কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ফেসবুকে আমাদের উপস্থিতি একেবারেই দুর্বল।’ গত সোমবারে অনুষ্ঠিত এই সভায় তিনি আরও বলেন, ‘অপপ্রচারের কাউন্টার দিতে হবে। মিথ্যাচার ও বিষোদগারের জবাব দিতে হবে।’ একনাগাড়ে চৌদ্দ বছর ক্ষমতায় থেকে আরেকটি নির্বাচনের বছরখানেক আগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে জানিয়ে তিনি দলের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এগুলোর জবাব আপনারা দেবেন না?’ টক শো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টক শোতে অনেকই যান। মাঝেমধ্যে সময় পেলে শুনি। কাউন্টারটা যথাযথ না হলে কাউন্টার করে লাভ নাই। কেউ কেউ আছেন চৌকস কাউকে আমাদের প্রতিপক্ষ থেকে বেছে নেন, আমাদের এখান থেকে দুর্বল একজনকে দাঁড় করান। এটাও কিন্তু চতুরতার সঙ্গে করা হয়।’
ওবায়দুল কাদেরের অভিযোগ মিথ্যে নয়। কিন্তু অবাক হচ্ছি এত দেরিতে কেন তিনি এই বাস্তবতা অনুধাবন করলেন। গত চৌদ্দ বছর তিনি ও দলের দায়িত্বশীলরা কী করেছিলেন? এটি এখন বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অপপ্রচার, মিথ্যা প্রচার, গুজব সৃষ্টি করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অরাজকতা সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি যতটা পারঙ্গম তা ঠেকাতে বা প্রকৃত সত্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা তারচেয়েও বেশি। যে আওয়ামী লীগ সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ঘোষণা দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুম যুগের সৃষ্টি করেছে সে প্রযুক্তি বা তথ্যপ্রবাহের সুবিধা বেশি ভোগ করেছে আওয়ামীবিরোধী শক্তি তথা প্রতিক্রিয়াশীল, সামপ্রদায়িক, উগ্র ও জঙ্গিগোষ্ঠী। এই অপশক্তি ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যতটা সক্রিয় ঠিক ততটাই নিষ্‌ক্িরয় আওয়ামী লীগের প্রচার সেল ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা।
এই যে আজকালের মধ্যেই গুজব ছড়ানো হলো, ব্যাংকে তারল্যসংকট দেখা দিয়েছে। এই গুজবে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে দলে দলে ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে ঘরে রেখে দিচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। গুজব ছড়ানো হলো, জমি অনাবাদি রাখলে সরকার তা খাস করে নেবে। একেবারে সামপ্রতিক এই মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কেউ প্রতিবাদ করে প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরেছেন এমন অন্তত আমি দেখিনি। গুজবে বিভ্রান্ত না হতে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিতে হয়েছে। সরকার বিবৃতি দিয়েছে তা প্রসংশনীয় কারণ সরকারের দায়িত্বই হচ্ছে জনগণের কাছে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা। তবে এক্ষেত্রে সরকারি দলের লোকজন যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকতেন তাহলে কম মানুষ বিভ্রান্ত হতো।
দেরিতে হলেও অনুধাবন করার জন্য ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। একবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হলেও ভালো। তবে দেরিটা এত বেশি হয়ে গেছে যে, তার জন্য অনেক দাম দিতে হবে সন্দেহ নেই। পিনাকী ভট্টাচার্য প্রতিদিন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেই যাচ্ছেন তাকে কেউ কাউন্টার করছেন কিনা এখনো জানি না। খলিল, ইলিয়াসরা তো প্রতিদিনই এই সরকারকে ফেলে দিচ্ছেন। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানরা প্রকাশ্যেই সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে প্রচণ্ড আপত্তিকর বক্তব্য রাখছেন যার অধিকাংশই দেশদ্রোহিতার শামিল। এসব বন্ধ করারও চেষ্টা আছে কিনা সরকারের অথবা বন্ধ করতে না পারলেও অভিযোগ খণ্ডন ও তার পাল্টা অভিযোগ করার ইচ্ছে আছে কিনা বুঝতে পারছি না।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার নতুন নয়। জন্মের পর থেকে এই দল নানা প্রকার অপপ্রচারের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানিরা বলতো ভারতের ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচিকে ভারতের করা কর্মসূচি বলে প্রচার করা হতো। দেশ স্বাধীন হলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে গলা মিলিয়ে চৈনিক বামরাও আওয়ামী লীগকে রুশ-ভারতের দালাল বলতো। ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে আওয়ামী লীগকে ধর্মবিরোধী দল বলে প্রচার করা হতো। অবশ্য এই অভিযোগগুলো এখনো করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবসময় ভালো জবাব দিতে পারেনি। এদের আত্মরক্ষা করতে করতে সময় কেটে গেছে। এরা কখনো অফেন্সিভ খেলতে পারেনি। ডিফেন্সিভই খেলে যেতে হয়েছে। বরং কিছু ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে। বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে দাড়িটুপিওলা কদাচিত দেখা গেলেও আওয়ামী লীগে দাড়িটুপি ছাড়া নেতার দেখা পাওয়া দুষ্কর।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের মুখপাত্র, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো নয় তা বলাই বাহুল্য। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যেই তা পরিষ্কার হয়েছে। সরকারের অনেক ভালো কাজ, যে কাজগুলো অত্যন্ত প্রশংসনীয় সেসব নিয়ে প্রচারের ক্ষেত্রেও নেতাকর্মীদের খুব আগ্রহ নেই। আমি যেসব নেতাদের চিনি তাদের হাজার হাজার এমনকি অনেকের লাখ লাখ ফলোয়ার আছে। তাদের একটি পোস্টে হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট পড়ে। তারাও কোনো গঠন ও উদ্দীপনামূলক কথা লেখেন না। কোন মিটিংয়ে যাচ্ছেন, বক্তৃতা করছেন, টিভিতে টক শোতে যাচ্ছেন আর স্ত্রী-সন্তানদের জন্মদিন, সন্তানের পরীক্ষা ও উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রার পোস্টই শুধু নজরে পড়ে। আর তাদের হাজার হাজার ভক্তরা ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘সহমত ভাই’ ইত্যাদি ছাড়া অন্য বাক্য লেখেন না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে-পরে আমার লেখা যা পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের পক্ষেই গেছে এবং নানা সময়ে সামপ্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির বিপক্ষে লেখাও এই দলের নেতাকর্মীদের মনোযোগ পায়নি। তাদের পক্ষে যাবে এমন লেখাও তারা শেয়ার করে অধিক পাঠককে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেননি।
আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে আবদুল গাফফার চৌধুরী নিরলসভাবে লিখেছেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের তেমন কর্মসূচি পালন করার খবর পাইনি। ঠিক একই আচরণের শিকার হয়েছেন জনকণ্ঠের সাবেক সম্পাদক তোয়াব খান, যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব ছিলেন। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করার পেছনে তোয়াব খান সম্পাদিত জনকণ্ঠের ভূমিকা তুলনারহিত। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব জানে কিনা জানি না। না জানলে তাদের জানানোর দায়িত্বও কেউ পালন করেনি।
আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের কিছু নেতাকর্মী আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাদের অনেক আশা-নিরাশার কথা আমাকে বলেন। তারা দলের মঙ্গল চান। দলের অনেকের আদর্শচ্যুতি, দলবিরোধী কর্মকাণ্ড, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দলে বহিরাগতদের আধিপত্য নিয়ে কথা বলেন। আমি বুঝতে পারি তারা দলে কোণঠাসা হয়ে আছেন। এদের অনেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও আমার এ ধরনের লেখায় তারা লাইক-কমেন্ট করেন না বড়ভাইদের রোষানলে পড়ার ভয়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক খুব জনপ্রিয়। সে ফেসবুক এখন বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবিরোধী এবং দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে পোস্ট দিলে হয় তা মুছে দেওয়া হয় নতুবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ‘রেসট্রিকটেড’ করে দেওয়া হয়। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, পিনাকী ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে কিছু পোস্ট করলেই কয়েকঘন্টার মধ্যে অ্যকাউন্ট সাসপেন্ড করে রাখা হচ্ছে। এই অভিযোগ অনেকে ফেসবুকেও লিখে থাকেন। অনেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকেও অবহিত করেছেন কিন্তু তারা কোনো সুফল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। আমার নিজের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটেছে। আফগানিস্তানে পার্কে প্রবেশে নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার খবরটি শেয়ার করেছিলাম মন্তব্যসহ। পোস্টটি স্লো করে দিলে আমি দ্বিতীয়বার দিয়েছিলাম, সেক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। অথচ সামপ্রদায়িক উসকানিমূলক পোস্টের কারণে বাংলাদেশে অনেকবার সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সেসব নিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়নি এবং দোষীদের অ্যাকাউন্ট ব্লকও করেনি। এইসব খবরকি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানে না? জানে কিন্তু তারা তৎপর নয়। তাদের সব আয়োজন লোক দেখানো এবং ওপরমহলকে খুশি করার চেষ্টা মাত্র।
শুনেছিলাম বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একদল দক্ষ প্রযুক্তিবিদের তত্ত্বাবধানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা ক্ষেত্রে সরকারের প্রচার এবং সরকারবিরোধী অপপ্রচারের কাউন্টার দেওয়ার লক্ষ্যে শত শত কর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এতদিন কী করেছেন তা বোধগম্য নয়। তবে তারা যে খুব একটা সফল হননি তা দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে বেশ বোঝা গেল।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে মাঠে নেমে গেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আওয়ামী লীগও ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিদেশি দূতাবাসগুলোতে আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দের। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা সুযোগ পেলেই সামনের নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করে দিয়েছেন। কেউ কেউ বলতে না চাইলে আমাদের সাংবাদিকরা একপ্রকার জোর করে বলিয়ে নিচ্ছেন। মহামারিকাল মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে উৎরে যেতে পারলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সরকারকে ভোগাবে বলেই মনে হয়। সরকারের সাফল্যের তালিকায় শীর্ষে থাকা রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত। ডলারের কাছে মার খাচ্ছে দেশের টাকা। জিনিসপত্রের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চাপ তৈরি করেছে। টিসিবি ও ন্যায্যমূল্যের ট্রাকের পেছনে ক্রেতার সারি দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে। দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকের জীবনমান দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ,গ্যাসসহ সবধরনের তেলের দাম বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার জনগণকে সতর্ক করছেন। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আগামী বছর বিশ্ব মন্দাবস্থায় পড়বে বলে আগাম বার্তা দিয়েছে। আরও অন্তত ৪৫টি দেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে আছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বিশ্বের তো নেই-ই বাংলাদেশের জন্যও কোনো সুখবর আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে। সে অবস্থায় যে নির্বাচনটি হবে তাতে পার পেয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের জন্য খুব সহজ হবে না। জনগণকে তখন পর্যন্ত শান্ত রাখতে পারবে কিনা সরকার তা দলের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।
শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দল ও দেশকে এতদূর এনেছেন। আগামীর সঙ্কটও তিনি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হয়। এজন্য দরকার দল ও সরকারের প্রচারসেলকে শক্তিশালী করা। বাদবাকি কী করা দরকার তা তো ওবায়দুল কাদের বলেই দিয়েছেন।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজানালার পাশে অপেক্ষায় থাকা মুখ
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থনীতির গতিশীলতার জন্য শিল্পোৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে