‘জয় বাংলা’ এখন জাতীয় স্লোগান জাতীয় আবেগের মর্যাদা লাভ

| বুধবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবার এ বিষয়ে আদেশ জারি করে তা জানিয়ে দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে (ভার্চ্যুয়ালি) অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান করার জন্য হাইকোর্টের একটি রায় আছে। মন্ত্রিসভায় এ নিয়ে আলাপ হয়। আলাপের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সার্কুলার দিয়ে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে প্রচার করতে হবে। কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ বলতে হবে, সেটি বলতে গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যেমন সাংবিধানিক পদাধিকারী ব্যক্তি, রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুষ্ঠান শেষে ‘জয় বাংলা’ বলবেন। এ ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলি, সভা-সেমিনারের ক্ষেত্রে ‘জয় বাংলা’ বলতে হবে।
এখানে উল্লেখ করতে পারি, ২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হবে বলে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বিষয়ক সম্পাদক সুমন জাহিদ ‘হৃদয়ে জয় বাংলা’ শীর্ষক এক লেখায় লিখেছিলেন, বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্রের উৎস থেকে উৎসারিত জন্মধ্বনি জয় বাংলা। বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক এই স্লোগান বাঙালির শৌর্য-বীর্য, সংগ্রাম-সংস্কৃতি ও জাতীয় আবেগকে খুবই তীব্র ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে পূর্ণ মাত্রায় ধারণ করে। জয় বাংলা যেমন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তেমনি আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল নাগরিককে স্ব-দায়িত্ব পালনে উজ্জীবিত করার বীজমন্ত্র। অসামপ্রদায়িক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, প্রগতি ও দেশপ্রেমে আত্মপ্রত্যয়ী করতে ‘জয় বাংলা’ শব্দ যুগল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে যে দ্যোতনার তৈরি করে তার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হতে হবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।… ‘জয় বাংলা’ উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী, তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান। অথচ ভারত ও পাকিস্তানে জয়হিন্দ ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ যে সার্বজনীনতা পেয়েছে, জয় বাংলার ক্ষেত্রে তাকে পাড়ি দিতে হচ্ছে খুবই বন্ধুর পথ। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরেও জয় বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ধর্মান্ধতা ও প্রোপাগান্ডা বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা। ৭১ ও ৭৫ এর শত্রুদের আমরা সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করলেও জাতীয় মানসে যে ধর্মভীরুতা রয়েছে তাকে পুঁজি করেই তারা গোপনে ও ভার্চুয়ালি এখনও অতীতের মতই ক্রিয়াশীল। পাকিমনা সেই শত্রুরা জয় বাংলার জায়গায় পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কে প্রতিষ্ঠা করেছে সেই সাথে ‘জয় বাংলা’ কে ইসলাম বিরোধী, হিন্দুয়ানী ও একটি রাজনৈতিক দলীয় স্লোগান হিসেবে প্রচার করছে।
আসলে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাদায়ক ও হৃদয় উৎসারিত স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। শুধু যুদ্ধের সময় যে যোদ্ধাদের হৃদয়ে এই স্লোগান শক্তি জুগিয়েছে, তা নয়; সেসময় ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ- সবার জীবনেরই মন্ত্র ছিল ‘জয় বাংলা’ নামের এ ছোট্ট কিন্তু অসীম শক্তিশালী এক স্লোগান। যুদ্ধের সময় যাঁরা শরণার্থী হয়ে ওপার বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা জয় বাংলার লোক বলে সেখানে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। আনন্দের কথা, ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরদিন প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘দৈনিক আজাদী’র প্রধান শিরোনাম ছিল : জয় বাংলা বাংলার জয়’। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যেন এক অলিখিত নির্দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেল ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করা। ১৯৭৫-পরবর্তী ২১ বছরে যেন বুকের ভেতর শ্বাস আটকে ছিল। কবি লিখেছেন : ‘আটকে ছিল অনেক বছর বুকেরই নিঃশ্বাস/ বন্ধ ছিল হাসিখুশি-আনন্দ উল্লাস। এতোটা কাল হয় নি সকাল, শুধুই ছিলো রাত/ চলছিলো ঠিক গোনাগুনি কারার ধারাপাত। কারার আগুন সারা দেশে জ্বালিয়ে খেল সব/ পালিয়ে গেল সুখের পাখি বুকের কলরব। ফুল ফোটে নি, চাঁদ ওঠে নি, গায় নি পাখি গান/ আশার প্রাসাদ ভেঙে পড়ে, স্বপ্নরা খানখান। ক্ষয় করে সব শক্তি সাহস, জমলো বুকে ভয়/ সাহস করে কেউ বলে নি জয় বাংলার জয়।’
১৯৭৫-পরবর্তী ২১ বছর ধরে অনেকে মনে করেন, এটি আওয়ামী লীগের স্লোগান। কিন্তু সেটাকে আওয়ামী লীগের স্লোগান বললে ‘জয় বাংলা’কে এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে খর্ব করা হয়। মহামান্য হাইকোর্ট বিষয়টি অনুধাবন করে সর্বস্তরে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমরা মনে করি, একাত্তর, জয় বাংলা আর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ছিল যেন আমাদের আত্মার সম্পর্ক।
এ অবস্থায় মহামান্য হাইকোর্ট রায়কে সম্মান জানিয়ে সরকার ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আপামর জনসাধারণের আবেগকে সম্মান দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এটি কোনো দলীয় স্লোগান নয়, এটি আপামর বাঙালির স্লোগান, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী স্লোগান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধব্রনেইই দারুস সালাম-এর জাতীয় দিবস