জন্মাষ্টমীর তত্ত্ব ও তাৎপর্য

মনোজ কুমার দেব | বৃহস্পতিবার , ১৮ আগস্ট, ২০২২ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান ও অবতার আলাদা কোনো সত্তা নয়। এগুলো সর্বশক্তিমান স্রষ্টার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ব্রহ্মরূপে স্রষ্টা নিরাকার ও নির্গুণ। আবার যখন ব্রহ্ম জীব ও জগতের উপর প্রভুত্ব করেন তখন তিনি ঈশ্বর। নিরাকার ঈশ্বর যখন ভক্তের ডাকে সাকাররূপে আবির্ভূত হন তখন তিনি ভগবান। বৈদিক দর্শন অনুসারে ছয়টি বিশেষ গুণকে বলা হয় ‘ভগ’। এগুলো হচ্ছে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। যাঁর মধ্যে ‘ভগ’ পূর্ণরূপে বিরাজমান তিনিই ভগবান। যে কোনো রূপে ভগবান ভক্তকে দেখা দেন, মঙ্গল সাধন করেন।
সংস্কৃত শব্দ ‘অবতার’ হচ্ছে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অপ্রপঞ্চ থেকে প্রপঞ্চে ঈশ্বরের অবতরণ। পবিত্র গীতায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, যখন এ বিশ্বে ধর্ম গ্লানিময় হয়, অধর্মের অভ্যুত্থান হয় তখন সাধু ও ভক্তকুলের পরিত্রাণের জন্য যুগে যুগে ভগবান আবির্ভূত হন। নিরঞ্জন নিরাকার ঈশ্বর নরকলেবর ধারণ করেন জীবকে অনুগ্রহ করার মানসে। শ্রী ভাগবত পূরাণে অনেক অবতারের কথা বলা হলেও দশ অবতারের কথা সর্বজনবিদিত। এ দশ অবতারের মধ্যে শ্রী কৃষ্ণ অন্তর্ভুক্ত নন। এ দশ অবতার ভগবানের অংশ অবতার। আর শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের পূর্ণ অবতার। শ্রীমদ্‌ভাগবতে বলা হয়েছে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্‌।’
কেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যমুনা পাড়ের মথুরায় দ্বাপরে অবতীর্ণ হলেন তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো। দ্বাপর যুগের শেষভাগ ছিলো এক ঘোর অমানিশার সময়। ধর্মদ্বেষী এত দুর্বিনীত স্বৈরাচারী রাজার সমাবেশ এর আগে কখনো একত্রে দেখা যায়নি। হস্তিনাপুরের দুর্যোধন-দুঃশাসন, মগদের জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপালের অপশাসনে প্রজাগণ সীমাহীন দুঃখ ভোগ করছে। সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে মথুরার রাজা কংস। পিতা উগ্রসেন কারারুদ্ধ। সেনাপতি মুষ্টিক, চানুর আর প্রলম্ব, বক, তৃণাবর্ত, অঘাসুর, অরিষ্ট, দ্বিবিদ, পুতনা, কেশী, ধেনুক প্রভৃতি অসুর সহচরের দাপটে কংস ছিলো অপ্রতিরোধ্য। পিতৃব্য দেবকের কন্যা দেবকী ছিলেন তার স্নেহাস্পদ। দেবকীর সঙ্গে যখন রাজা সুরসেন পুত্র বসুদেবের বিয়ে ঠিক হলো, সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন রাজা কংস। সাড়ম্বরে বিয়ে দিয়ে প্রিয় বোনকে পৌঁছে দিচ্ছিলেন শ্বশুরালয়ে। কিন্তু দৈববাণী শুনেই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। আকাশবাণী হলো দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তানই হন্তারক হবে তাঁর। উদ্যত অসির হাত থেকে কোনোক্রমে বাঁচলেও দেবকীর ঠাঁই হলো কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে। এ কারাগারেই একে একে ছয় সন্তানের জন্ম দিলেন দেবকী। অসহায় পিতা বসুদেব নবজাতক পুত্রদের তুলে দিলেন নিষ্ঠুর কংসের হাতে। যোগমায়ার প্রভাবে সপ্তম সন্তান বলরাম গেলেন বেঁচে। এবার অষ্টম সন্তানের জন্য ব্যাকুল প্রতীক্ষা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে আসলেন অষ্টম গর্ভের সন্তান। রোহিনী নক্ষত্রযুক্ত নিকষ এক রাত্রিতে ঝড়-ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক সময়ে। তাই এ দিনটি শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমী নামে খ্যাত।
এবার আসা যাক, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে- ভাদ্র শব্দটি একটি ‘ভাদ্রপদ’ নামক নক্ষত্র থেকে। ভদ্র+ষ্ণ= ভাদ্র। শুভ বা মঙ্গলের মাস কৃষ্ণপক্ষে চাঁদের শক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে মনই চন্দ্র। চৌদ্ধটি তিথির অষ্টমীতে মনের শক্তি হ্রাস পেতে পেতে অর্ধেকে নেমে আসে। মনের চঞ্চলতা হ্রাস পেলেই সাধনার উপর্যুক্ত সময় হয়। মন হয় তখন অন্তর্মুখী- কামনা বাসনা মুক্ত। তখনই ভগবানকে পাওয়ার উপযুক্ত সময়। কৃষ্ণপক্ষে জন্ম নেয়া শিশুটি কালো। কিন্তু জগতকে তাঁর আলোয় আলোকিত করলেন। মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ সাথে মন, বুদ্ধি ও অহংকার- এ অষ্ট তত্ত্ব নিয়েই আমাদের জীব প্রকৃতি। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ অষ্টপ্রকৃতির অতীত। তাই অষ্টমীতেই তাঁর আগমন। আবার যোগমার্গেও আমরা দেখি সাধনার আটটি স্তর। এক একটি স্তর পর পর সাধকের জীবনে আসে। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান আর ধারণার পরেই সাধক হন সমাধিস্থ। তখনই হয় ভগবতদর্শন। এক একটি সাধনস্তর শেষ করেই অষ্টম স্তরেই পাওয়া যায় পরম আকাঙ্ক্ষিত ভগবানকে।
‘কংস’ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কম্‌+স, কম্‌ মানে কামনাবাসনা। আমাদের এ দেহ কামনাবাসনার কারাগার। ভগবানের কৃপা লাভ ছাড়া দেহ কারাগারের বদ্ধ দুয়ার খোলা সম্ভব নয়। কৃষ্ণের পিতা বসুদেব। ‘বসু’ অর্থ প্রাণ অর্থাৎ জীবাত্মা। মা দেবকী হলেন দৈবশক্তি। অরাজক মথুরার ভয়ংকার কারাগার থেকে নবজাতক কৃষ্ণ স্থানান্তরিত হলেন নন্দালয়ে। নন্দালয় হলো আনন্দের আলয়। এখানে রয়েছেন মা যশোদা। ‘যশোদা’ শব্দটি এসেছে যশ্‌ অর্থাৎ ভগবতমহিমা থেকে। মা যশোদা তাই যশোদাত্রী। যমুনায় পথ প্রদর্শনকারী শৃগাল ‘শিবা’ তথা শিবশক্তির প্রতীক, অভয়দানকারী ফণাধারী অনন্তনাগ ‘কুণ্ডলিনী’ শক্তির প্রতীক। বসুদেব জীবাত্মা, মস্তকে ধারণ করলেন পরমাত্মা ভগবানকে, হলেন শ্রেষ্ঠ ভগবদভক্ত। এভাবেই প্রেম আর ভক্তির মেলবন্ধনে ভগবানকে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়রূপে বরণ করেন ভক্ত। তাই শ্রী শ্রী জন্মষ্টমী মহিমাময় তাৎপর্য নিয়ে আসে আমাদের জীবনে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্পর্কের বন্ধনগুলো কি ভেঙে পড়ছে!
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম