ছুটির দিনে পাঠকের উচ্ছ্বাস, লেখক-প্রকাশকের স্বস্তি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৫ মার্চ, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

প্রবেশমুখে জটলা দেখেই অনুমান করা যায় অন্যদিনের চেয়ে পাঠকের উপস্থিতি বেড়েছে। কয়েক মিনিট লেগেছে সেই জটলা পেরুতে। অতঃপর প্রবেশ করেই সত্যতা মিলেছে অনুমানের। উচ্ছ্বসিত পাঠকের পদচারণায় মুখর বইমেলা প্রাঙ্গণ। সে উচ্ছ্বাস ছুঁয়েছে লেখক ও প্রকাশককেও। তারা বলছেন, বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। শুরু থেকে বিক্রি কম হওয়ায় কপালে যে চিন্তার ভাঁজ ছিল তা দূর হয়েছে। স্বস্তিবোধ করছেন তারা।
নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলছে বইমেলা। গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কর্মব্যস্ততাহীন এ দিনে বইপ্রেমীরা ছুটে এসেছেন মেলায়। পাঠকের সান্নিধ্য পেতে এসেছেন কবি-সাহিত্যিকরাও। সবার উপস্থিতিতে মেলায় ফিরেছে প্রাণ। শুধু নগরের নয়। বিভিন্ন উপজেলা পেরিয়ে অন্য জেলার পাঠকরাও এসেছেন মেলায়। বান্দরবান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মেহেদী হাসান এসেছেন স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। দৈনিক আজাদীকে তিনি বলেন, সাধারণত ভিড় দেখলে বিরক্ত লাগে। কিন্তু বইমেলায় ভিড় দেখলে আনন্দ পাই। কারণ বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে বলেই এ ভিড়। ধরে নিলাম যারা এসেছেন সবাই বই কেনার উদ্দেশে আসেনি। কিন্তু দেখা যাবে ঘুরতে ঘুরতে কোনো একটি বই ভালো লেগে গেল। তখন সেটা কিনে নিবেন। এভাবেই হয়তো তার মধ্যে পাঠভ্যাস বাড়বে। শিশু প্রকাশের আরিফ রায়হান বলেন, মেলায় লোকসমাগম যেমন বেড়েছে বিক্রিও বেড়েছে। একই বক্তব্য ছিল প্রথমার সায়েমের।
এদিকে গতকালও বেশ কয়েকটি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কবি ইউসুফ মুহম্মদ এর ‘নেহাই’ বিপুল বড়ুয়ার ‘বুবুন ও পরির গল্প’, মীর নাজমিনের ‘আলোর রাজা রুবাব’, জেসমিন ইসলামের ‘অমৃতের সন্ধানে’। এছাড়া পাঠকের আগ্রহ দেখা গেছে অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশের ‘ওই মহামানব আসে’, রাজীব বিশ্বাসের ‘কবিতার মতো নারী’, একে আজাদ সম্পাদিত ‘রিপোর্টারের গল্প’, রেজা মুজাম্মেলের ‘করোনার দিনকাল’, সাদেক সরওয়ার সম্পাদিত ‘কবিতায় এপার ওপার-৭’ এর প্রতি।
অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশের ‘ওই মহামানব আসে’ গ্রন্থে শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে বাঙালির বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়ে ওঠার বিভিন্ন দিক ওঠে এসেছে। বইয়ের নামকরণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গ এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। বঙ্গবন্ধু ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা পৃথক অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছেন গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতির গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নের উপস্থিতি এতে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগের কথা মাথায় রেখে বাংলা সাহিত্যের কবি, লেখকদের উদ্ধৃতি ব্যবহৃত হয়েছে প্রাসঙ্গিকভাবে। স্থান পেয়েছেন চর্যাপদের কবি, সুকান্ত, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, অন্নদাশঙ্কর রায়, বেগম সুফিয়া কামাল, নির্মলেন্দু গুণ প্রাসঙ্গিকভাবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব বিশ্বাসের কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতার মতো নারী’ও বেশ সাড়া ফেলেছে। ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, কবিতার শব্দের ভেতরে সৌন্দর্য আর প্রতিটি পঙক্তিতে মায়ার নূপুর পরা থাকে। প্রেমের কাব্যের শরীরজুড়ে লেপটে থাকে নারীর হৃদয়। প্রেম-বিরহ,
নির্ভরতা, অনুপ্রেরণা, সাহসিকতার বিভিন্ন নারীরূপ শব্দ-ছন্দের নিপুণতায় মূর্ত হয়ে ওঠে কবিতায়। গভীর বোধের স্বপ্ন-মাধুরী নিয়ে জীবনকে স্বর্গীয় অনুভূতির ছোঁয়া এনে দেয় নারীর অস্তিত্ব। তাই কবিতার এক অমীমাংসিত অনুষঙ্গ সর্বাঙ্গীণ নারী। ‘তোমার-আমার’ এই শব্দ যুগলের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি প্রকৃতির শরীর বেয়ে নেমে আসে মানব-মানবীর কায়ায়-মায়ায়। সেই আবেশের ফুলগুলো সাজিয়ে রচিত পর্যায়ক্রমিক কবিতাগুলো এই কাব্যগ্রন্থের ভিন্নতর একটি আবেদন।
রেজা মুজাম্মেলের ‘করোনার দিনকাল’ গ্রন্থে বৈশ্বিক মহামারি করোনা নিয়ে এক মলাটে আদ্যপান্ত বিধৃত হয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে মানুষ চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়া, চিকিৎসায় সংকট-সমস্যা, রোগীদের ভোগান্তি এবং করোনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া জীবন কাহিনির বর্ণনা আছে। বইতে যোগ করা হয়েছে করোনার নানা দিক নিয়ে সবিশেষ ১৫টি নিবন্ধ। এসব নিবন্ধে ফুটে তোলা হয়েছে করোনার আদি-অন্ত্ত।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের চট্টগ্রাম অফিসের স্টাফ রিপোর্টার এ কে আজাদ। চট্টগ্রামে কর্মরত বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের পেশাগত জীবনের বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির গল্প নিয়ে তার সম্পাদিত ‘রিপোর্টারের গল্প’ এর প্রতি আগ্রহ দেখা গেছে সবশ্রেণির পাঠকের। এ কে আজাদ মনে করেন, গ্রন্থটি পাঠ করে পাঠক সাংবাদিকদের জীবনের পথচলার নানান দিক সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়া নবীন সাংবাদিকরা কিভাবে তাদের পথ সুগম করবে সে ধারণা রপ্ত করতে পারবেন।
প্রসঙ্গত, জিমনেশিয়াম মাঠে তৃতীয়বারের মত চলছে অমর একুশে বইমেলা। মেলার আয়োজক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছে। মেলা চলবে ১০ মার্চ পর্যন্ত। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্ব সাধারণের জন্য মেলা উন্মুক্ত থাকবে।
আলোচনা সভা : গতকাল বইমেলার মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় লেখক সমাবেশ। কবি ও সাংবাদিক রাশেদ রউফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী। প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি আসাদ মান্নান, আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবি শুকলাল দাশ, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অমর একুশে বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
কবি আসাদ মান্নান বলেন, আমাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা বা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উপাদানটি হলো রাষ্ট্র ভাষা-আন্দোলন। বাংলাদেশ নামে একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্মের সাথে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ওতপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি বলেন, লেখক, কবি সাহিত্যিকদের আকাশের মতো উদার ও সমুদ্রের মতো গভীর এবং মানবিক হতে হবে।
রাশেদ রউফ বলেন, বাংলাদেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে লেখক, সাহিত্যক ও শিল্পীরা অনন্য ভূমিকা পালন করছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে এখনো লেখক, সাহিত্যকেদের ভূমিকা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। শুকলাল দাশ বলেন, বইমেলার মাধ্যমে একুশের চেতনা উজ্জ্বীবিত হয়। মেলাকে ঘিরে পাঠকের যে আগ্রহ বেড়েছে তা ধরে রাখতে হবে। কামরুল হাসান বাদল বলেন, মানুষ এ পর্যন্ত যা সৃষ্টি করছে তার মধ্যে বড় সৃষ্টি হলো বই। বই মানুষকে আলোকিত করেছে।
সমাবেশে কবি, ছড়াকার ও সাহিত্যিকরা তাদের লেখা কবিতা, ছড়া ও গল্প বলে সমাবেশকে আনন্দে মুখরিত করে তোলেন। কবিতা ও ছড়া পাঠ করেন ইউসুফ মুহম্মদ, অমিত বড়ুয়া, গোফরান উদ্দিন টিটু, সৈয়দা সেলিমা আকতার, বিভা ইন্দু, সুবর্ণা দাশ মুনমুন, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, ফারজানা রহমান শিমু, কোহিনূর শাকি, মিজানুর রহমান শামীম, পাদ্যেত কুমার বড়ুয়া, আবু তালেব বেলাল, কেশব জিপসী, শিপ্রা দাশ, রাসু বড়ুয়া, আখতারুল ইসলাম, গৌরি প্রভা দাশ, সুমি দাশ, লিটন কুমার চৌধুরী, রুনা তাসমিনা, সনজিত দে, সাইফুল্লাহ কায়সার, রশিদ এনাম, আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী, সৌরভ সাখাওয়াত, জসীম মেহবুব, আলী প্রয়াস, কাঞ্চনা চক্রবর্তী, আয়েশা হক শিমু, বিপুল বড়ুয়া, নাটু বিকাশ বড়ুয়া, সেলিম তালুকদার ও তসলিম খাঁ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসরকারের অবস্থানের নিন্দায় বিএনপি
পরবর্তী নিবন্ধআসামি ধরতে এসে হামলার শিকার কুমিল্লার ডিবি পুলিশ