জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ

কুরআনহাদীসের আলোকে যাকাতের বিধান

যাকাতের অর্থ ও শরয়ী সংজ্ঞা:

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! জেনে রাখুন “যাকাত” আরবী শব্দ। আরবী অভিধানে শব্দটি ছয়টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যথাক্রমে পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি অর্জন, কল্যাণ, প্রশংসা, অধিকার এবং ব্যয় করা। যাকাত একদিকে যাকাত দাতার আত্মা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে এবং তার ধন সম্পদকেও পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। যাকাত আদায়ের কারণে আল্লাহ তা’আলা যাকাত আদায়কারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন। পবিত্র কুরআনুল করীমের ১৯টি সূরায় ৩২টি আয়াতে যাকাত শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। (লিসানুল আরব: ২য় খন্ড, পৃ: ৩৬)

যাকাতের সংজ্ঞা :

শরীয়তে যাকাত হল, সম্পদের নির্দিষ্ট এক অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কোন মুসলিম দরিদ্র অভাবীকে নিঃস্বার্থভাবে প্রদান করা। প্রদত্ত ব্যক্তি থেকে কোন প্রকার উপকৃত হওয়ার আশা থেকে নিজকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখবে। দরিদ্র ব্যক্তি হাশেমী বংশের লোক হতে পারবেনা বা হাশেমী বংশের আযাদকৃত দাসদাসীও হতে পারবেনা। (দুররুল মোখতার)

নিসাবের মালিক হলে যাকাত ফরজ:

যাকাত ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নারীপূরুষ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। তাদের উপর যাকাত দেয়া ফরজ।

স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থের নিসাব:

স্বর্ণ হল বিশ মিছকাল দেশীয় হিসেবে সাড়ে সাত তোলা প্রায় (৮৮ গ্রাম) রৌপ্য হল দুইশত দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) কিংবা কারো নিকট সমপরিমাণ মালামাল বা অর্থ সঞ্চিত থাকলে উল্লেখিত সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে। ফকীহগণের সর্ব সম্মতিক্রমে কারো নিকট গড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ না থাকলেও সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা থাকলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। (ফতোওয়ায়ে শামী)

যাকাত আদায়ের সময় নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত না করলে যাকাত আদায় হবেনা। যাকাত গ্রহীতা যদি যাকাত গ্রহণের উপযোগী হয় তাকে যাকাত দেয়ার সময় যাকাতের মাল দেয়া হচ্ছে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই।

আল কুরআনে যাকাত প্রসঙ্গ:

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তা’য়ালা যাকাতের বিধান বর্ণনা প্রসঙ্গে আটটি খাতের কথা উল্লেখ করেছেন, এরশাদ হয়েছে “ সাদকা তো কেবল ফকীর ও মিসকীনদের জন্য এবং সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত লোকদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য এটা আল্লাহর বিধান আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।” (সূরা : তাওবা ৯: ৬০)

হাদীসের আলোকে যাকাত অনাদায়ীর কঠিন শাস্তি:

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে ধনসম্পদ পেয়েছে কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি কিয়ামতের দিন ঐ ধনসম্পদ এমন বিষধর সর্পে পরিণত হবে। যার মাথার উপর থাকবে দুটি কালো দাগ। এ সর্প সে ব্যক্তির গলায় পেছিয়ে দেয়া হবে। অত:পর সাপ উক্ত ব্যক্তির গলায় ঝুলে তার দু গালে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ। (বুখারী ও নাসায়ী হাদীস নং ২৪৮২)

যাকাত দাতার জন্য দুআ করা উত্তম :

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেস্তা অবতরণ করেন তাদের একজন বলেন হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন। অপর জন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন। (বুখারী শরীফ হাদীস নং : ১৩৫১)

যাকাত ঐচ্ছিক বিষয় নয়:

আমিরুল মুমেনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) যাকাত অনাদায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী আরোপ করেছেন। এরশাদ করেছেন, “ আল্লাহর শপথ যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। কেননা যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক আল্লাহর শপথ যদি তারা আমাকে একটি উটের রশি প্রদানেও অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসূলুল্লাহকে প্রদান করত, তবে এ অস্বীকৃতির জন্য আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। ( বোখারী শরীফ, পৃ: ১৮৮) সুতরাং যাকাত আদায় করা ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বাধ্যতামূলক।

যাকাত অনাদায়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি:

রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জলে স্থলে যেখানেই কোন সম্পদ ধ্বংস হয় তা কেবল যাকাত আটকিয়ে রাখা তথা আদায় না করার কারণেই হয় (তাবরানী শরীফ)

মাসআলা: তিন প্রকার মালের যাকাত ওয়াজিব। ১. অলংকার অর্থ্যাৎ স্বর্ণ, রৌপ্য, . ব্যবসায়িক সামগ্রী, . বিচরণকারী প্রাণী অর্থাৎ চারণভূমিতে ছেড়ে দেওয়া পশু। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৩৬)

অলংকার স্বর্ণ রৌপ্য মোটেই মৌলিক চাহিদাভুক্ত নয়। সুতরাং স্বর্ণ রৌপ্য দ্বারা নির্মিত ব্যবহার্য প্লেট, আসবাব পত্র হোক বা সাজ সজ্জার জন্য হোক দুটোতে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ হিসেবে যাকাত দিতে হবে। যে অলংকারের যাকাত দেয়া হবে না, সে গুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে পরিধান করা হবে মর্মে অসংখ্য হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, ব্যবসায়িক সম্পদ যদি মাটিও হয় এর যাকাত দিতে হবে। চারণভূমিতে বিচরণকারী উট, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, নরমাদী যে শ্রেণির হোক ইমাম আবু হানিফা (.)’র মতে নির্দ্দিষ্ট হিসেব অনুপাতে যাকাত দিতে হবে। (ফাতওয়াএ আফ্রিকা, কৃত: ইমাম আহমদ রেযা (.), ফাতওয়াএ ফয়জুর রসূল, ৩য় খন্ড, পৃ: ৩১৩)

যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে:

. ফকীর, যার কাছে কিছু সম্পদ আছে তা নিসাব পরিমাণ নয়, যা দ্বারা তার প্রয়োজন পূরন হয় না তাকে ফকীর বলে।

. মিসকীন, যার কাছে কিছুই নেই।

. আমিলুন, যাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত ব্যক্তি, যদিও সম্পদশালী হয় তবে হাশেমী বংশের হলে তাকে দেয়া যাবেনা। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড)

মুসলমানদের উচিৎ নবীজির বংশের সম্মানার্থে নবী বংশের লোকদেরকে অন্য উপায়ে সাহায্য সহযোগিতা করা। (ওয়াকারুল ফাওতয়া, ২য় খন্ড, পৃ: ৩৯৭)

হাশেমী বংশের লোকদের যাকাত প্রদান জায়েজ নয়। তবে নফল দান তাদেরকে সর্বাগ্রে করা উচিত। দান করার সময় তাঁদের শ্রদ্ধা ও তাজিমের সাথে করতে হবে যেহেতু তাঁরা প্রিয় নবীর বংশধর। [মালাবুদ্দা মিনহু, কাযী ছানাউল্লাহ পানি পথী (.)]

. ঋণ গ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের জন্য।

. আল্লাহর পথে, যেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌছেনি সেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর কাজে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে। আল্লাহর পথে দ্বীনি ইলম অর্জনকারী অভাবী শিক্ষার্থীদের যাকাত দেয়া যাবে। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৭৯৮১)

. মুসাফির, যে ব্যক্তি সফর অবস্থায় অর্থ সংকটে পড়েছে, সম্পদশালী হলেও তাকে যাকাত দেয়া যাবে।

যাদেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা:

. নিসাব পরিমান সম্পদের মালিককে যাকাত দেয়া যাবেনা।

. যাকাত দাতার উর্ধ্বতন বা অধ:স্তন বংশধর। অর্থাৎ পিতামাতা, দাদাদাদী, নানানানী, ছেলেমেয়ে, নানিনাতনী, প্রৌপুত্রপ্রৌপুত্রীদেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা।

. স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দেয়া যাবেনা।

. কোন কাফেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা। (মালাবুদ্দা মিনহু, নুুরুল ইযাহ, আনোয়ারে শরীয়ত)

. ভ্রান্ত আকিদা পোষণকারী। নবী রাসূল ও সাহাবাদের ব্যাপারে ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী যাদের কুফরি আক্বিদা প্রমাণিত। তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবেনা। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৮৮, ফাতওয়াএ ফয়জুর রসূল, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১২৮)

যাদেরকে যাকাত দেয়া উত্তম:

যাকাত প্রদানে উত্তম হলো, প্রথমে নিজভাইবোন, অতঃপর তাদের সন্তানসন্ততি, তারপর চাচা, ফুফু, অতঃপর ওদের সন্তানসন্ততিদেরকে অতঃপর মামা ও খালুদেরকে অতঃপর ওদের সন্তানসন্ততিদের অতঃপর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজনদেরকে অতঃপর প্রতিবেশী, অতঃপর সহকর্মী অতঃপর নিজ গ্রামবাসীদের যাকাত দেয়া উত্তম। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৮৮, আনোয়ারে শরীয়ত)

যাকাত অনাদায়ে পরিণতি:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জলে স্থলে যে সম্পদ ধ্বংস হয় তা যাকাত না দেয়ার কারণেই হয়। (তাবরানী শরীফ)

আল্লাহ তা’আলা আমাদের শরয়ী বিধি মোতাবেক সঠিকভাবে যাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ ইকরামুল হক

ছিপাতলী, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: ইতিকাফ অর্থ কী? ইতিকাফের শরয়ী বিধান সম্পর্কে জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা বা একস্থানে স্থির থাকা। শরয়ী পরিভাষায় মসজিদে আল্লাহর ওয়াস্তে নিয়ত সহকারে অবস্থান করা হচ্ছে ইতিকাফ। (আলমগীরি, দুররুল মোখতার ও রদ্দুল মোহতার)

ইতিকাফের জন্য জামে মসজিদ হওয়া শর্ত নহে। বরং যে মসজিদে জামাত হয় সেটাতেও ইতিকাফ করা যাবে। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৫ম, পৃ: ১৮০)

রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করা “সুন্নাতে মুআক্কাদাহ আলাল কিফায়াহ” যদি শহরের একজন পালন করে সকলে দায়মুক্ত হবে। আর যদি একজনও পালন না করে সকলকে জবাবদিহী করতে হবে। (বাহারে শরীয়ত খন্ড:৫ম, পৃ: ১৮১)

রমজানের বিশ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করবে এবং ত্রিশে রমজান সূর্যাস্তের পর বা ঊনত্রিশ তারিখ চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হবে।

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল পর্যন্ত প্রতি বৎসর রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ২০২৬, মুসলিম: ১১৭২)

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাহে রমজানে দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শন
পরবর্তী নিবন্ধআত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার মাস রমজান: স্মৃতি বিজড়িত বদর-আমাদের প্রেরণা