জাতীয় ইতিহাসের অনন্য ভাষ্যকার গাফ্‌ফার চৌধুরীর মহাপ্রস্থান

| শনিবার , ২১ মে, ২০২২ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

জাতি তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান। তিনি হলেন অমর একুশের গানের স্রষ্টা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তিনি বুধবার ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটে লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তাঁর একুশের অমর সেই গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসীম সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। লেখনির মাধ্যমে তিনি আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। তিনি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একজন অনন্য ভাষ্যকার। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে যে সংগীতটি রচনা করেছেন, সেটি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ সময় তিনি কলকাতার আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায়ও কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন।
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্টজনরা। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারাল। আরেক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার মেধা-কর্ম ও লেখনিতে এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন। তিনি বাঙালির অসামপ্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি জড়িত। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম যিনি তার লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় তার লেখনির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বিদেশে অবস্থানকালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে লেখালেখি করেছেন।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন লিখলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন একজন সামাজিক মনস্ক মানুষ। তিনি সব সময় সমাজের সবকিছু নিয়ে কথা বলতেন। তার সেই সব লেখা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অনেক সময় পথনির্দেশনা দিয়েছেন। আমি মনে করি, তিনি লন্ডনে বসবাস করেও যেভাবে কথা বলতেন সেটাও আমাদের কাছে দিগন্ত রেখার মতো। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ভালোবাসতেন দেশ, মাটি ও মানুষকে। এ জন্য লন্ডনে বসেও তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার লেখায় বারবার সে কথাই উঠে এসেছে। জাতির যে কোনো ক্রান্তিতে আমরা দেখেছি তার কলম চলছে। তিনি বলছেন কি করা উচিত, কি করলে জাতির মঙ্গল হবে, দেশের মঙ্গল হবে। নিজের কথাটি বলার জন্য তিনি কখনোই পিছ-পা হননি। জাতির মুক্তি চেতনায় তিনি আরও ব্রতী হয়েছিলেন তার কর্মে। আজকে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আমাদের মাঝে নেই। তার জায়গাটি আমাদের জন্য বড় শূন্যতা তৈরি করল। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনেক কিছু। যা আগামীতেও আমাদের সঠিক পথের অনুসন্ধানে আলো দেখাবে।
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী শুধু সংবাদপত্রের কলাম নয়, তিনি রচনা করেছেন বেশ কিছু স্মরণীয় লেখা। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও স্মৃতিকথা। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এরপর অর্জন করেন একুশে পদক ও দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার।
আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাঙালি জাতি একজন মহান দেশপ্রেমিক ও গুণী ব্যক্তিকে হারালো। আমরা হারালাম আমাদের কালের অন্যতম সেরা সাহসী লেখককে। আমরা মনে করি, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী শারীরিকভাবে আমাদের সঙ্গে না থাকলেও তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আমরা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন : সাংবাদিক ও সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ
পরবর্তী নিবন্ধঅসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি দেশের সাধারণ মানুষ