জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:২২ পূর্বাহ্ণ

হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.) একটি আদর্শ জীবন
মহান অলী খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী (র.) ও ইসলাম প্রচার: আমাদের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিরোধানের পর সাহাবায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষা প্রচারিত প্রসারিত। খোদা প্রদত্ত অসাধারণ বেলায়তী ক্ষমতা ও গুণাবলীর অধিকারী হয়ে উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামের সুমহান সাম্য ও শান্তির বাণী প্রতিষ্ঠা করতে যারা সক্ষম হয়েছিলেন খাজায়ে খাজাগান আতায়ে রাসূল হিন্দাল অলী গরীবে নওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি হাসান সঞ্জরী (র.) তাঁদের অন্যতম ।
পবিত্র কুরআনে আউলিয়া কেরাম সম্পর্কে সুসংবাদ: তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত আল্লাহর প্রিয় মাহবুব বান্দা আউলিয়ায়ে কেরামের মর্যাদা বর্ণনায় পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত নাযিল হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, সাবধান! নি:সন্দেহে আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাঁদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। পার্থিব জীবনে এবং পরলৌকিক জীবনে আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন নেই। এটিই মহা সাফল্য। (সূরা: ইউনূস: আয়াত: ৬২-৬৪)
খাজা গরীবে নওয়াজের জন্ম ও বংশ পরিচয়: নাম: মুঈনুদ্দিন হাসান (র.) উপাধি হিন্দাল অলী, আতায়ে রসূল, গরীবে নওয়াজ, নায়েবে মোস্তফা, ওয়ারেসুল আম্বিয়া, আফতাবে চিস্তীয়া, সুলতানুল হিন্দ।
জন্ম: ৫৩০ মতান্তরে ৫৩৭ হিজরিতে মধ্য এশিয়ার খোরাসানে সঞ্জর এলাকার সীস্তান নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। ৬২৭ মতান্তরে ৬৩৩ হিজরিতে ৬ রজব ভারতের আজমীর শরীফে ইন্তেকাল করেন। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:-২, পৃ: ২৬৩)
পিতার নাম: সৈয়্যদ খাজা গিয়াস উদ্দিন (র.), মাতা: সৈয়্যদা উম্মুল ওয়ারা মাহেনূর। পিতৃকুলের দিক থেকে তিনি হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) মাতৃকুলের দিক থেকে হযরত ইমাম হাসান (রা.)’র বংশধারায় সম্পৃক্ত হওয়ায় তিনি আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী বংশধারায় নবীজির পবিত্র বংশধর। (খযীনাতুল আসফীয়া, খন্ড: ১, পৃ: ২৫৭)
পিতা খাজা সৈয়্যদ গিয়াস উদ্দিন (র.) ছিলেন অতি উঁচু স্তরের বুজুর্গ মুত্তাকী পরহেজগার। খাজা গরীব নওয়াজের বয়স যখন ১৫ বৎসর তখন বুজুর্গ পিতা ইন্তেকাল করেন। (মিরআতুল আসরার, পৃ: ৫৯১)
শিক্ষার্জন: সাত বৎসর পর্যন্ত খোরাসানে লালিত পালিত হন। বুজুর্গ পিতার সান্নিধ্যে প্রাথমিক দ্বীনি পিক্ষা অর্জন করেন। চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত পিতার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সঞ্জরের প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ শাস্ত্রে গভীর বুৎপত্তি লাভ করেন। প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা ইমামুল হারামাঈন হযরত আবুল মালী (র.)’র নিকট শরীয়তের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সমরকন্দের প্রখ্যাত আলেম হযরত শরফুদ্দিন (র.) বুখারার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হুসামুদ্দিন (র.)’র নিকট দীর্ঘ পাঁচ বৎসর হাদীস শাস্ত্রে কৃতিত্বপূর্ণ পূর্ণতা অর্জন করেন।
পীর মুর্শিদের সান্নিধ্যে বিশ বছর: খাজা গরীবে নওয়াজ জাহেরী বাতেনী উলুমে এলাহিয়্যার ধারক হওয়া সত্বেও রুহানিয়ত তথা আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে মুর্শিদে কামিল হযরত খাজা ওসমান হারওয়ানি (র.)’র খিদমতে নিজকে উৎসর্গ করেন। পীর ও মুর্শীদের হাতে বায়আত গ্রহণের পর নিজকে সম্পূর্ণরূপে শরীয়ত ও তরীক্বতের খিদমত ইবাদত রিয়াযত মুরাকাবা মুশাহাদা কঠোর সাধনা ও পীরের আদেশ পালনে একাধারে বিশ বৎসর মুর্শীদের খিদমতে নিজকে নিয়োজিত রাখেন। এ সময়ে মুর্শীদের সফরসঙ্গী হয়ে সফরের উপকরণ, বিছানাপত্র, আসবাবপত্র, নিজ কাঁধে ও মাথায় বহন করে শতশত মাইল দূর দূরান্তের কষ্টসাধ্য সফর অতিক্রম করে হাকিকত, মারিফত ও বেলায়তের উচ্চস্তরে নিজকে অধিষ্ঠিত করেন। পীর মুর্শিদের ফয়েজ বরকত ও খিলাফতের মর্যাদা লাভে ধন্য হন। (সিয়রুল আউলিয়া, পৃ: ৫৫, মিরআতুল আসরার, পৃ: ৫৫৬, আনিসুল আরওয়াহ, পৃ: ৩)
মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারা যিয়ারত: সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীব নওয়াজ বর্ণনা করেন, আমি আমার দয়াল মুর্শিদ হযরত খাজা ওসমান হারওয়ানীর সাথে খানায়ে ক্বাবা বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারত লাভে সৌভাগ্য অর্জন করি। আমার পীর মুর্শিদ খানায়ে কাবার মীজাবে রহমতের নীচে আমার হাত ধরে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! আমি মুঈনুদ্দিনকে তোমার দরবারে সোপর্দ করলাম। অদৃশ্য থেকে আওয়াজ এলো, আমি মুঈনুদ্দিনকে কবুল করলাম। (আনিসুল আরওয়াহ, পৃ:২)
সফরকালে অসংখ্য অলীদের সাক্ষাৎ: খাজা বাবা আপন পীর মুর্শিদের অনুমতিক্রমে বিভিন্ন দেশভ্রমণ করে জ্ঞানী-গুণী, পন্ডিত, দার্শনিক ও অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরামের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন। বাগদাদ শরীফে গাউসুল আজম দাস্তগীর আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র সহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময় গাউসেপাক খাজা বাবাকে বলেছিলেন ইরাকের দায়িত্ব শায়খ সেহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্তানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সংবাদ মদীনা শরীফে রওজা শরীফ যিয়ারতকালে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাগদাদ যাবার পথে গরীব নওয়াজ (র.) সঞ্জর শহরে প্রখ্যাত অলী হযরত নজমুদ্দিন কুবরার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সান্নিধ্যে আড়াই মাস অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর সাথে বিখ্যাত দার্শনিক শায়খুল আকবর মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবীর সাক্ষাৎ হয়। এভাবে তিনি বদখশান, সমরকন্দ, খারাকান, হামাদান, ইস্পাহান, বুখারা, ফিলিস্তিন, প্রভৃতি স্থান সফর করেন। শতশত অলী আল্লাহর রুহানী ফয়জ বরকত লাভে ধন্য হন।
গরীব নওয়াজের অমূল্য উপদেশ: খাজা গরীব নওয়াজ (র.) বর্ণনা করেন, পাঁচটি জিনিস দেখা ইবাদত:
এক: যে সন্তান ভালবাসার দৃষ্টিতে মাতা-পিতার চেহারা দেখবে তার আমল নামায় হজ্বের সওয়াব লিপিবদ্ধ হবে। দুই: কুরআন শরীফ দেখা ও পড়া। যে ব্যক্তি আল্লাহর কালাম কুরআন শরীফ দেখবে অথবা দেখে পড়বে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে দু’টি সওয়াব দান করবেন। একটি কুরআন শরীফ পড়ার দ্বিতীয়টি কুরআন শরীফ দেখার প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশটি নেকী দান করবেন। দশটি গুনাহ ক্ষমা করবেন। তিনি আরো এরশাদ করেন যে ব্যক্তি কুরআনের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে তার চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পাবে। (দলীলুল আরেফীন, পৃ: ২১) তিন: আলেমেদ্বীনের চেহারা দেখা: গরীবে নওয়াজ এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন হক্কানী আলেমেদ্বীনের চেহারার প্রতি মুহব্বতের সাথে দৃষ্টিপাত করবে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একজন ফিরিস্তা নিযুক্ত করবেন। যে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ ব্যক্তির ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করতে থাকবে।
চার: ক্বা’বা শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করা: হুযুর খাজা গরীবে নওয়াজ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ক্বা’বা শরীফ যিয়ারত করবে হাজার বৎসরের ইবাদত এবং হজ্বের সওয়াব তাঁর আমল নামায় লিপিবদ্ধ হবে। অলীদের মর্যাদা তার নসীব হবে। (দলীলুল আরেফীন, পৃ: ২২)
পাঁচ: পীর মুর্শীদের সাক্ষাৎ: আতায়ে রসূল খাজা গরীব নওয়াজ বর্ণনা করেন, পীর-মুর্শীদের যিয়ারত ও খিদমত সওয়াবের কাজ। হযরত খাজা ওসমান হারওয়ানী (র.) বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে পীরের প্রতি খিদমত ও মহব্বত নিবেদন করবেন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে বিনা হিসাবে জান্নাত দান করবেন। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ:৩৬৩-৩৬৪)
গরীব নওয়াজের প্রবর্তিত ও প্রচারিত তরীকাহ: হুযুর খাজা গরীব নওয়াজের প্রবর্তিত ও প্রচারিত চিশতীয়া তরীকাহ’র মাধ্যমে পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে, ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান আফগানিস্তান চীন আরব ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এ তরীকার শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়ে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। খাজা বাবা পৃথ্বিরাজের সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ভারত বর্ষে কলেমার আওয়াজ বুলন্দ করেন। মূলত তাঁর পবিত্র বরকতময় হাতেই ভারত বর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
অলীর পরিচয়: হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর ওলীগণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, নবীজি এরশাদ করেন, যাদের দেখলে আল্লাহর স্মরণ হয়। (নাসাঈ শরীফ, হাদীস নং: ১১২৩৫)
হাদীসে কুদসীতে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, যে আমার ওলীর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তার বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৬৫০২)
ইন্তেকাল: অবশেষে দ্বীন মাযহাব ও ইসলামের বিশাল খিদমত আঞ্জাম দিয়ে ৬৩৩ হিজরিতে ৬ রজব সোমবার সুবহি সাদিকের সময় এ মহান ওলী ৯৭ বছর বয়সে তাঁর প্রভূর সান্নিধ্যে গমন করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপূত্র হযরত খাজা ফখরুদ্দিন চিশতী (র.) তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ হোক আমাদের মুক্তির পাথেয়। হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার প্রিয় ওলীদের ভালবাসা দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামী জ্ঞান-জিজ্ঞাসা
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে