টাকা ফেরত পাচ্ছেন ইউএনওর নির্দেশে দণ্ডিত সেই ফরিদ

খাদ্যসহায়তা চেয়ে ৩৩৩ নম্বরে ফোন

আজাদী অনলাইন | রবিবার , ২৩ মে, ২০২১ at ৯:৩৯ অপরাহ্ণ

নারায়ণগঞ্জে খাদ্য সহায়তার জন্য ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে দণ্ডিত ফরিদ আহমেদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) এই আদেশ দেন বলে আজ রবিবার (২৩ মে) জানান জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্।
একই সঙ্গে তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পিন্টু বেপারীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং আগামী বুধবারের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। বিডিনিউজ
কোনো একটি চ্যারিটি ফান্ড থেকে ফরিদ আহমেদকে এই টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
গত বৃহস্পতিবার খাদ্য সহায়তার জাতীয় জরুরি ফোন ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ নাগবাড়ির ফরিদ আহমেদ খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন।
খবর পেয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনও আরিফা জহুরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শোনেন ফরিদের একটি চারতলা বাড়ি আছে এবং তিনি হোসিয়ারি কারখানার মালিক।
তখন তিনি প্রশাসনকে ‘হয়রানির’ অপরাধে ফরিদ আহমেদকে করোনাভাইরাস সঙ্কটে অসহায়দের জন্য ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা দিতে বলেন জরিমানা হিসেবে।
গতকাল শনিবার বিকালে নাগবাড়ি এলাকায় ফরিদ আহমেদের দেওয়া ত্রাণ বিতরণ করেন ইউএনও আরিফা জহুরাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কিন্তু এই ১০০ প্যাকেট খাবার দিতে ফরিদ আহমেদকে মেয়ের গহনা বিক্রি ও ঋণ করে টাকা যোগাড় করতে হয়।
ফরিদ আহমেদ জানান, তিনি এফএম রেডিও শোনেন। সেখানে তিনি শুনতে পান ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে সরকার বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়। এজন্য তিনি ফোন করে খাদ্য সহায়তা চান।
তিনি বলেন, “কিন্তু জানতাম না এটা নিম্ন আয়ের মানুষের। আমিও তো পেটের দায়ে অভাবে পইড়াই ফোন করছি। খাদ্য সহায়তা আমার দরকার ছিল বলেই আমি ফোন করেছি। পরদিন উপজেলা থেকে খাদ্য সহায়তা করা হবে জানানো হয়। তার কিছুক্ষণ পর স্থানীয় কাশিপুর ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন- আপনি এই খাদ্য পাওয়ার উপযুক্ত নন-এই কথা বলে আমাকে নানাভাবে ধমকাতে থাকেন। পরে আমি ভুলও স্বীকার করেছি।”
তিনি আরো বলেন, “তার কিছুক্ষণ পর ইউএনও স্যার আসেন এবং আমাকে ডেকে নিয়ে নানা প্রশ্ন করার পর ১০০ মানুষকে খাদ্য সহায়তা করার জন্য নির্দেশ দেন। ইউএনও স্যার চলে যাওয়ার পার ইউপি সদস্যসহ অনেকে বলেন খাদ্য সহায়তা করা না হলে তিন মাসের সাজা হবে।”
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ফরিদ আহমেদের কারখানা চলে না এবং তিনি এখন ‘আর্থিক সংকটে’ আছেন বলে জানান।
ফরিদ আহমেদ বলেন, “তারা যেভাবে বলছে আমি সেভাবে ১০০ প্যাকেট বানিয়ে দিছি। এগুলো দিতে আমার ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা খরচ হইছে। আমার এই খাদ্য সহায়তা দিতে অনেক কষ্ট হইছে।”
তাদের চারতলা বাড়ি থাকলেও পুরোটার মালিক তিনি একা নন বলে জানান ফরিদ। এই বাড়ি ছয় ভাই ও এক বোনের। তিনি শুধু তিনটি কক্ষের মালিক।
তিনি বলেন, “আমার এখন কারখানা নাই। কারখানা দেওয়ার আগে যে হোসিয়ারিতে দীর্ঘদিন কাটিং মাস্টার ছিলাম এখন সেখানে কাজ করি। শাস্তি থেকে বাঁচতে জুয়োলারি দোকানে স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনের স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদে টাকা এনে খাদ্য সামগ্রী কিনেছি।”
ইউএনও’র কাছে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পর ফরিদ আহমেদের স্ত্রী হিরণ বেগম বলেন, “গত দু’দিন বহু চেষ্টা করছি স্বামীরে জেলের হাত থেকে বাঁচাতে। নিজের স্বর্ণসহ আত্মীয়স্বজনের সোনার গয়না জুয়েলারি দোকানে বন্ধক রাইখা চড়া সুদে ঋণ করছি। মেম্বার আইযুব আলীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ধার নিছি। মোট ৬৫ হাজার টাকার খাদ্য সামগ্রী কিনতে হইছে আমাগো। আমাদের পরিবার নিজেরাই চলতে পারি না। প্রতিবন্ধী ছেলে এক মেয়ে নিয়ে এমনিতেই আমরা সংকটে,”বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
ফরিদ আহমেদের ছোট ভাই সেলিম খানের স্ত্রী বিলকিস বেগম বলেন, “বড় ভাসুর ফরিদ আহমেদের ব্রেন স্ট্রোক করছে দুই বার। এ কারণে ওনি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। তার মানসিক সমস্যাও রয়েছে। গত রাতে তিনি দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আমরা তাকে সারারাত পাহারা দিয়া রাখছি। টাকা-পয়সা জোগাড় করতে সহায়তা করছি।”
বিলকিস বলেন, “আমাগো বাড়ি আছে কিন্তু ঠিক, কিন্তু কাম নাই; আমাগো ঘরে খাওন নাই। সরকারের কাছে খাদ্য চাইয়া উল্টো জরিমানা দিতে হইল। আমাগো উপর জুলুম করল তারা।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউএনও’র নির্দেশের পর টাকা জোগাড় করতে ফরিদ আহমেদের স্ত্রী হিরণ বেগম শহরের কালিরবাজার এলাকায় অসিত স্বর্ণ শিল্পালয়ে মেয়ে মারিয়া আক্তারের এক ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইন বন্ধক রেখে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা সুদে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ করেছেন।
অসিত স্বর্ণ শিল্পালয়ের মালিক পিন্টু লাল বলেন, “এক ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইন বন্ধক রেখে তাদের কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ করেছে রিফাতের মা হিরন বেগম।”
কাশীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আইয়ুব আলী বলেন, “আমি উপজেলা প্রশাসনকে বার বার বলছি ফরিদ আহমেদকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য বিতরণ করার শাস্তি দেওয়া ঠিক হয় নাই। কিন্তু তারা মানে নাই। পরে বাধ্য হয়ে আমি নিজেও তারে ১০ হাজার টাকা দিছি।”
এই বিষয়ে ইউএনও আরিফা জহুরা বলেন, “আমি নিজে ফরিদ আহমেদের বাড়িতে গিয়েছি। তখনও তিনি বলেননি তার সমস্যার কথা। তিনি ফোন করার পর আমরা তার তথ্য যাচাই-বাছাই করেছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী জানতে পারি তিনি চারতলা বাড়ির মালিক ও পোশাক কারখানাও রয়েছে। ওই এলাকার স্থানীয় মেম্বারও তাই জানিয়েছে। তাই তাকে অযথা সরকারি লোকজনকে হয়রানির করার শাস্তি হিসেবে ১০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানাই।”
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে ৩৩৩ জাতীয় হটলাইনে কল দিয়ে খাদ্য সহায়তা চাওয়া ফরিদ আহমেদ চারতলা বাড়ির পুরো মালিক নন। চারতলা বাড়ির মালিক ছয় ভাই ও এক বোন। তিনি বাড়ির মাত্র তিনটি রুমের মালিক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আজ রবিবারের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণে যে টাকা খরচ হয়েছে তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
একই সাথে এই ঘটনা কেন ঘটল, কী কারণে ঘটল তা খুঁজে বের করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দশ দেওয়া হয়েছে।”
ফরিদ আহমেদকে কোন ফান্ড থেকে টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে জেলা প্রশাসক বলেন, “কোনো একটি চ্যারিটি ফান্ড থেকে এই টাকা ফেরত দেওয়া হবে।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩৩ রানে টাইগারদের জয়
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে কর্ণফুলী নদী থেকে অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধার