জাত

আজহার মাহমুদ | সোমবার , ১৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ

সাদিয়ার সাথে রাজনের প্রেম কীভাবে হয়েছে সেটা তারা দুজনই জানে না। জানে না বলতে এটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। এখনও তারা এটা ভেবে হাসে। ইন্টারেই তাদের দুজনের প্রেম হয়েছিলো। এই সমযটা তাদের জীবনের সেরা সময়ও বলা যায়।

এতোদিন একসাথে পড়াশোনা করলেও ভার্সিটিতে এসে দুজন দুই ক্যাম্পাসের বাসিন্দা হয়ে গেল। রাজন জগন্নাথে আর সাদিয়া জাহাঙ্গির নগরে। ভার্সিটিতে যদি একসঙ্গে পড়তে পারতো তাহলে বেশ খুশি হতো দুজন। চেষ্টাও করেছে দুজনে। অথচ সৃষ্টিকর্তার কি অদ্ভুত খেলা, রাজন শুধুমাত্র জগন্নাথে আর সাদিয়া শুধুমাত্র জাহাঙ্গীর নগরেই সুযোগ পেয়েছে। কোনোভাবে কোনো একটা সাবজেক্টও যদি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পেত দুজন তাহলেও তাদের পড়তে আপত্তি ছিলো না। তবে সেই ভাগ্য তাদের হলো না।

তবুও তাদের খুব বেশি আফসোস নাই। একই শহরে দুজন থাকবে। অন্তত একটু হলেও দেখা তো হবে। সাদিয়ার বাবা আবার নামকরা ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে তার বাবাকে এক নামে সবাই চিনে। সেই সুবাধে সাদিয়ার আর্থিক অনটন ছিলো না বললেই চলে। কিন্তু রাজনের বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। সেলুনে চুল কাটে তার বাবা। অনেক সংগ্রাম করে, রক্তকে পানি করে রাজনকে এতোদূর এনেছে তার নাপিত বাবা।

রাজন হলে থাকলেও তার খরচ চালানো শুরুতে অনেকটা কঠিন। ভার্সিটিতে পড়লে টিউশনের অভাব হবে না শুনলেও এখানে এসে টিউশন পেতেও রাজনের মাস পেরিয়ে গেছে। কোনো রকমে চলা রাজন বড় লোকের মেয়ে সাদিয়াকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে এতে সমস্যা ছিলো না। তাদের সমস্যাটা অন্য জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে। সমস্যাটা ধর্মের, সমস্যাটা জাতের।

রাজন আর সাদিয়া এনিয়ে প্রায়ই ঝগড়া করে। রাজন স্বপ্নেও বিশ্বাস করে না সাদিয়ার সাথে তার বিয়ে হবে। কিন্ত সাদিয়া রাজনের এই ধারণটা পাল্টানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে। এভাবে তারা প্রেম করতে করতে অনার্সের শেষ বর্ষে চলে এসেছে। এরমধ্যে সাদিয়ার জন্য তারা বাবা এক ছেলেও ঠিক করে রেখেছে।

অন্যদিকে রাজনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন রাজন নিজের খরচ চালিয়ে আরও ৫/৭ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠায় নিয়মিত। এতেই রাজনের নাপিত বাবা মহাখুশি। রাজনের মা ছোট বেলায় মারা গেছে। রাজন আর তার বাবা দুজন। তার বাবা রাজনকে একাই মানুষ করেছে। রাজনের স্বপ্ন তার বাবাকে একটা দামি সেলুনের দোকান করে দিবে। যেখানে সব আধুনিক জিনিসপত্র থাকবে। তার বাবা সেলুনের মালিক হিসেবে ক্যাশে বসে থাকবে। এই স্বপ্ন রাজনের অনেক পুরাতন।

রাজন আর সাদিয়ার দেখা হলো অনেকদিন পর। সাদিয়া রাজনকে তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য নিয়ে যাবে আজ। রাজন কোনো মতেই যেতে চাচ্ছে না। শেষমেষ রাজি হয়েছে।

সাদিয়ার বাসায় প্রবেশ করতেই সাদিয়ার বাবাকে দেখতে পেল রাজন। প্রথম দেখাতেই রাজন সাদিয়ার বাবাকে সম্মানার্থে নমস্কার জানালো।

সাদিয়ার বাবা চমকিত গলায় বললো, তুমি কি হিন্দু?

রাজন বিনয়ের সুরে বললো, জ্বি আংকেল।

সাদিয়ার বাবার প্রশ্ন, তা তোমার বাবা কি করেন?

রাজন উত্তরে বললো, আমার বাবা চুল কাটেন।

সাদিয়ার বাবা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, নাপিতের ছেলে তুমি তাহলে। তা তোমার বাবা কোথায় চুল কাটেন?

রাজন বললো, চট্টগ্রামের ওয়ার্লেস কলোনীতে।

সাদিয়ার বাবা রাজনকে চা খেয়ে যেতে বলেই উঠে চলে গেলেন। এরপর সাদিয়া আসলো। রাজনকে চানাস্তা দিলো। আর কি বলেছে জিজ্ঞেস করলো।

রাজন সাদিয়ার কথার জবাব না দিয়ে শুধু চা খেয়েই বিদায় নিলো।

সাদিয়াকে সেদিনই তার বাবা ভীষণ রকমের বকা দিলো। সাদিয়া তার বাবার কাছ থেকে জীবনে ‘না’ শুনেনি। অথচ আজ তার বাবার রাগের রূপটাও দেখে ফেললো। সাদিয়াকে সাবধান করে দিলো রাজনের সাথে যেন আর যোগাযোগ না করে।

সাদিয়ার বাবা চাইলে আরও কঠোর হতে পারতো। তবে মেয়েকে বকা দিয়েছেন এতেই কাজ হবে মনে করেছেন তিনি। তবে এটুকুতেই তিনি শেষ রাখেননি। রাজনের বাবার কাছে লোক পাঠিয়ে বেশ ভালো ভাবেই অপমান অপদস্থ করেছেন। শুধু কি লোক? পুলিশও গিয়েছিলো।

রাজনের বাবা তার জীবনে যত সম্মান অর্জন করেছে সব যেন একদিনেই মাটি করে দিলো। রাজন এই কথা শুনে আরও ভীষণ কষ্ট পেল। সাদিয়ার সাথে দেখা করে রাজন এই কথা যখন বলছিলো সাদিয়া তখন পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলো।

রাজন এখন আরেক কঠিন পরীক্ষায় পড়ে। সাদিয়াকে নিয়ে পালাবে, নাকি তার বৃদ্ধ বাবাবে একটু সুখ দিবে। কারণ সাদিয়াকে নিয়ে পালানোর সাথে সাথেই তার বাবাকে সাদিয়ার বাবার লোকজন অপমানঅপদস্থ করেই ছাড়বে না শুধু, হয়রানি করবে, আঘাতও করবে।

একদিকে বাবা, অন্যদিকে ভালোবাসা। আবার তাদের বড় বাধা ধর্ম। রাজন শেষ পর্যন্ত তার ছয় বছরের ভালোবাসার মানুষটার সাথে পালিয়ে যেতে রাজি হলো না। হঠাৎ রাজনের মনে পড়লো তার বাবার কথা। তার মা ছাড়া তাকে তার বাবা দীর্ঘ ২২/২৩ বছর কীভাবে বড় করেছে সেসব স্মৃতি মনে পড়ছে। রাজন তার বাবার এতোদিনের ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দেখতে পারেনি।

সাদিয়াকে ফিরিয়ে দিলো রাজন।

এরপর রাজন একটা ভালো চাকরিও পেয়ে যায়। প্রায় মাসখানেক সাদিয়ার সাথে যোগাযোগ নাই। রাজন সাদিয়াকে ছাড়া যে ভালো নেই সেটা রাজনের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। আরও মাসখানেক পর রাজন জানতে পারে সাদিয়া আত্মহত্যা করেছে। সাদিয়ার বাবা যদিও এই খবরটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো।

কিন্তু সত্যাটা সবাই জেনে গেছে। রাজনের জন্যই আত্মহত্যা করেছে। এরপর থেকে চারদিকে রাজনকে নিয়ে বুলিং হতে থাকলো। রাজন লুজার, কাপুরুষ, ধোঁকাবাজ ইত্যাদি।

রাজনের এসব কথায় যেমন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, তেমনি সাদিয়াকে সেদিন ফিরিয়ে দেওয়াটার স্মৃতিটাও তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছে। সাদিয়ার মৃত্যুর দু’দিন পরেই রাজনকে আর খুঁেজ পাওয়া যায়নি। রাজনের বাবা মিসিং ডায়রি করেছে, সাদিয়ার বাবার নামে মামলাও করেছে।

তার ঠিক ১৫ দিন পর একটা লাশ ভেসে উঠে কর্ণফুলী নদীর তীরে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধবিজ্ঞান মানবিক, মানববিদ্যার একটি শাখা