আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার মাস রমজান: স্মৃতি বিজড়িত বদর-আমাদের প্রেরণা

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরের মতন আবারও ঘুরে এলো মাহে রমজান। রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এই রমজানেই আত্নশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জনের শ্রেষ্ঠ সময়। নিজে ও নিজের পরিবারপরিজনকে সাথে নিয়ে বিশুদ্ধ সিয়ামের মাধ্যমে গোটা জিন্দেগীর আমল পরিবর্তন করার শ্রেষ্ঠ সময় এই রমজান।

 

এই মাস তাকওয়ার মাস। তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনে এই মাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা, ‘হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যেমনি করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, আশা করা যায় তোমরা

তাকওয়া অর্জন করতে পারবে’। সূরাবাকারা১৮৩। বিখ্যাত সাহাবী হযরত কা’বকে হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, হে কা’ব তুমি আমাদের তাকওয়া সম্পর্কে বল। হযরত কা’ব বললেন, ‘হে ওমর (রা) তুমি কি ঘন ঝোপজঙ্গল পরিবেষ্টিত দু’পাহাড়ের সরু পথ দিয়ে হেঁটেছ? যে পথের দু’পাশে রয়েছে কাঁটা বন।

সামনেও কাঁটা, পেছনেও কাঁটা, নিচেও কাঁটা। সে পথ দিয়ে হাঁটতে হলে সতর্কতার সাথে হাঁটতে হবে কাঁটাগুলো সরিয়ে। হে ওমর (রা) জীবনের সমগ্র পথ হচ্ছে এই গিরিপথযার দু’পাশ কন্টকাকীর্ণ। এখানে প্রতিটি কদম ফেলতে হবে অতি সাবধানতার সাথেএটিই হচ্ছে তাকওয়া। এই মাসের মূল শিক্ষা হল

তাকওয়া। তাকওয়া মানে হচ্ছে বেছে বেছে চলা এবং খোদাভীতি অর্জন করা। রোজা যেমন প্রত্যেক মুমিন বান্দার উপর ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি আল্লাহর পথে জেহাদও ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালার স্পষ্ট ঘোষণা, ‘(ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় নির্মূল করার জন্যে) যুদ্ধ তোমাদের উপর ফরজ

করে দেওয়া হয়েছে, আর সেটাই তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। এমনওতো হতে পারে, যে বিষয়টি তোমাদের ভাল লাগে না, তাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আবার এমন কোনো জিনিস, যা তোমরা পছন্দ করবে কিন্তু তা হবে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর; আল্লাহতায়ালা সবচাইতে ভালো জানেন, তোমরা কিছুই জান

না’। সূরা বাকারা২১৬। এই পবিত্র মাসেই ইসলামের বড় বড় বিজয়গুলো সংঘটিত হয়েছিল। তারমধ্যে অন্যতম হল ঐতিহাসিক বদরের বিজয়। হিযরতের দ্বিতীয় বছর ১৭ রমজান বদরের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। মূলত কয়েকটি বিশেষ কারণে বদর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। ১। মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সাঃ)

সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। মদিনায় ইসলামের অগ্রযাত্রা, দেশবিদেশে ইসলামের প্রচার, দূত প্রেরণ ও দলে দলে ইসলাম গ্রহণের ফলে মক্কার কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত হয়ে শত্রুতা শুরু করে। তারা নব প্রতিষ্ঠিত এই ইসলামী রাষ্ট্র এবং তার অধিপতিকে ধ্বংস করার শপথ গ্রহণ করে। ২। মহানবী

(সাঃ) এর মদিনার শাসন কর্তৃত্ব গ্রহণ করায় মোনাফিক নেতা আবদুল ইবনে ওবাই ঈর্ষান্বিত হয়ে নব গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের ইন্ধন যোগায় এবং তার অনুসারীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণে প্ররোচিত করে। ৩। মদিনার ইহুদিরা রাসূল (সাঃ) এর উন্নত আদর্শের কথা জেনে তাঁকে

আমন্ত্রণ করলেও তাদের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে না পেরে ঈর্ষান্বিত হয়। তাই তারা মদিনায় নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মক্কার কুরাইশদের প্ররোচিত করে। ৪। মক্কার ব্যবসায়ীরা সিরিয়া ও মিশর প্রভৃতি দেশের সাথে নিয়মিত ব্যবসা বাণিজ্য করতো কিন্তু মদিনা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রনে

চলে যাওয়ার ফলে, মদিনার পাশ দিয়ে কুরাইশদের একমাত্র বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ হয়ে আসে। ৫। মক্কার কুরাইশরা মদিনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মুসলমানদের শস্য ক্ষেত জ্বালিয়ে দিত। ফলমূল ধ্বংস করত এবং উট ও ছাগল অপহরণ করে নিয়ে যেত, ফলে মুসলমানরা আত্নরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়। ৬।

মক্কার কাফেররা মহানবী (সাঃ) এর ধর্মীয় জাগরণ যেমন সহ্য করতে পারত না, তেমনি মহানবী (সাঃ) কে সহ্য করতে পারত না। তাই তারা যুদ্ধের মাধ্যমে মহানবী (সাঃ) কে হত্যার দুঃসাহস করেছিল। ৭। কুরাইশ বাহিনীর ধ্বংসাত্নক নীতির কারণে রাসূল (সাঃ) নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষায় প্রতিরক্ষামূলক

সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অনিবার্যরূপে তা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। ৮। ইসলামী দীপ্ত শিখা নির্বাপিত করার লক্ষ্যে মক্কার কুরাইশরা ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং এদিকে ইসলামের ক্রমাগত সাফল্য দেখে পৌত্তলিক সমাজে ভাঙ্গন শুরু হয়। তাই তারা যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়। আর ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে

আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনা হিসাবে বদর যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ান বাণিজ্যের অজুহাতে যুদ্ধের সমর সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরছিল। তখন এক ভিত্তিহীন গুজব উঠে যে, আবু সুফিয়ানসহ কুরাইশ কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তাই কুরা্‌ইশরা আবু জাহেলের

নেতৃত্বাধীন মদিনা আক্রমণ করার জন্য এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করে। এই সংবাদে মহানবী (সাঃ) অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় আল্লাহর নির্দেশ আসে যে, ‘হে নবী, আপনি তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে যুদ্ধ

করুন, যারা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে’। কুরাইশদের মদিনা আক্রমণ এর সংবাদ শুনে তাদের গতিরোধ করার জন্য মহানবী (সাঃ) ৬২৪ খ্রীষ্টাব্দে ১৬ মার্চ তথা ১৭ রমজান ৩১৩ জন মুজাহিদ সহ মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে বদর নামক প্রান্তরে উপনীত হন। এদিকে কুরাইশ বাহিনী সেদিকে উপস্থিত হয়।

সেখানে উভয় দলের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। মুসলমানদের ১৪ জন শাহাদাত বরণ করেন। অপরদিকে আবু জাহেলসহ কুরাইশদের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। তবে এই যুদ্ধে আল্লাহর পক্ষ হতে ৩,০০০ ফেরেশতা প্রেরণ করেন পরোক্ষভাবে সাহায্য করার

জন্য। সেই ফেরেশতা এখনো পৃথিবীর জমিনে রয়ে গেছেন। আল্লাহ তাদেরকে আসমানে ফিরিয়ে নেননি। আমার রাসূল (সাঃ) সত্য ও সুন্দরের পক্ষে এবং ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন অহিংস পন্থায়। তবুও কুফরী শক্তি শান্তির বাণী প্রচারে বিঘ্ন সৃৃষ্টি করত। মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে প্রায় ৩ বছর

শিহাবে আবু তালেব নামক স্থানে সপরিবারে অবরুদ্ধ করে রাখে। দাওয়াতী কাজে তায়েফ গমন করলে সেখানে তাঁকে পাশবিক নির্যাতনে জর্জরিত করে। মূলত মোনাফেক নেতা আবদুল ইবনে ওবাই ইবনে সালুল ইহুদি খ্রিষ্টানদের সাথে গোপন আঁতাত করে মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিকরা বদর যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধের

পর নবীজি ঘোষণা করলেন, ‘তাদের হত্যা কর না’। বদরের বন্দীদের সহজ শর্তে মুক্তি দেওয়া হল। তাদের অনেকেই ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হলেন।

ইতিহাসের এক অনন্য বিজয় হয়েছিল বদর যুদ্ধে। এই যুদ্ধে বন্দী কুরাইশদের প্রতি আমার রাসূল (সাঃ) যে আদর্শ ব্যবহার দেখিয়েছিলেন তা ইতিহাসে বিরল। আমার রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশে মদিনায় আনসার এবং মুহাজিরগণ সাধ্যানুসারে বন্দীদেরকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে আপন আপন আপন গৃহে স্থান

দিলেন। আত্নীয়ের মত তাদের সাথে ব্যবহার করলেন। বন্দীদের উক্তি ছিল, ‘মদিনাবাসীদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হোক। তারা আমাদেরকে উটে চড়তে দিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে গেছে, নিজেরা শুষ্ক খেজুর খেয়ে আমাদেরকে রুটি খেতে দিয়েছে’। যারা ইসলামে যুদ্ধের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেন তাদের

জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত আয়াতটিই যথেষ্ট, ‘সম্মানিত মাস ও তাদের যুদ্ধ করা সম্পর্কে তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি তাদের বলে দাও এই মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ করা অনেক বড় গুণাহ, (কিন্তু আল্লাহর কাছে এর চাইতেও বড় গুনাহ), আল্লাহর পথ থেকে মানুষদের ফিরিয়ে রাখা, আল্লাহকে অস্বীকার

করা, খানায়ে কাবার দিকে যাওয়ার পথ রোধ করা। সেখানকার অধিবাসীদের সেখান থেকে বের কর করে দেওয়া’। সূরা বাকারা২১৭।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),

রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধঅসুখ