শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২০ মে, ২০২৩ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

৩ মে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মদিন ছিল। আমরা সৌভাগ্যবান জাতি অন্তত একজন জাহানারা ইমাম জন্মেছিলেন এই দেশে। রাজনীতির কথামালায় নেতাদের মুখে একটা কথা আমরা সবসময় শুনতে পাই শোককে শক্তিতে পরিণত করার কথা। সে তো রাজনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্যের কথা! সেখানে অঙ্গীকারের গুরুত্ব খুব বেশী থাকে না। ক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারটাই মুখ্য। জাহানারা ইমাম রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। তিনি রাজনীতি করেননি। তাঁর কোন উচ্চাবিলাস ছিলনা। তিনি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতার জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন বারবার। শোককে শক্তিকে পরিণত করার ব্যাপারটা সত্যিকারের অর্থে আমরা একজন জাহানারা ইমামের কাছেই দেখেছি। বিশ্বের সেরা মহাকাব্য এবং ধ্রুপদী ভান্ডার পূর্ণ হয়ে আছে যুদ্ধ আর বীরত্বগাথায়। কিন্তু এমন দিনলিপি একটাই আছে সেটা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকিতে থেকেও নির্মোহভাবে লেখা জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’। মুক্তিকামী স্বাধীনচেতা বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই নয়মাসের যুদ্ধে কত পরিবার শেষ হয়ে গেছে। কত পরিবার আপনজন হারিয়েছে, কত স্বপ্নের বলি হয়েছে, কত পরিবার তাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিয়েছে, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সম্পদ, কত লক্ষ নারীকে কতটা নির্যাতন সইতে হয়েছে এসবের যথাযথ পরিসংখ্যান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হলেও সেভাবে উঠে আসেনি। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সব মীমাংসীত বিষয় নিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিযয়েছিল যা এখনও শেষ হয়নি এবং এই বিকৃত ইতিহাসের ভেতর দিয়ে কয়েকটি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে। যার ফলাফল আমরা ভোগ করেছি এখনও করছি। অনেকে ভুলতে বসেছিল মুক্তিযুদ্ধ কি এবং কেন। ২১টি বছর কোন সরকারি মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ দূরে থাক, মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের নামটাও উচ্চারিত হতে দেওয়া হয়নি। জাহানারা ইমাম সেই জায়গাটাই বিপ্লব ঘটিয়েছেন বলা যায়।

একাত্তরের দিনগুলি’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রতিদিনকার উত্তেজনাকর ও মর্মস্পর্শী ঘটনার অসামান্য দলিল। তাঁর মেধাবী সন্তান রুমি উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকার নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধের অনিশ্চিত জীবনকেই বেছে নেয়। এবং মায়ের অনুমতিও আদায় করেন। এক কথায় জাহানারা ইমামের পুরো পরিবারই মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের বর্বরতা, দেশীয় রাজাকারদের হীন চক্রান্ত ও দেশের ভয়াবহ সময় ও গেরিলা যুদ্ধের অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা তিনি এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি দেশ ও তাঁর নিজের সন্তানের জন্য সমান্তরাল উৎকন্ঠায় ছিলেন। তাঁর নিজের বাড়িটাকে গড়ে তুলেন গেরিলা বাহিনীর আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে । রান্না করেছেন, খাইয়েছেন কখনো কখনো নিজে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছেও দিয়েছেন নির্দিষ্ট জায়গায়। এই বই ১ মার্চ থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা প্রতিদিনকার চিত্র উঠে এসেছে। এর মধ্যে রুমী, জামী (ছোট ছেলে) তাঁর স্বামী শরীফ ইমাম সাহেবকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে পাকিস্তানীরা। সেপ্টেম্বরের দিকে জামী ও শরীফ ইমামকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছেড়ে দিলেও রুমীর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। ১৪ সেপ্টেম্বরের তাঁর ডায়েরির পাতায় মাতৃহৃদয় এভাবে হাহাকার করে উঠেছে, ‘রুমী নেই? এই নবীন বয়সে থযখন পৃথিবীর রূপরসমধুগন্ধ উপভোগ করার জন্য বিকশিত হচ্ছিল তখনই সে নেই? এই সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ থেকে তার ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ক্লাস করার কথা তার বদলে চার তারিখে কোথায় গেল সে!’ রুমীর মতো অসংখ্য সম্ভবনাময় তরুণ এই দেশটির জন্য এভাবেই আত্মাহুতি দিয়েছে। শরীফ ইমাম সাহেবও পাকিস্তানীদের নির্যাতন ও পুত্র শোকে বিধ্বস্ত হয়ে স্বাধীনতার দুইদিন আগে মারা যান। ১৭ ডিসেম্বর ডায়েরির শেষ পাতা থেকে– ‘বিকেল হতে হতে রায়ের বাজারের বধ্যভূমির খবরও কানে পৌঁছল। বড় অস্থির লাগছে। কি করি? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। রুমি কি বেঁচে আছে? কার কাছে খবর পাব? শরীফ এমন সময় চলে গেল? দুজনে মিলে রুমীর জন্য কষ্ট পাচ্ছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম এখন একাই সব কষ্ট বহন করতে হবে। ফোন ও ইলেকট্রিকের লাইন এখনও ঠিক হয়নি। সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছেনা। এত বেশি রক্তে দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার স্রোতে হাসি ডুবে যাচ্ছে।” শহীদ রুমীর মা সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার মা হয়ে উঠলেন। রুমীর সহযোদ্ধারা তাঁকে মায়ের স্থানে অভিষিক্ত করলো। তাঁর এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৬সালে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলাদের উদ্দেশ্যে বইটি উৎসর্গ করেন তিনি।

এই অনন্যা দেশপ্রেমিক মহীয়সী নারী এখানেই থেমে থাকেননি ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারানো এই জাতিকে নতুনভাবে জাগরিত করেছিলেন। ১৯৯১সালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ঘোষণা করলে দেশে গণবিক্ষোভের সূচনা হয়। এই সময় তিনি উপলব্ধি করলেন যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের একত্রিত করতে না পারলে বিরোধী দুষ্টচক্রকে প্রতিরোধ করা যাবেনা। এসময় তিনি অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি অরাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোক হয়েও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেন। ১৯৯২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হন। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মীবৃৃন্দ, দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ এবং প্রজন্ম ৭১ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনগুলো এগিয়ে আসে তাঁরই নেতৃত্বে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগ চত্বরে জন্ম নেয় তারুণ্যের মহা জাগরণ। এই তরুণদের অধিকাংশের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসের অন্ধকারে বেড়ে উঠেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলন তাদের পথ চেনাতে সাহায্য করেছে। তিনিই ইতিহাসের পথ নির্মাতা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গণসচেতনতা তৈরির জন্য অসুস্থ শরীরে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া অবধি ছুটে গিয়েছেন। হার মানেননি কখনও।

অবশেষে ১৯৯৪ সালে ২৬ জুন আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যান্সারের কাছে হার মানেন। জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর হয়ে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে জাগরিত থাকুক। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতনয়ারা যেভাবে সংসারী হয়ে ওঠে
পরবর্তী নিবন্ধকবিতা, গান-কথায় বোধনের রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন