জানালার পাশে অপেক্ষায় থাকা মুখ

সুস্মিতা চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কামিনী ফুলের গন্ধটা নাকে এসে লাগতেই ছায়াঘেরা ইটের রাস্তা, জমিদার শ্রীমন্ত পালের পুকুরে শান বাঁধানো দুটি বড় ঘাট আর তার পাশে সাদা রঙের একটি দোতলা বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। বাড়ির একতলায় একটি কক্ষে বড় জানালার পাশে একটি হাতলওয়ালা চেয়ার। ওখানে বসেই সকাল সন্ধ্যা রোগী দেখতেন আমার বাবা, ডাক্তার অসীম নন্দী। আগামীকাল বাবার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। আঠারো নভেম্বর ২০১২ তে একজন সফল চিকিৎসক বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। ক্যালেন্ডারে তারিখটি কালো কালি নিয়ে দাগানো। বাবাকে মনে পড়ে। মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি।
ষাটের দশকে যে কয়জন চিকিৎসক, পেশাগত কাজের পাশাপাশি গদ্যে-পদ্যে, গানে-কবিতায়, নাটকে-অভিনয়ে ভূমিকা রেখেছেন, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন সকলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে, তাঁদের দিকে যদি ফিরে তাকাতে হয়, তাহলে অনেকের ভিড়ে ডা. অসীম নন্দীর নামও এসে পড়ে। বিজ্ঞজনদের মুখে তাই এখনো তাঁর সম্পর্কে শুনতে পাই।
সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে চৌধুরী হাটেই চিকিৎসা পেশাকে ব্রত হিসেবে নেন ডা. অসীম নন্দী। সে সময়ে অনেক চিকিৎসকের ভিড়ে এলাকাবাসী ও দূর দূরান্তের রোগীদের আস্থা অর্জন করেন। আজকের মতো গলির মোড়ে মোড়ে ডায়াগনোসিস সেন্টার ছিল না তখন। রোগীর নাড়ি টিপে, জিভ দেখে, পেট টিপেই রোগের চিকিৎসা। হাটহাজারীর এম পি ওয়াহিদুল আলমের পরিবার থেকে শুরু করে নাজিরহাট, রাউজান, রাঙামাটি, সাতকানিয়া, দোহাজারী, চকরিয়া থেকে রোগী আসতো প্রায়। চেম্বারের বাইরে রোগীদের গাড়ির ভিড় মানুষের যাতায়াতের পথে বাধা তৈরি করতো। তাই সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম হাটহাজারীর এম পি নির্বাচিত হওয়ার পর ইটের রাস্তাটা দুপাশে আরো কিছুদূর বাড়িয়ে পাকা করে দেন। এতে গ্রামে বাবার জনপ্রিয়তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
শুরুর দিকে মাঝে মাঝে রোগীবাড়ি থেকে মধ্যরাতে ফিরতেন। কিন্তু ক্লান্ত হতে দেখিনি কখনো। তারপরই বাবা কে দেখেছি ক্যাসেট প্লেয়ার ছেড়ে দিয়ে হেমন্ত, মান্না, শচীন বা কিশোর কুমারের সাথে গলা মেলাতে। কামিনী ফুলগাছটি বাবার সঙ্গী হয়ে থাকতো সারারাত, কদম গাছটিও। এই লোকটাকে নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের শেষ ছিল না। সুরের পাগল এই মানুষটা হারমোনিয়াম হাতে পেলেই একের পর এক গান গেয়ে যেতেন। রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্তের কবিতা পাঠ করে শুরু হতো দিন। সুগন্ধি তেল, দামী পারফিউম, বিদেশী সাবান, নিত্য নতুন রুমাল, শার্ট আর পাতলা স্যান্ডেল পরা সৌখিন এ মানুষটির চলায়-বলায় ষাটের দশকের নায়ক দেবানন্দ, শশী কাপুর, সৌমিত্র বা উত্তম কুমারকে দেখতাম। আসলে সবার কাছেই নিজের বাবার সংজ্ঞা হয়তো আমার মতোই।
কত কথা মনে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁরা, আমাদের ঘরে নিত্য যাওয়া-আসা ছিলো তাঁদের অনেকের। শিল্পী মলয় ঘোষ দস্তিদার, সুরকার সত্য সাহা, কথাশিল্পী সুচরিত চৌধুরী, শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, এম. এন. আক্তার, ডাক্তার রবীন্দ্রলাল বণিক, ভাস্কর অলক রায়, উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী ওস্তাদ শওকত আলী সহ আরো অনেকেই বাবার ভালো বন্ধু ছিলেন। আনন্দ আড্ডায় তাঁদের সময় কাটতো কখনো চেম্বারে, কখনো বাড়িতে। মাঝরাতের আড্ডাগুলো গ্রামের নীরবতা ভেঙে দিতো কখনো কখনো। পাখিরাও তখন নীরব থাকতো। ওস্তাদ শওকত আলীর গানের সঙ্গে গলা মেলাতে গিয়ে সুরপাগল এই লোকগুলো চলে যেতেন অন্য এক জগতে। ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে উঠতো সব্যসাচীর কণ্ঠে নজরুলের কবিতা। বন্ধুদের মধ্যেই কেউবা আবৃত্তি করতেন রবি ঠাকুরের কবিতা, ‘কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা, অমাবস্যার কারা’। শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব কে দেখেছি মান্না দে এর আধুনিক গান ‘কতদিন দেখিনি তোমায়’ গাইতে। অবাক হতাম। ভাবতাম, সুরের দখলদার সেই মানুষগুলোর জন্ম চট্টগ্রামের মাটিতে। কত সমৃদ্ধ এই মাটি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবি, চোখের সামনে দেখা এই মানুষগুলোর কথা মনে পড়লে। মেঝেতে পাটি বিছানো। ওখানেই সুরের জলসা। শৈশব কৈশোরের স্মৃতিতে এইসব চিত্রকল্প এখনো অনেক উজ্জ্বল।
শুনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী বাবাকে বাড়িতে না পেয়ে আমার এক কাকুকে হত্যা করে। যুদ্ধের সময়কার বাবার মানসিক অবস্থা, বেদনাবোধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী জীবনসংগ্রামের গল্পগুলো ঠাকুরমার মুখে শুনেছি বহুবার। আমার মা সারাজীবনের তাঁর সংগ্রামের সঙ্গী। বাবার আনন্দ বেদনা, সফলতা এবং ব্যর্থতার কাহিনি মার কাছেও শুনেছি বহুবার। ডায়েরিগুলো বাবার সাহিত্যচর্চা, কাব্যচর্চার সাক্ষী হয়ে এখনো আছে আমাদের কাছে। চিত্রনায়িকা কবরীর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতিটুকু থাক’ এ আমাদের বাড়ির কথা, বিশেষ করে বাবার কথা লেখা আছে কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে। সহজ, সরল, প্রাণবন্ত এই মানুষটির সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, কখনো ভোলেননি, যেমন ভোলেননি সেকালের মীনা পাল বা পরবর্তীকালের তারকা কবরী। বাবাকে নিয়ে কখনো লিখিনি। বাবা ছিলেন আমাদের বন্ধুর মতো। তাই তুমি করে বলতাম। বাবা চলে যাওয়ার দশ বছর পরও দেখি, বন্ধুদের প্রতীক্ষায় জানালায় একটি মুখ। এই মুখ আর কারো নয়, আমার বাবার। আরো অনেক স্মৃতি। মনে পড়ে, খুব বেশি মনে পড়ে। বাবার ছবিটা শোকবার্তায় সাদা-কালো বটে, কিন্তু স্মৃতিতে এখনও রঙিন।
লেখক : মানবাধিকার কর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকালের আয়না
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল