ছোটবেলার কোরবানির ঈদ

কামরুন নাহার ঝর্না | শনিবার , ৯ জুলাই, ২০২২ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

ঈদ উল আযহা। এর তাৎপর্য নয়, বরং আজ ছোটবেলার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমরা চট্টগ্রাম শহরে থাকি। বড় চাচার পরিবার আমাদের বিশাল বাড়িতে থাকতেন। অন্য চাচারাও শহরে থাকেন। আমার তিন চাচা এক ফুফু। আব্বা বড় বলে উনাকেই সব দায়িত্ব নিতে দেখেছি।
ঈদের আগের দিন আব্বা আম্মা আমাদের সব ভাই বোন, অনেক সময় চাচারা সহ বাড়ি চলে যেতাম। সেই সন্ধ্যা আমার কাছে পৃথিবীর সেরা সন্ধ্যা। সব চাচা, চাচী কাজিনদের মিলন মেলা বসে যেত। আব্বা নতুন বাড়ি করেছেন। পাশেই আমাদের পুরাতন বাড়ি। জ্ঞাতি চাচা, দাদা, ফুফুরাও এসে সেই আনন্দে যোগ দিতেন। আমার এক মাত্র ফুফুকেও তার পরিবার সহ নাইওর আনা হতো। সে আর এক আনন্দ, যেন মহা প্রাপ্তি। সারারাত আমরা কাজিনরা উঠানে চাটাই, পাটি, পিড়ি, মোড়া নিয়ে বসে গল্প, হাসি মজা করতাম। বিনোদন ছিল চাঁদের আলো বা হারিকেনের মিটি মিটি আলো। কী এক অদ্ভুত সুন্দরতম রাত! এখন মনে হয় এমন রাত দিন জীবনে কমই এসেছে।
ঈদের পূর্ব রাতে পুকুরের বড় মাছ, ঘরে পালা বড় মোরগ, মাষকলাই ডাল, ক্ষেতের সবজি, দই। কী মজার খাবার। লাকড়ির চুলার রান্না, কেমন যেন স্মোকী স্বাদ। আমাদের রান্না ঘর ছিল অনেক বড়। মাটির বিভিন্ন সাইজের চুলা। লেপা মোছা করা, বড় বড় ডেকচি রান্না ঘরেই থাকতো। ২০/২৫ জন মানুষ অনায়াসে একসাথে রান্না ঘরে অবস্থান করা যায়।
রান্না ঘরের এক পাশে লাকড়ির মাচা, সাথে বিশাল এক ঢেঁকি। গ্রাম্য মহিলারা কাজ করার জন্য বাচ্চা কাচ্চা নিয়েই সন্ধ্যায় হাজির হতেন। একদিকে কিছু মহিলা ঢেঁকিতে চাউল গুড়ি করছে, অন্য দিকে কেউ কেউ রুটি বানাচ্ছে, কেউ সেঁকে বড় বড় বাঁশের টুকরিতে রাখছেন। এভাবে সারা রাত ধরে রুটি বানানোর কাজ চলতো ফজরের আজান পর্যন্ত। আমাদের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ এক সময় বন্ধ হয়ে যেত।
সকালে মেয়েদের ঘাটে আর ছেলেদের ঘাটে গোসল, সাঁতার কাটা, সাজু গুজু করা, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা, ঈদগাহে সব শ্রেণি পেশার মানুষ এক সাথে যাওয়া আমার কিশোরী মনে যেমন রেখাপাত করে আছে আজও ভুলিনি।
আমাদের বাড়িতে প্রথম দিন গরু, পরের দিন খাসী, পরের দিন ভেড়া জবাই করা হতো। দুই এক বেলাতেই সাদা রুটি, মোটা চাউলের ভাত আর মাংস খাওয়া শেষ। সেই দিনগুলি আজ শুধু স্মৃতিতে আছে।
একটা মজার স্মৃতি শেয়ার না করে পারছি না। ঈদের দিন রাতে নলা আর রুটি খাওয়া হবে। বড় চাচী অনেক যত্ন সহকারে বড় ডেকচিতে নলা রান্না করলেন। যার সুঘ্রাণ বাড়ির উঠানে বসেও আমরা পাচ্ছিলাম। চাচী ডেকচি নামিয়ে চুলার পাশে রাখলেন। ক্লান্ত শরীরটা আমাদের গল্পের আসরে ভাসিয়ে দিলেন। অনেক রাতে সবাই মিলে খেতে প্রস্তুত। দেখা গেল নলা আর নেই! আমাদের দুইটা বাঘা বাঘা কুকুর ছিল। দু’য়ে মিলে ডেকচি কাত করে ফেলে দিয়ে মহা সুখে হাড্ডি চিব্বাছিল। সে রাতে আমরা কী খেয়ে ছিলাম আজ আর মনে নেই। এর পরের আনন্দ ছিল নানার বাড়ি আর খালার বাড়ি বেড়াতে যাওয়া। স্কুল খোলার আগের দিন আবার বিষণ্ন মনে, কান্না জড়িত চোখে শহরে চলে আসতাম। আলাদা করে আমার কাজিনদের নাম উল্ল্যেখ করলাম না। আজ তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত স্ব স্ব জায়গায়। সেই সময়ে তাদের আন্তরিকতা, সৌহার্দ্য আতিথেয়তা, ভালোবাসা আমাদেরকে একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য করে রেখেছে। কেউ দেশ, কেউ প্রবাসে, বিভিন্ন জন বিভিন্ন জেলায় আছে। সোশ্যাল মিডিয়াই এখন আমাদের হৃদিক ভালোবাসা প্রকাশের জায়গা।
মা, বাবা, চাচারা অনেকে আজ আর নেই। কিন্তু তাদের শিখানো আদর্শ, নৈতিকতা, গুরুজনে মান্য করা আমাদের রক্তের সাথে যেন মিশে আছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শুভ কামনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদুল আযহা : শৈশব স্মৃতির আয়নায়
পরবর্তী নিবন্ধকুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও পশুবৃত্তির বিসর্জন সম্ভব