ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন

গত ১৯ অক্টোবর ২০২১ তারিখে তিস্তা নদীতে পানিপ্রবাহ অত্যধিক গতিতে বাড়তে থাকায় ভারত গজলডোবা ব্যারেজের সবগুলো জলকপাট খুলে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্ট থেকে শুরু করে লালমনিরহাট জেলার চারটি উপজেলা এই বর্ষায় চতুর্থবারের মত প্রবল বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল। অনেকগুলো সড়ক ভেঙে গেছে, ধান-পাট-শাকসব্জির খেত ভেসে গেছে, ঘরবাড়ী পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে, মানুষের জীবন-জীবিকা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের পর প্রতি বছর চার থেকে ছয়বার এভাবে তিস্তার বন্যার কবলে বিধ্বস্ত হওয়াই রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধার তিস্তা-তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের ভবিতব্য হয়ে গিয়েছিল। তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়ার পর তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশ বছরের বেশির ভাগ সময় প্রায় পানিশূন্য থাকছে। আবার ভরা বর্ষায় কয়েকবার গজলডোবা ব্যারেজের গেটগুলো খুলে দেওয়ার সাথে সাথে এই জেলাগুলোর তিস্তা-তীরবর্তী বিভিন্ন অংশ বন্যায় বারবার বিধ্বস্ত হচ্ছে। কারণ, বাঁধ নির্মাণের কারণে তিস্তা নদীর পুরো বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারের তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর পানি বহন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, নদীর যত্রতত্র চর পড়েছে, নদীর প্রশস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আমরা সকলেই জানি যে তিস্তা নদী ঐতিহাসিকভাবেই অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং খামখেয়ালি আচরণের একটি নদী। বলা হতো, এলাকার জনগণের জীবন ও জীবিকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদী। এলাকার জনগণ সেজন্য এই নদীকে ‘পাগলা তিস্তা’ নামেই অভিহিত করে থাকে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের পর সমস্যাগুলো মহাসংকটে পরিণত হয়েছে। উপরন্তু, সিকিম রাজ্যের সীমানায় তিস্তা নদীতে অনেকগুলো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ব্যারেজ নির্মাণের ফলে গজলডোবা পয়েন্টেও পানিপ্রবাহ একেবারেই স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের পানি পাওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে। অথচ, ভরা বর্ষায় গজলডোবা ব্যারেজের উজানে পানির তোড় এত দ্রুত বৃদ্ধি পায় যে প্রতি বছর পাঁচ-ছয়বার ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দিয়ে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে সর্বনাশা বন্যা সৃষ্টি করাও ভারতের আরেকটি নিষ্ঠুর রুটিনে পরিণত হয়েছে ব্যারেজ নির্মাণের পর থেকে। অবশ্য, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ-ব্যাপারে কোন সহমর্মিতা দেখানোর গরজ আমরা কখনোই দেখিনি। দুঃখজনক হলো, একটি আন্তর্জাতিক নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি সম্পূর্ণভাবে আটকে দেওয়া এবং ভরা বর্ষায় কয়েকবার গজলডোবা ব্যারেজের গেটগুলো খুলে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে বন্যায় বারবার বিধ্বস্ত করার কোন নৈতিক দায়ভার ভারত গ্রহণ করার প্রয়োজন বোধ করছে না।
বাংলাদেশ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও এহেন একতরফা বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত একবারও বাংলাদেশের সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং, দীর্ঘ তিন দশকের কূটনৈতিক আলোচনার পথ ধরে যখন ২০১১ সালে দু’দেশ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর অন্যায় আবদারের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং চুক্তি স্বাক্ষর থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। দুটো সার্বভৌম দেশের সম্পর্ক একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিলতার কাছে জিম্মি হতে পারে না। অথচ, এর পর ভারত এই অজুহাতেই এক দশক ধরে এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখেছে। অন্যদিকে এ-সম্পর্কে একটি সুখবর হলো, তিস্তাপাড়ের জনগণের এই মানবেতর দুঃখ-কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশ ‘তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প প্রস্তুত করেছে। কিন্তু, প্রস্তাবিত প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভারতের প্রবল আপত্তির মুখে সেটা অনুমোদনের জন্য একনেকে এখনো উপস্থাপন করা হচ্ছে না! প্রায় আড়াই বছর আগে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চীন সফরের সময় এই প্রকল্প প্রণয়নের জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যাতে ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে একদা বিশ্বে বহুল-পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে চীন যেভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছে ঐ একই কায়দায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য প্রতিবছর সর্বনাশ ডেকে আনা তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনাকেও একটি বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা যায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ চীনা অর্থায়নে প্রায় দু’শ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পর প্রকল্প-প্রস্তাবটি চীনের পক্ষ থেকে বছরখানেক আগেই বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সাথে চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ প্রদানেরও প্রস্তাব দেয়।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে দশ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একইসাথে, রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ-কাম-রোড নির্মাণ করে নদীর দু’তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করে সেচখাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। প্রায় ছয় লক্ষ হেক্টর জমি নাকি এই সেচ ব্যবস্থার আওতায় আসবে। উপরন্তু, নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ন সুবিধাদি গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বর্ণনা জেনে আমার মনে হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সত্যিসত্যিই তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য-পীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনজীবনে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হবে। আমি প্রকল্প-প্রস্তাবের অনুমোদন-প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সেজন্যই অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটির অনুমোদন হয়ে যাবে। কিন্তু খবরাখবর নিয়ে জানা গেল এই প্রকল্পে বাগড়া দিচ্ছে ভারত, যে জন্য গত এক বছরেও প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়নি। ভারত নাকি এই প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে তাদের দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক ঘোষণা করে বাংলাদেশকে প্রকল্প বাতিল করার জন্য সরাসরি চাপ দিয়ে চলেছে। ভারতের দাবি, তাদের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেকের’ এত কাছাকাছি তিস্তা প্রকল্পে কয়েক’শ বা হাজারের বেশি চীনা নাগরিকের অবস্থানকে ভারত মেনে নেবে না। অতএব, বাংলাদেশকে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পকে ভন্ডুল করার জন্য তারা বাংলাদেশের সামনে তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রাখলেও এই ব্যাপারে অর্জন এখনো শূন্য! কিন্তু তিস্তা চুক্তি আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প তো মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি হোক্‌ বা না হোক্‌ তিস্তা প্রকল্প ঐ অঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। চুক্তি হলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ খানিকটা হয়তো বাড়বে, কিন্তু বর্ষায় গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় এতদঞ্চলের জনগণ যে একাধিকবার বন্যায় ডুবছে তার তো কোন সমাধান হবে না! প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় নদীখনন করে নদীর গভীরতা বাড়ানো হলে এবং প্রস্তাবিত জলাধারগুলোর সংরক্ষিত পানি পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলে এই সমস্যার টেকসই সমাধান মিলবে।
আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহলকে প্রশ্ন করতে চাই, ভারতের এহেন ‘দাদাগিরির’ কাছে নতজানু হওয়ার জন্য কি ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? শেখ হাসিনা কি ভয় পাচ্ছেন যে ভারতের এসব অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করলে ভারত তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে? ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার কোন অধিকার ভারতের থাকতে পারে না। ভারতের অন্যায় চাপাচাপি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সীমা-লংঘন, যা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালির জন্য মর্যাদাহানিকর। ভারতের কাছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক কোন দিক্‌ থেকেই বাংলাদেশ নির্ভরশীল নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনভাবেই ভারতের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর খয়রাত-নির্ভর লজ্‌ঝর অবস্থানে নেই। এদেশটি এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দেশের আমদানী বিল রপ্তানী আয়ের চাইতে এখনো বেশি থাকায় যেটুকু বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে তা দ্রুতই কমে যাচ্ছে। ঐ বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর জন্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স যথেষ্ট প্রমাণিত হয়ে চলেছে, যার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এখন কিছুটা কমে ৪৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এমনকি, করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলায়ও বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি সফল হয়েছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানির বার্ষিক প্রবাহ সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলারের মত, অথচ বাংলাদেশ থেকে ভারতে বছরে রপ্তানি হয় মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। উল্টোদিকে, বাংলাদেশে যেসব ভারতীয় অভিবাসী কর্মরত রয়েছে তারা প্রতি বছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স হুন্ডির মত অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতে পাঠাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ, ভারত থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য রেমিট্যান্সই আসে না। এমনকি, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগকেও এখনো উল্লেখযোগ্য বলা যাবে না। তাহলে বারবার ভারত তাদের সংকীর্ণ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য কীভাবে বাংলাদেশের নীতি-প্রণেতাদের হাত মোচড়ানোর ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে? চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত-বিরোধ সত্ত্বেও ভারত চীনের সাথে ২০২০ সালে ৫৭ বিলিয়ন ডলারের মত বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়েছে। অথচ, বাংলাদেশ নিজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীন থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে গেলেই ভারত বারবার নানা অজুহাতে বাগড়া দিয়ে চলেছে। আমাদের জানা আছে যে ভারত বাংলাদেশকে নানা প্রকল্পে যে ঋণ-সহায়তা অফার করেছে সেগুলো এতই কঠিন শর্ত-কন্টকিত যে বাস্তবে বাংলাদেশ ঐ ‘টাইড এইডের’ অতি-ক্ষুদ্রাংশই গ্রহণ করেছে। এগুলোকে আর দশটা ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের’ চাইতে বেশি সুবিধাজনক আখ্যায়িত করার কোন যুক্তি নেই। এসব ঋণের আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ‘কানেকটিভিটি’ বাড়ানো এবং সুগম করা। এখানে কোন দয়া-দাক্ষিণ্যের ছিঁটেফোটাও নেই। মজার ব্যাপার হলো, একসময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধ অভিবাসী কিংবা শরণার্থীর যে বিপুল প্রবাহের অভিযোগ তুলে ভারত শোরগোল বাধিয়ে দিত এখন ঐ শরণার্থী-স্রোতের অস্তিত্ব্ব আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতীয় গরুর ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা যে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে সেটাও এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের বর্ণনা জানাজানি হওয়ার পর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ খুশিতে মাতোয়ারা। প্রকল্পটির আশু বাস্তবায়নের জন্য উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গত এক বছর ধরে বেশ কয়েকটি মানব-বন্ধন ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি, অক্টোবরের শেষদিকে ইন্টারনেটে খবর বেরিয়েছে যে অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতের চাপ উপেক্ষা করে পানি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়কে ‘তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী ভারতীয় সীমান্ত থেকে তিস্তা নদীর ষোল কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত নদীখননের অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করবে বাংলাদেশ সরকার। এই অংশের কাজ এ-বছর শুষ্ক মৌসুমে শুরু করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে প্রকল্প প্রণয়ন করার নির্দেশ জারি হয়েছে বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। ছয়মাসের মধ্যে এই অংশের নদীখনন সম্পন্ন হওয়ার পর বাকি প্রকল্পের কাজ নাকি শুরু করবে চীনের ঠিকাদার এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসমূহ। এই সাহসী সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিস্তা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মত ‘প্রেস্টিজ প্রজেক্ট’ নয়, কিন্তু দুর্দশাপীড়িত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের জীবন ও জীবিকাকে এই প্রকল্প বিপ্লবাত্মক গতিতে বদলে দেবে। তাই আমি মনে করি, পারমাণবিক প্রকল্পের চাইতে অনেক বেশি অগ্রাধিকারের দাবিদার তিস্তা প্রকল্প। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন ষোল কিলোমিটারের খননকাজ বাংলাদেশ গ্রহণ করলে ‘চীনা জুজুর ভয়’ দেখিয়ে নিরাপত্তার অজুহাতে ভারতের আপত্তি জানানোর কোন অবকাশ থাকবে না। অন্যদিকে, ভারতের ‘দাদাগিরি’ উপেক্ষা করে তিস্তা প্রকল্পের বাকি অংশের জন্য চীনের ঋণপ্রস্তাব গ্রহণ আমাদের জন্য অনেক বেশি সম্মানজনক হবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধত্যাগী রাজনৈতিক ও সফল ব্যবসায়ী
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় মেম্বার প্রার্থী ও সমর্থক আহত