টেনেট এবং ক্রিস্টোফার নোলান

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ১৫ মার্চ, ২০২১ at ৯:৩২ পূর্বাহ্ণ

ক্রিস্টোফার নোলান সেই বিরল চলচ্চিত্রকারদের একজন, যিনি তাঁর দর্শকদের প্রতীক্ষায় রাখেন তাঁর পরবর্তী ছবিটির জন্যে। অথচ ব্রিটিশ আমেরিকান এই পরিচালকের ফিল্ম ক্যারিয়ার মাত্র দুই দশকের। ১৯৯৮ সালে ক্রাইম থ্রিলার ‘ফলোয়িং’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে তাঁর ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ারের শুরু। একাধারে তিনি চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, প্রযোজক ও পরিচালক। বিশালাকার প্রযোজনায় সিদ্ধহস্ত এই পরিচালকের ছবিগুলোর বিশালতার মতো দর্শকপ্রিয়তাও বিশ্বব্যাপী। ২০০০ সালে নির্মিত দ্বিতীয় ছবি সাইকোলোজিক্যাল থ্রিলার ‘মেমেনটো’ ক্রিস্টোফারকে বিশ্ব পরিচিত্‌ি এনে দেয়। থ্রিলার ধর্মিতা তার নির্মাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই শৈলীর কারণে তার ছবিগুলো চলচ্চিত্রের বিশালতাকে আশ্রয় করে প্রচুর চরিত্র, বিচিত্র সব লোকেশন, চোখ ধাঁধানো এ্যাকশন, ল্যান্ডস্কেপ, ফটোগ্রাফি, অসাধারণ সংগীত, যথাযথ শিল্পী কলাকুশলী নির্বাচন এবং সর্বোপরি তার কুশলী পরিচালনার গুণে নয়নাভিরাম হয়ে উঠে। নির্মাণে তাঁকে অনেক সময় সহযোগিতা করেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা জোনাথান নোলান, যিনি নিজেও একজন দক্ষ অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক। দুই ভাই মিলে তৈরি করেছেন দ্য প্রেস্টিজ (২০০৬) দ্য ডার্কনাইট (২০০৮) দ্য ডার্কনাইট রাইজেস (২০১২) ইন্টারস্টেলার (২০১৪), ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান (২০১৬)। তবে সবকটি ছবির নির্দেশনায় ছিলেন ক্রিস্টোফার নোলান। চিত্রনাট্য রচনা ও আনুষঙ্গিক বিবিধ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন জোনাথান।
নোলান ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্ম লন্ডনে ১৯৭০ এবং ১৯৭৬ সালে। বলতে গেলে নবীন। লন্ডনে ক্যারিয়ার শুরু হলেও পরে তা বিস্তৃতি পায় হলিউডে। হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ আমেরিকান নির্মাতা। ক্রিস্টোফার ‘ফলোয়িং ও মেমেন্টোর পর উপরোল্লিখিত ছবিগুলো ছাড়া আরো নির্মাণ করেছেন, ইনসোমনিয়া (২০০২), ব্যাটম্যান বিগিনস (২০০৫), ইনসেপশন (২০১০), ডানকার্ক (২০১৭) পরিবেশক হিসেবে পেয়েছেন ওয়ার্নার ব্রাদার্স, প্যারামাউন্ট পিকচার্স, বুয়েনা ভিস্তা পিকচার্সের মতো ডাকসাইটে প্রতিষ্ঠানকে। স্বভাবতই ছবির মেধার পাশাপাশি পেয়েছেন যশ, খ্যাতি ও অর্থ যা তার সাহস ও উদ্যম দুটোই বাড়িয়েছে।
ক্রিস্টোফার নোলানের সর্বশেষ ছবি ২০২০ সালে আগস্টে (টক) ও সেপ্টেম্বরে (টঝঅ) মুক্তিপ্রাপ্ত ‘টেনেট’ যেটি ইতোমধ্যে কোভিডের মধ্যেও প্রদর্শিত হয়ে চলেছে বিশ্বজুড়ে। তবে কোভিডের কারণে আশানুরূপ বাণিজ্যে সক্ষম হয়নি ২০০ মিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ‘টেনেট’। তারপরেও বাণিজ্য করেছে ৩৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ছবির চিত্রায়ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, নরওয়ে, ইতালি,্‌ এস্তোনিয়া ও ডেনমার্কে।
সায়েন্স ফিকশন ‘টেনেট’ এর চিত্রনাট্য রচনায় ক্রিস্টোফার সময় নিয়েছেন পাঁচ বছর। কাজ করেছেন দুই বছর ধরে। এত যত্ন ও পরিশ্রমের ছোঁয়া দেখা যায় ছবির প্রতিটি দৃশ্যে। কম্পিউটার গ্রাফিঙের চৌকষ প্রয়োগের পাশাপাশি কাহিনী ও চিত্রনাট্যের অভিনবত্ব ছবিটিকে অনন্য এক চলচ্চিত্রিক মাত্রা এনে দিয়েছে। আর এর নেপথ্যে কাজ করেছে অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি (হয়তে ভান হয়তেমা) ও দুর্দান্ত সম্পাদনা (জেনিফার লেম)।
আবহ সংগীত যে একটি ছবির মুখ্য একটি চরিত্র হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ ‘টেনেট’ এমন কোনো শট নেই যে শটে লুডভিগ গোরানসনের আবহ সংগীত শোনা যায় না। অথচ এক মুহূর্তের জন্যেও বাহুল্য বোধ হয় না।
সিনেমা যে কি বিশালতা ও বিস্তৃতি নিয়ে উপস্থাপিত হতে পারে, কেবল লার্জার দেন লাইফ নয় আরো বেশি কিছু, সেটা টনেট দেখে বোঝা গেল। স্বভাবতই এই বিশালত্ব উপস্থাপনের জন্য অসীম অর্থ সংস্থানের প্রয়োজন। কিন্তু বিগ বাজেট’ই বড় কথা নয়, আসল কথা হলো মেধা, বুদ্ধি, চিন্তা, সাহস এবং তার প্রয়োগ কৌশল আয়ত্তে থাকা। সিনেমাকে এজন্যেই বলা হয় থাকে ‘ডাইন্যাস্টিক মিডিয়া’। এসবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘টেনেট’ সিনেমাটোগ্রাফি ও এডিটিং এর চমৎকার সমন্বয়ের গুণে রিভার্স ট্রিটমেন্টগুলো এতে অর্থবহ ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে, পুরো ছবিকে করে তুলেছে নিস্ফলক।
‘টেনেট’ নামের একটি গোপন সংস্থার এক নামহীন সদস্য জানতে পারে ভবিষ্যতে এমন একটি বন্দুক ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে, যেটি ব্যাকফায়ারে সক্ষম। আর ভবিষ্যতের পৃথিবী তার অতীতকে শাস্তি দিতে চলেছে তার প্রকৃতি ও পরিবেশের অত্যাচার করার অপরাধে। এই অতীত এই মুহূর্তে আমাদের এই বর্তমান। অর্থাৎ আমাদের ভবিষ্যৎ সময় আমাদের এখনকার স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিশোধ নেবে। টাইম লাইনের ব্যাপার, যার চমৎকৃত চর্চা নোলানের সিনেমার মুখ্য বিষয়। তবে এটা নিছক কল্পবিজ্ঞান হয়েই থাকে না যুক্তিবাদীও হয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের পৃথিবী অবশ্যই বর্তমানের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিশোধ নেবে। এর পাশাপাশি বর্তমানের নষ্ট রাজনীতির নিকৃষ্ট উপাদান আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসার মাফিয়া গিরিও টেনেট ছবির প্রধান একটি উপজীব্য হয়ে এসেছে। প্রেক্ষাপট হিসেবে এসেছে উপমহাদেশের মুম্বাই শহরের আন্ডার ওয়ার্ল্ড। টেনেট ছবির বড় সম্পদ দুর্দান্ত সব অভিনয়। নামহীন সদস্য বা প্রোটাগনিস্টের চরিত্রে জন ডেভিড ওয়াশিংটন তুখোড় অভিনয় করেছেন। তেমনি অনবদ্য অভিনয়ন করেছেন রবার্ট প্যাটিনসন নীল চরিত্রে। এদের সাথে সমানতালে চমৎকার অভিনয় উপহার দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অস্ত্র মাফিয়া ডন প্রিয়ার চরিত্রে ডিম্‌্‌পল কাপাডিয়া। রাশিয়ান প্রতিনায়কের চরিত্রে কেনেথ ব্রানাও অত্যন্ত সাবলীল। তেমনি সাবলীল এলিজাবেথ ডেবেকির অভিনয় ক্যাথরিন বা ক্যাটের চরিত্রে।
এন্ড্রু জ্যাকসন ও স্কট ফিশার কৃত চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ও ভিশুয়াল এফেক্ট বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। এছবি বিশাল পর্দায় দেখা ছাড়া অন্য বিকল্প নেই যেটা সিনেমার বেলায় বড় সত্য।
ছবির শেষ দৃশ্য অসাধারণ এক প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। ক্যাটের শিশু পুত্র মায়ের হাতটা মুঠোয় নিয়ে সামনে এগিয়ে চলে, দর্শকেরাও যেন আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন সুন্দর ও নিরাপদ এক পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। দর্শকদের কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে প্রোটাগনিস্টকে বলা নীলের শেষ কথা, ্তুঔঁংঃ ংধাব ঃযব ড়িৎষফ্থ…….

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় স্মার্ট কার্ড নিতে দীর্ঘ লাইন, ভোগান্তি মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি