেষ করা যাবে না। এঋণের শোধ হবে না তনয়ার সারাজীবন মাকে সেবা করলেও।

ছেলে এখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, মেয়েটা নাইনে পড়ে, এখন তনয়া বুঝতে পারছে, একজন মাকে কত কষ্ট করে, কত যন্ত্রণা সহ্য করে সংসারে থেকে নিরবে সব কাজ সামলিয়েও শুনতে হয় ‘তুমি কি করেছো?’

তনয়ার স্বামী বরাবরই বেশ উদাসীন। শুধু সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র এনে সংসারের খরচ চালিয়ে উনি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তনয়া ভোরে উঠে ছেলের, মেয়ের আলাদা আলাদা নাস্তা রেডি করা, স্বামীর নাস্তা তৈরি করে দেওয়া, আবার অফিসে দুপুরে খাবার জন্য ভাত তরকারি রান্না করে দেয়া, শ্বশুর আছেন এখনো উনার খাবার ও ঔষধ দেয়া। সবার খাবারের পালা শেষ করতে করতে দেখা গেলো নিজের পেটে আর নাস্তা দেয়ার সময় থাকে না। ঘর গুছানো, মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, ছেলেটাকে সেভেনের পর আর পৌঁছে দিতে হয়নি স্কুলে সে একা যাবে বলে মাকে বারণ করেছে। কিন্তু মেয়ের বেলায় উল্টো হলো মেয়েকে দিয়েও আসতে হয়, নিয়েও আসতে হয়,নইলে রাস্তার যে পরিবেশ তাতে মেয়েকে সুস্থভাবে ঘরে নিয়ে যাওয়াই বেশ কঠিন হয়ে পরবে।

এই বাইরে নিয়ে যাওয়া আসা, সংসারের সবার দায়িত্ব পালন করতে করতে কখনো বিকেল চারটায় গোসল করে বের হওয়ার পর কাপড় মেলে দিতে দিতে বেলকনি দিয়ে রাস্তার লোকজনকে দেখে তনয়া ভাবে মাকে কতবার বকে বলতাম, তুমি ঠিক সময়ে ভাত খাও না কেন? আগে তোমার সব কাজ কেন করতে হবে?

নিজের খাওয়া আগে খেয়ে তারপর সংসারের যা করার করবে, আমি হলে আগে খেয়ে নিতাম। মাগো আজ বুঝতে পারি, তোমার কত কষ্ট হতো!

আজ দেখো তোমার তনয়াও ঠিক সময়ে খেতে পারে না।

চুল থেকে পানি মুছতে মুছতে গামছা দিয়ে চোখের কোণে জমা জলও মুছে নেয় তনয়া।

বন্ধের দিন তনয়া সকলের সব কিছু করে মাথা আচড়ানোর সময়ও পায় না। রাত সাড়ে বারোটায় সব কাজ শেষ করে যখন তনয়া বসলো আয়নার সামনে তখন দেখলো চোখের নিচে চামড়াতে ভাঁজ পড়েছে, মুখে বিভিন্ন ছোট ছোট কালো দাগ, রংটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চুলটা খুলতেই ভেজা চুল বেঁধে রাখার কারণে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। চুল খুলে তনয়া ভাবছে এক সময় এই চুল মা তেল দিয়ে আঁচড়ানোর সময় বলতো মাশাল্লাহ তোর অনেক ঘনকালো চুল।

আজ কমতে কমতে ছোট একটা ক্লিপেও আটকানো যায়।

হঠাৎ কর্কশ একটা কন্ঠ–!

কি ব্যাপার রাত দুপুরে এত সাজগোজের বাহার কেন? বাতি নেভাও কাল অফিস আছে। তাড়াতাড়ি এসো বলে তনয়ার স্বামী পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে।

তনয়ার অবসর কখন? কোনদিন তনয়ার ছুটি?

দুই বছর আগ পর্যন্ত তনয়ার কয়েক মাস পরপর কয়েকদিন ছুটি মিলতো বাপের বাড়িতে গিয়ে মার কাছে থাকলে।

তনয়া বিয়ের পর থেকে যতবার গেছে প্রতিবারই মা তনয়াকে কিছুই করতে দিতো না। এমনকি ভাতটা পর্যন্ত বেড়ে এনে দিতো। গোসলের পর কাপড়ও ধুতে দিতো না।

দুই বছর হলো মা মারা গেছে। ভাইয়ের সংসারে এখন আর যেতে ইচ্ছে করে না। তনয়ার আর ছুটিও মেলে না। তনয়ার মারও কখনো ছুটি ছিলো না। তনয়া বাপের বাড়ি গেলেও যেমন মা কিছু করতে দিতো না, তেমনি তনয়ার বাসায় আসলেও তনয়ার সব কাজ করে দিতো মা। বারণ করলেও শুনতো না।

কি হলো! বাতি নেভাও আর কতক্ষণ?

তনয়ার স্বামীর এমন কথায় তনয়া চিরুনি নিয়ে বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে এলো। তনয়া চিরুনি হাতে বসে ভাবছে মায়েরা জানে মেয়ে হয়ে জন্মানো মানে অনেক সংগ্রাম করতে হবে,অনেক ত্যাগ করতে হবে। তাই বোধহয় তনয়াকে কিছুই করতে দেয়নি কখনো বিয়ের আগে। আর জানতো সংসারের সবাইকে দিয়ে নিজের জন্য থাকে না, বা থাকলেও সময়ের অভাবে খাওয়া হয় না, তাই বিয়ের আগে ভাইকে না দিয়ে বড় মাছের টুকরো, ভালো মাংসের পিস, ঘন দুধ এগুলো মেয়েকে খাওয়াতো। মায়েরা তো জানেই শ্বশুর বাড়িতে সব থাকলেও হয়তো সবাইকে দেয়ার পর ক্ষিদেই মরে যাবে আর খাওয়া হবে না।

তনয়াও তনয়ার মেয়ে মৃন্ময়কে এখন বেশি যত্ন করে।

নিরব চারপাশ, রাস্তায় মাঝে মাঝে একটা দুটো সিএনজি বা মোটর সাইকেল যাচ্ছে। প্রতি বাসায় ছোট লাইটের ক্ষীণ আলো। কেমন যেন অন্ধকারকে ভেদ করে কিছুটা আলোকিত করে তুললো রাতের অন্ধকার ভেদ করে।

আকাশে অনেক তারার মেলা। তনয়া একটা বড় তারার দিকে তাকিয়ে বলছে, মাগো দেখো আমি তোমার মতো একজন ভালো মা হয়েছি।

তোমার মতো সকলের ভালো রাখার জন্য নিজের প্রতি যত্নটাও বাদ দিয়েছি। তোমাকে কত বলতাম তুমি ভেজা চুল কেন বেঁধে রাখো। খুলে রাখবে, আমি আঁচড়িয়ে দেব।

আজ আমার চুলও ভেজা থাকে, সময় হয় না হাত দেয়ার। তবু তুমি কত সুন্দর ছিলে, তোমার মেয়েকে দেখো কেমন ভূত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মা আজ আমি সত্যিই তোমার সকল কষ্ট বুঝতে পারছি। তোমার মতো সত্যিকারের ধৈর্য্যশীলা মা হয়েছি। এখন গরম ডেকচি আমিও খালি হাতে নামাতে পারি, গরম লাগে না হাতে। মনও শক্ত করেছি। মনেও আর কোন ছ্যাকা লাগতে দিই না।

এখন আমি একজন শুধু তোমার আদরের মেয়ে নই এখন মৃন্ময়এর মা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআরব লীগ সম্মেলনে যোগ দিতে সৌদি আরবে সিরিয়ার আসাদ
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ জননী জাহানারা ইমাম