জ্বালানি সাশ্রয়ে সমালোচনা কেন

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৬ আগস্ট, ২০২২ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন করোনা অতিমারির ভয়াবহতা, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব দুঃসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উর্ধ্বমুখিতায় আমদানি নির্ভর জ্বালানি পণ্য আমদানি এবং সরবরাহে উন্নয়নশীল-স্বল্পোন্নত-উন্নত প্রায় সকল দেশগুলোকে যারপরনাই হিমশিম খেতে হচ্ছে। জ্বালানির দামের উল্লস্ফনে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ প্রতিভাত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ হ্রাস, বেশি দামে জ্বালানি পণ্য আমদানি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশ সরকার আগাম সতর্কতামূলক প্রস্তুতি হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদ্যোগগুলোর মধ্যে জ্বালানিখাতে লোকসান কমাতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো, সারাদেশে এলাকাভিত্তিক দিনে অন্তত এক থেকে দুই ঘন্টা লোডশেডিং, মার্কেটসহ সকল দোকানপাট রাত আটটার পর বন্ধ রাখা, সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ ব্যবহার কমানো, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) কমপক্ষে ২০ শতাংশ জ্বালানি তেলের আমদানি কমানোর নির্দেশনা, অফিসের কর্মঘন্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, সরকারি বিভিন্ন অফিসে জ্বালানির বাজেট বরাদ্দের ২০ শতাংশ কম ব্যবহার, অফিস আদালতসহ সকল প্রতিষ্ঠানে এসির ব্যবহারের সংযমী হওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী পরিবহণে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবহার যৌক্তিককরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রাণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক-শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সাড়া দিয়ে নানামুখী পন্থা অবলম্বন করেছে এবং প্রশংসিতও হয়েছে।
২৬ জুলাই ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে ডিজেল, অকটেন, পেট্রল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েলের মজুদ ক্ষমতা যথাক্রমে ৬ লাখ, ৪৮ হাজার, ৩২ হাজার, ৪২ হাজার ও ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে মজুতের পরিমাণ যথাক্রমে ৪ লাখ ৫ হাজার, ১৪ হাজার ৩০০, ১৭ হাজার ৬০০, ১৩ হাজার ৪০০ ও ৮২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এছাড়াও জেড ফুয়েলের মজুত রয়েছে ৫৮ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যেও বিপিসির আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ লাইন স্বাভাবিক আছে। বর্তমানে দেশে ২০ দিনের পেট্রল, ৩৪-৩৫ দিনের ডিজেল এবং ৪০ দিনের অকটেন মজুদ আছে। স্বাভাবিকের সময়েও মজুদের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি থাকে না। জ্বালানি তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। এটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নয়। জ্বালানি তেল আমদানি স্বাভাবিক রাখতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। জ্বালানি তেল দেশের অগ্রাধিকার পণ্য। তাই এ ব্যাপারে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেল নিয়ে কেউ কেউ গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে বিপিসি এ ব্যাপারে সতর্ক আছে। জ্বালানি তেল নিয়ে যেন কেউ অবৈধ মজুদ গড়ে তুলতে না পারে।’
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী দেশগুলোতেও। বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতিতে পড়া বিশ্বের অনেক ধনী-উন্নত দেশও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এমনকি রাখা হয়েছে জরিমানার বিধান। জাপানের বিদ্যুতের চাহিদার ৯০ শতাংশ আমদানি নির্ভর হওয়ায় বিশাল অঙ্কের টাকা পরিশোধে দেশটিকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। জাপান সরকার জনগণের প্রতি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে একাধিক ঘরে এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার না করাসহ নানান আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়া গ্যাসের রপ্তানি কমিয়ে দেওয়ায় বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানি ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে নিপতিত। সংকট মোকাবেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পুনরায় সচল করাসহ বার্লিনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। ফ্রান্সেও গ্যাস ও জ্বালানি সংকট তীব্র হচ্ছে। আগামী শীত মৌসুমে বিদ্যুৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সে দেশের সরকার। তাই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ফ্রান্সজুড়ে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দোকানগুলোকে দরজা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং নির্দেশ অমান্যকারীকে দিতে হবে ৭৫ ইউরো জরিমানা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানির কঠিন সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা সূত্রে, সম্প্রতি চীনের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্র সহ্য করেছে। প্রায় ৮০টির বেশি শহরে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সতর্কতা জারি করা হয়। চীনের মধ্যাঞ্চলেও চলছে এয়ার-কন্ডিশনার কনডেনসারগুলো। গত ১৩ জুলাই এই অঞ্চলের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অদ্রতার পরিপ্রেক্ষিতে তা ৫৪ ডিগ্রির মতো অনুভূত হয়। ফলে উৎপাদন কারখানাসহ বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরিতে লোড রেশনিং করা হয়। তাপমাত্রার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি গত বছরের জ্বালানি সংকটের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা বৃদ্ধি করছে। বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা চাহিদা মেটাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, অনেক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে এবং কিছু পরিবার ব্ল্যাকআউটের সম্মুখীন হয়েছে। ভারতের ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের ধারণা, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দামের উপর ভিত্তি করে অভ্যন্তরীণ তেল সরবরাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ভারত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ডিজেল ও পেট্রল রপ্তানি কমিয়ে আনছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অধিকতর দীর্ঘায়িত হলে চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়বে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে রাশিয়া যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রপ্তানিতে কাটছাট করে তাহলে জ্বালানি তেলের মূল্য আরও বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাতে পাকিস্তানের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়েও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকগণ। আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, কারেন্ট অ্যাকাউন্টের বিশাল ঘাটতি, মুদ্রার অবমূল্যায়নসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক উপাত্ত অনুসারে এখনই পর্যুদস্ত পাকিস্তান। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এলএনজি লিমিটেড জুলাই মাসের একটি দরপত্র বাতিল করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ এখনও দরপত্র অনুযায়ী জ্বালানি ক্রয় স্বাভাবিক রেখেছে। খোলাবাজার থেকে জ্বালানি আমদানির পরিমাণ কমালেও বাংলাদেশকে কোনো দরপত্র বাতিল করতে হয়নি। ইকোনমিকস টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা মোকাবিলায় নিজের স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা করেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বের অনেক দেশকে তাক লাগিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ধুঁকতে থাকা ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় এখনও নিজের অবস্থানে পাকাপোক্তভাবে রয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্টোরেলসহ আমাদের প্রতিটি মেগা প্রজেক্ট লাভজনক। আর এখানেই শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে মূল পার্থক্যটি গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
২৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক প্রদান অনুষ্ঠানে জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশে যেমন মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, উন্নত দেশগুলোতে অনেক বেশি বেড়েছে। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা শুধু আমরাই নই, উন্নত দেশগুলোও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে, বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে। সেটা আপনি ইংল্যান্ড বলেন বা আমেরিকা বলেন বা ইউরোপের কথা বলেন, আমি উন্নত দেশগুলোর কথাই বলব। তাদের অবস্থাই এখন করুণ।’ ২৭ জুলাই ২০২২ ডি-৮ মন্ত্রীদের ২০তম কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বৈশ্বিক সুদৃঢ় সংহতি-সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সাশ্রয়ের পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্যুতের উৎপাদন কমানোর সিন্ধান্তকে বিশেষজ্ঞরা যথার্থ অর্থে যৌক্তিক বলে অবহিত করেছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের সাথে সাথে বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যা দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের বিকল্প অন্য কোনো পন্থা আছে বলে তাদের মনে হয়না। একই সাথে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা। এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রেখে রপ্তানি বাণিজ্যের গতিশীলতা বজায় রাখার পরামর্শ ও শিল্প-কারখানা লোডশেডিংয়ের আওতামুক্ত রাখার মতামত ব্যক্ত করেছেন। আলোচনা-সমালোচনা-গুজব-বিভ্রান্তি না ছড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শক-সচেতন মহলের আহ্বান নিগূঢ় তাৎপর্যপূর্ণ। বৃহত্তর জনস্বার্থে সাময়িক দুর্ভোগ আপামর জনগণ সহনীয় মনে করলেও স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি-দল-প্রতিষ্ঠান সাশ্রয় উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে নানামুখী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। অন্ধকারের এসব পরাজিত শক্তির সকল কদর্য অপকৌশল নস্যাৎ করে দেশ যথার্থ অর্থেই সুপরিকল্পিত পন্থায় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবেই – নিঃসন্দেহে এটুকু প্রত্যাশা মোটেও অযৌক্তিক বা অমূলক নয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় বাস-মাইক্রো সংঘর্ষ, আহত ৫