অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য শিল্পোৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে

নেছার আহমদ | বৃহস্পতিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কোভিড-১৯ মহামারী আকারে কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং লকডাউনে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগে এবং সময়োপযোগী বাস্তবভিত্তিক দূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে কঠিন এ পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছে। বর্তমান সময়ে নতুনভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ ধরে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডলার সংকট এবং উন্নত বিশ্বের সকল দেশই একপ্রকার অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে।
বর্তমান এ বিশ্ব পরিস্থিতিতে শিল্পের উৎপাদন এবং শিল্পসমূহকে গতিশীল রাখা এবং বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা খুবই প্রয়োজন। রপ্তানিনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ভোগ্যপণ্য নির্ভর, কৃষি নির্ভর, শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। শিল্প উৎপাদন যদি বাধাগ্রস্থ হয় তবে শ্রমিকরা চাকরি হারাবে, রপ্তানি কমে যাবে, ডলার সংকট প্রকটতর হবে। এতে দেশের অর্থনীতি হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হলে এবং নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন চালানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ খুবই প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মতে, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি বন্ধ রাখায় বর্তমানে ৫৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ৩ হাজার ৯৩১ মেগাওয়াট। দেশে বর্তমানে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৫২টি, যার উৎপাদন ক্ষমতা ৭ হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও জ্বালানি তেলের অভাবে বন্ধ রয়েছে ১১ শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক কেন্দ্র।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পেলে দেশের সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা সম্ভব এবং এতে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতো। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে গড়ে ৯ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের মতো।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের আগে দেশীয় গ্যাসের পাশাপাশি ১ হাজার এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করে প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে শিল্প কারখানা ও আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করা হতো। বর্তমানে গ্যাসের অভাবে দেশের অনেক শিল্পোৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সরকার জরুরিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা গুরুত্ব দিয়েছে এবং এখাতে যেভাবে বরাদ্দ দিয়েছে সে হিসাবে জ্বালানির বিষয়টা তেমনভাবে বিবেচনায় আনেনি এবং জ্বালানির বিষয়টা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। বিগত ২০ বছরের মধ্যে কোনো বারেই গ্যাস উত্তোলনের জন্য একটির বেশি কূপ খনন হয়নি। যা হয়েছে তা কিছুটা হলেও গ্যাস আমরা পাচ্ছি। ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সত্ত্বেও সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানী কার্যক্রম নেয়া হয়নি। যা ছিল খুবই জরুরি। পেট্রোবাংলাও ২০১৬-১৭ সালে যতটুকু উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিল তা তারা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত গ্যাসের সদ্ব্যবহারের অভাবের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি স্বনির্ভরতার পথ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গতিতে এগুতে পারেনি। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ ৭.২ মিলিয়ন টন (৭২ লাখ টন) এলএনজি সক্ষমতার জন্য ৪ মিলিয়ন (৪০ লাখ টন) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে। যা সঠিক ছিল না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাংলাদেশ বর্তমানে বেশি মূল্যে কয়লা কিনছে, গ্যাসের ক্ষেত্রেও যেখানে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি চুক্তি রয়েছে, সেখান থেকে গ্যাস কেনা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সরকারের যত পরিকল্পনা হয়েছে, সেগুলোতে নিজস্ব ক্ষেত্র হতে গ্যাস উৎপাদনের চেয়ে আমদানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সর্বদিকে বিবেচনা করলে সরকার জ্বালানি খাত উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বললে চলে। ফলে আজ জ্বালানি খাত বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এখন জরুরি হলো ধীরে ধীরে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা। এতে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মনির্ভরতা। যতটুকু প্রয়োজন এবং সম্ভব তার চেষ্টা করা দেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য খুবই জরুরি। বর্তমান বিশ্ববাজারের স্বাভাবিক সময়ে গ্যাসের দাম বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চাপ। অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুতের যোগান নিশ্চিত করার জন্য কয়লা ভিত্তিক সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ করে উৎপাদনে যাওয়া জরুরি। সরকার বিদেশী বিনিয়োগের কথা বলেছে। কিন্তু বিশেজ্ঞদের তথ্য মতে গত দশ বছরে গ্যাস অনুসন্ধানে তেমন বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। যা এসেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে।
এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমান সময়ে ভূমিতে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের সবগুলো পথ অন্বেষণের উদ্যোগ দ্রুততম সময়ে হাতে নেওয়া আবশ্যক।
সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। মিরসরাইএ প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শিল্প জোন সবচেয়ে বড় অর্থনেতিক অঞ্চল। এখানে বিদেশী ও দেশী বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছে, অনেকে উৎপাদনের জন্য অপেক্ষামান। শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা খুবই জরুরি। এছাড়া আধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও কোয়ালিটি বিদ্যুতের জন্য শিল্প কারখানায় ক্যাপটিভে গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিগত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদেরকে আশ্বাস দিলেও নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে সব সময় আটকে যায়। যা দেশের উন্নয়নের জন্য এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতার জন্য কোনভাবেই সুখকর নয়। জ্বালানি সেক্টর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এখানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা গেছে সকল নির্দেশনা এবং সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে মতামতকে অগ্রাহ্য করে উপর হতে চাপিয়ে দেয়া হয়। ফলে গ্যাস সেক্টরের স্বাভাবিক অগ্রগতি সব সময় থমকে যায়। বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নিজ হাতে রেখেছেন যাতে এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ ও গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলা হতে সঠিক পরামর্শ এবং পরিকল্পনা সব সময় দেওয়া হয় না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে জ্বালানি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অবহেলিত হয়েছে। বর্তমানে গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে গেছে। অনেকে শিল্প কারখানা বন্ধ রেখেছে। শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনে আভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়িয়ে হলেও গ্যাস আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
স্বাভাবিকভাবে সরকারের পক্ষ হতে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদেরকে জ্বালানি সেক্টর হতে যেই প্রতিশ্রুতি দেয়া হোক না কেন তা কোনো সময় রক্ষিত হয়নি। স্বাভাবিকভাবে গ্যাস সেক্টর বিশেষ করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. সাধারণ মানুষ এবং উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক কঠিন সময়ে আশা করি জ্বালানি খাতকে শক্তিশালী করার জন্য উদ্যোক্তা ও শিল্পে বিনিয়োগকারিদের নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করে তাঁদের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। বিশ্বের সকল উন্নত দেশে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারাই দেশের উন্নয়নের সহযোগী এবং মূল চালিকা শক্তি।
আমাদের দেশেও যদি শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্প বিপ্লব এবং কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব ঘটনো যায় তবে উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ে আমাদের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে।
বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশের মানুষই শতাব্দীর সবচেয়ে কষ্টকর সময় অতিক্রম করছে। কেউ কি কখনো শুনেছে, জার্মানি লোডশেডিং করছে? পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ফ্রান্সে মিছিল হচ্ছে? ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতিসহ জ্বালানি সংকটে ভুগছে?
সুতরাং বাস্তবতা ও প্রকৃত বিশ্ব পরিস্থিতি সামনে রেখে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। জ্বালানি সেক্টরকে সময়োপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।
আমরা পারব, আমাদের মাঝে রয়েছে আত্মবিশ্বাস। আমাদের রয়েছে বিশ কোটি মানুষের চল্লিশ কোটি কর্মীর হাত। আমরা কোনো সময়ই হতাশ নই। বাঙালি বীরের জাতি। সকল প্রতিকূল অবস্থাকে জয় করার শক্তি তাদের রয়েছে। জয় আমাদের হবেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল
পরবর্তী নিবন্ধমেহজাবীন-নিশোকে আদালতে হাজির হতে সমন