জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি : দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হবে

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | শুক্রবার , ১৯ আগস্ট, ২০২২ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারির ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামের ঐতিহাসিক পতন। সারাবিশ্বে যখন লকডাউন চলছিল, তখন জ্বালানি তেলের দাম মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ কেউ এক ব্যারেল তেল কিনলে তাকে উল্টো ৩৭ ডলার দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু উৎপাদন বন্ধ করা কারিগরী দিক থেকে ক্ষতিকর। সেহেতু উৎপাদনমাত্রা স্থির থাকলেও কখনও কখনও ক্রেতা শূন্য ছিল জ্বালানি মার্কেট। এরপর ওপেক ও রাশিয়া ধারাবাহিকভাবে তেল সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে চলতি বছরের শুরুর দিকে তেলের দাম হঠাৎ করে বেড়ে ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার হয়ে যায়। তখন এ বৃদ্ধি প্রধানত দুটি কারণে বলে মনে করা হয়েছিল। এর একটি হলো পেছনে করোনাকালীন ধাক্কা সামলে উঠে উৎপাদনে গতি আসায় তেলের চাহিদা বৃদ্ধি, এবং অন্যটি হলো ইউক্রেন আক্রমণের জেরে বৃহৎ জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব। এক পর্যায়ে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম উঠে যায় ১৩৯ ডলারে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে ভূ-রাজনীতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রকাশ্যে চলে এসেছে উল্টো ইউরোপে রাশিয়া কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার ব্যাপার। ফলে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে ঋণ সংকট এবং সর্বোপরি বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক চীনের কোভিড নির্মূল নীতির কারণে জ্বালানি তেলের ভবিষ্যৎ চাহিদা খুব একটা আশাপ্রদ নয়। এরই ফলশ্রুতিতে নানা জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্ববাজারে তেলের দামের প্রবণতা নিম্নমুখী। কিন্তু সৌদি আরব অন্যান্য মহাদেশে কম দামে বিক্রি করলেও এশিয়াতে বিক্রি করছে সর্বোচ্চ দামে। বিশেষজ্ঞদের মতে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার বাস্তবিক সম্ভাবনা রয়েছে।
এই যখন অবস্থা বাংলাদেশ সরকার হঠাৎ করে তেলের দাম বৃদ্ধি করলো গত ৫ তারিখ মধ্যরাত হতে। মানুষ আশায় বসেছিল আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে দাম কমাবে কিন্তু তা না করে রেকর্ড পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন দাম বাড়ার কারণগুলো আমরা লক্ষ্য করি। সরকার বলছে বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি’র লোকসান কমানো এবং পাচার হওয়ার আশঙ্কার কথা। অন্যদিকে আরেকটি কথা চাউর হয়েছে সরকারের আইএমএফ এর লোন নেওয়ার প্রসঙ্গ। বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্বে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও কিছুটা যে ধাক্কা লেগেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং স্বীকার করাটাই সরকারের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ কারণ তিনি নিজে সারাদেশে জ্বালানি সাশ্রয় কথা বলেছেন। এ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু এ সংস্থা ঋণ দিবে তবে শর্তাধীনে। ঋণের প্রধানতম শর্তই হলো জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। তাই হয়তো সরকার বৈঠকের আগেই শর্তপূরণ করে আইএমএফকে খুশী করে দিল। আমরা দেখেছি এই খাতে বাজেটে সরকারের বিশাল ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল। তাই একধাপে একবারে এতটা দাম না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেত। জ্বালানিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, দাম কমলে কমাবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ অতীত অভিজ্ঞতায় সে কথা বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ দাম যখন কম ছিলো তখন সরকার দেশে তেলের দাম না কমিয়ে বিপিসির মাধ্যমে লাভ নিয়েছে। সেই লভ্যাংশ থেকে ভর্তুকি আসবে এমন প্রত্যাশা ছিল জনগণের। কিন্তু এখন যখন আবার কমছে তখন সংকট এড়াতে তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার হয়তো প্রথমে দাম না বাড়িয়ে আমদানি কমিয়ে ব্যবহারের সংকোচন নীতির দিকে যাচ্ছিল-এমন মনে হয়েছিল। বিপিসির লোকসান কমানোর জন্য দাম সমন্বয়েরও একটা কথা যখন আলোচনায় আসে এবং সাথে আইএমএফ এর ঋণের হাতছানিতে সরকার বর্তমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দাম বাড়াতে আগ্রহী হয়।
এখন আসছি এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে কী হতে পারে তা নিয়ে। সোজা কথা লাগামহীন হয়ে যেতে পারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম। আমার মতে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করাই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আয় না বাড়লে এ অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য। মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলতে থাকবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটার অপেক্ষায় বসে থাকে। ইতিমধ্যে বাস মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ’র এক যৌথ সভা শেষে ঢাকায় ১৬ শতাংশ এবং দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ বাস ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। সূত্রমতে, মহানগরে প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া বাড়বে ৩৫ পয়সা এবং দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বাড়বে কিলোমিটার প্রতি ৪০ পয়সা। পরিবহন ব্যয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধাপে ধাপে প্রত্যেকটা সেক্টরে পরিলক্ষিত হবে।
আইএমএফ-এর পরামর্শক্রমে এরপর যদি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায়, তরতর করে দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীদের আর কোনো অজুহাতের দরকার হবে না। তবে বলতে দ্বিধা নেই বর্তমান বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত সংসার চালাতে হিমশিম খাবে আর দরিদ্ররা হবে দিশেহারা। অনেককে তিনবেলার বদলে একবেলা খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে জীবনধারণ করতে হবে। পেটে ক্ষিধা থাকলে উন্নয়নের যত শ্লোগানই দেওয়া হোক না কেন, তা যেমন কাজে আসবে না; তেমনি বিশ্ববাজার উর্ধ্বমুখী, যুদ্ধাবস্থার অজুহাতও কাজ দিব না। ঠিক এ জায়গায় জনগণকে বিভ্রান্ত করে অনেক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ফায়দা লুঠার অপেক্ষায় থাকবে। জনগণকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। এ চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করবে সরকার তার পরিকল্পনা এখন থেকেই করা উচিত বলে মনে করি।
প্রথমেই সিন্ডিকেট করে যারা দাম বাড়ায় তাদের দিকে নজর দিতে হবে। জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে এদের প্রতি। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার। টিসিবিকে বাজার ও দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখাতে অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে। হয়তো কিছু পণ্যের দাম বাড়বে, তবে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ঢালাওভাবে যেন দাম বাড়াতে না পারে। বাজারে পণ্যের মূল্য টানানোর যে নিয়ম তা অনেক জায়গায় দেখা যায় না -এটি কার্যকরী করতে হবে। বাজারে চাহিদা পর্যবেক্ষণ পূর্বক সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। কৃষিখাতের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অধিক ফলনে উৎসাহী হয়। সবচেয়ে জরুরি বাজার ব্যবস্থাপনার উপর সরকারের কঠোর নজরদারী জরুরি, যেন কোনো কালোবাজারি, মজুতদার বা সিন্ডিকেট যেন কারো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করতে গিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে। পরিশেষে প্রত্যাশা, একসময় পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়লেও আজ দাম কমে ৪০ টাকায়। জ্বালানিতেলের ক্ষেত্রেও যেন ভবিষ্যতে আমরা একই দৃশ্য দেখি। কোন মাকেও যেন অভাবের তাড়নায় সন্তানকে বিক্রির জন্য বাজারে তুলতে না হয়।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্ আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন