ঈদুল আযহা : শৈশব স্মৃতির আয়নায়

জাহানারা মুন্নী | শনিবার , ৯ জুলাই, ২০২২ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম (হিজরি সন অনুসারে) ঈদুল আযহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ, যেটা আমরা সাধারণত বলে থাকি। ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে পবিত্র হজের সবচেয়ে বড় আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
বিগত দুই বছর কোভিড পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সহ বহু দেশের মানুষ হজ পালনে যেতে পারেননি। এ বছর এই দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হলো। ধর্মপ্রাণ সামর্থবান অনেক মুসলিম গমন করলেন পবিত্র হজের উদ্দেশ্যে। পরিবারসহ বা পরিবার পরিজনদের রেখে কেউ কেউ একাই হজের উদ্দেশ্যে যান এবং সেখানে তাঁরা পশু কোরবানির মাধ্যমে হজের সকল কাজ সম্পন্ন করেন ও এক মাসের বেশি সময়ের এ সফর শেষ করে আপন ভূমিতে নিজ দেশে ফিরে আসেন।
আমাদের দেশেও ঈদুল আযহা বেশ উৎসব মুখর পরিবেশে পালন করা হয়। কোরবানির ঈদ এলেই ছোট বেলার কথা মনে পড়ে যায়! প্রতি বছর আব্বা আম্মা সহ সব ভাই বোনেরা ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি চলে যেতাম। যতটুকু মনে পড়ে আব্বা যতদিন বিশাল বিশাল গরু কোরবানি দিয়েছেন সেই পর্যন্ত আমরা গ্রামেই ঈদুল আযহা পালন করতাম। সেই সময়ে ঈদে গ্রামে যাওয়ার প্রতিযোগিতা হতো স্কুল ও পাড়া প্রতিবেশী বন্ধুদের মধ্যে। তখনতো ফেসবুক স্ট্যাটাস ছবি আপলোড হতো না, বন্ধের পর স্কুল খুললে যখন শুনতাম কেউ আমার আগে বাড়িতে চলে গিয়েছিল মন হতো বেজায় খারাপ। গ্রামেও ছিলো কয়েক বন্ধু-স্বজন, খেলায় আনন্দে ঘুরে-বেড়িয়ে কাটাতাম কয়েকটা দিন। ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে ঈদের নামায শেষ করে বেশিরভাগ বাড়িতে কোরবানির কার্যক্রম শুরু হয়ে যেতো। আমাদের দাদার বাড়িতে আমার আব্বা কোরবানি দিতেন ঈদের পরদিন অর্থাৎ ঈদুল আযহার দ্বিতীয় দিনে।
বান্দরবান পাহাড়ের পাদদেশে শঙ্খ নদীর সীমানা ঘেঁষে অপরূপ গ্রাম আমাদের। পার্বত্য আদিবাসীরা আসতেন আমাদের বাড়িতে এবং অন্যান্য বাড়িগুলোতেও। গরু মহিষ ছাগলের ভুড়ি তাদের খুব প্রিয় সেগুলোই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আসতেন। মারমা ও মগ উপজাতি আদিবাসীদের সাথে পুরো গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক দেখতে পেতাম, একসাথে বসে চলতো হাসাহাসি খোশ গল্প, চা বিড়িও খেতো। কিন্তু তাদের (মগ আদিবাসী) কানের বিশাল ছিদ্র দিয়ে চাদির অলংকার পরিহিত ও ভিন্ন রকম পোশাক পরিচ্ছদ অর্থাৎ ব্যতিক্রমী পাহাড়ি পোশাক পরিচ্ছদ দেখলে কেমন যেনো ভয়াচ্ছন্ন থাকতাম। মনে হতো পিঠে ঝুলে থাকা ঝুড়িতে করে নিয়ে যাবে আমায়! যতক্ষণ অবস্থান করতন তাঁরা গৃহে, আব্বা অথবা আম্মাকে জড়িয়ে ধরে সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকতাম। শঙ্খ পাড়ের খুব কিনারে একটি আধুনিক মারমা পাড়া ছিলো এখনও আছে। শৈশব থেকেই সেখানে যাওয়ার এক অদ্ভুত টান কাজ করতো আমার (সেটা আরেক স্মৃতি)। এদিকে প্রতি বছর আব্বা মেজবানির আয়োজন করতেন, মাইকিং হতো পাড়ায় পাড়ায়, শতশত মানুষ আসতেন।
আরও আসতেন আত্মীয় স্বজনেরা। কাচারি ঘরের খোলা একচালা বারান্দায় মাটি খুঁড়ে বানানো হতো এক লাইনের ৮-১০ টা চুলা দেখতে। তা এখনকার বন্ধু চুলার মতই অনেকটা। আর সেখানেই বড় বড় মেজবানির ডেকচিতে রান্নার কাজ চলতো। রাতে মেনথল লাইটের আলোয় বাড়ির উঠোন আলোকিত হয়ে উঠতো। টেবিল নয়, চাটাই বিছানো হতো একপাশের বিশাল উঠোনে। বেতের ঝুড়িতে কলা পাতা বিছিয়ে ভাত ও এলুমিনিয়াম বালতিতে করে মাংস পরিবেশন করতো। খাবারের জন্য টিনের থালায় ভাত, গোশত দেয়া হতো। এমন মেজবানির আয়োজন আরও কয়েকটি পরিবারেও করতে দেখেছি। একই দিনে বা একই বেলায় হতোনা, আয়োজনকারীরা সময় ও দিন পারস্পরিক আলোচনায় ভাগ করে নিতেন। তখন ঘরে ঘরে রেফ্রিজারেটর ছিলোনা, হাতে গোনা কয়েক উচ্চপর্যায়ের ধনীরা ক্রয় করতেন। যে কারণে গ্রাম থেকে কখনোই গোশত আনা হতো না। বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে পশু কোরবানি দিতেন ও সব মাংস সেদিনই ভাগ করে দিয়ে বাকি মাংস রান্না করে বিভিন্ন রন্ধন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতেন।
কালের আবর্তে, প্রযুক্তির উৎকর্ষে অনেক কিছুই বদলে গেছে। চিন্তা ধারায় এসেছে পরিবর্তন। যে যার মতো নতুন নতুন উদ্ভাবনী কাজে লাগিয়ে কোরবানি পালন করছেন। গ্রামেও এখন আমার দেখা শৈশব-কৈশোরের ঈদ ও ঈদের আনন্দ জৌলুস আর তেমন একটা চোখে পড়ে না।
তবুও বলবো চলুন সবাই, চেষ্টা করি আমরাতো চাইলেই পারি, আমাদের সন্তানদের নিয়ে বছরে অন্ততপক্ষে একবার হলেও কোরবানির ঈদ, এই ঈদুল আযহা গ্রামের বাড়িতে সম্পন্ন করি। তাদেরও দিতে পারি স্মৃতি বহুল মুখরিত শৈশব, গ্রামীণ ছোটবেলা। দেখবেন তারা-ও উদ্যমী হবে এই পরম্পরাকে মনে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নিতে।
সকলের ঈদ হোক, নির্মল আনন্দের নিবিড় ভালোবাসার শহর থেকে দূরে পাখির কলতানে বিশুদ্ধ বাতাসে শেকড়ের সন্ধানে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরবানির দিনটি হলো বছরের শ্রেষ্ঠ দিন
পরবর্তী নিবন্ধছোটবেলার কোরবানির ঈদ