চিরভাস্বর ডলিখালা

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৯:০৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের অতি প্রিয়, শ্রদ্ধেয়া ডলি খালা সারাদেশে যিনি পরিচিত ছিলেন শহীদজায়া মিসেস মুশতারী শফী হিসাবে। ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের একজন সোচ্চার নেত্রী ও সংগঠক ডলি খালা। আমি বলি, খালা ছিলেন প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা। ওনার যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ওনার যুদ্ধ ছিলো অপরিসীম দুঃখ-কষ্টের মাঝ দিয়েও নিজের জীবন বাঁচিয়ে, এবং বাচ্চাদের বাঁচিয়ে, তারপরেও ভেঙ্গে না পড়ে শব্দ-ঈথারের হাতিয়ার তুলে নেওয়া। এখনও আমার মন কাঁদে। আমার আম্মার কথা মনে হলেই, প্রথমেই খালার মুখও ভেসে উঠে চোখের সামনে। সেই ছোট্টবেলা থেকেই খালাকে ঘিরে আমার অনেক-অনেক স্মৃতি আছে। খালার কাছে আমি আজীবনই বেবী নামেই পরিচিত, অতি আদরের সেই ডাক ছিলো। কতশত টুকরা স্মৃতি ভাসে ‘বান্ধবী’ পত্রিকা, নারীদের প্রেস, আম্মা-খালাদের মিটিং-এ তিন-চার বছরের আমিই একমাত্র ‘পুরুষ’-এর উপস্থিতি, মৌ-মিতা নামের শিশুদের সংঘ, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে বইমেলায় আমাকে অনেকগুলো বই প্রাইজ দেওয়া, খালার বাসা ‘মুশতারী লজে’ বা আমদের ঝাউতলার বাসায় গান-বাজনা-কবিতার ঘরোয়া আসরগুলো। সবচেয়ে বেশী নিজেকে ধন্য মনে করি, শ্রদ্ধেয়া খালা শত ব্যস্ততার মাঝেও অত্যন্ত যত্ন করে আমার দ্বিতীয় বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের এই ঘটনাটা হলো খালার নিজের বই ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিনগুলো’ নিয়েই।
১৯৯০ সাল, আমি ইংল্যান্ডের সাউথ শিল্ড্‌স্‌ থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পড়া শেষ করে লিভারপুলে চাচার বাসায় সময় কাটাচ্ছিলাম। এসময়ে কোম্পানীর থেকে জরুরি খবর এলো, আমাকে অতিসত্ত্বর আমেরিকার হিউস্টনে গিয়ে জাহাজে জয়েন করতে হবে। আমার ভাই ডাঃ ইকবাল আমিন পি.এইচ.ডি. করছিলেন এবং ভাবী ডাঃ নাফিসা বাশার (তুহীন) সহ তখন বার্মিংহ্যামে থাকেন। আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে চট্‌ করে ভাই-ভাবী, ভাইপো জেহিনকে দেখার জন্য ঝটিকা-সফরের প্ল্যান করে রওনা দিলাম। হাতে সময় একদমই নাই। বার্মিংহ্যাম যাবো, একবেলা দেখা করেই ফিরতি রওনা দিবো। লিভারপুলে সন্ধ্যায় পৌঁছে, কয়েকঘন্টা পরেই ভোররাতে আমার ফ্লাইট, ম্যাঞ্চেস্টার থেকে। আমি দৌড়ের উপর থাকার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলেছি।
জেলিন ভাই-ভাবী কয়েকদিন আগে লন্ডনে ঘুরতে গিয়ে ডলি খালার বড় মেয়ে, আমাদের শ্রদ্ধেয়া ইয়াসমিন আপা ও নজরুল দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। আপা তখন জেলিন ভাইয়ের হাতে, খালার সদ্য প্রকাশিত বই ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিনগুলো’ দিয়েছিলেন, আমাদের চাচাকে উপহার দেওয়ার জন্য। আমি বার্মিংহ্যামে গিয়ে দেখি ভাই বইটি শেষ করার তাড়ায় আছেন। আমি ফেরার আগেই কোনমতে শেষ করেই ভাই আমার হাতে বইটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চাচাকে দিও।
হাহ্‌! চাচাকে তো অবশ্যই দিবো; কিন্তু তার আগে তো বইটি আমার নিজেরও পড়া চাই। অথচ, হাতে সময় কম। ট্রেনে উঠেই খালার বইয়ে মুখ গুঁজে দিলাম। আর বুঝতেই পারছেন, আমি কোন্‌ জগতে চলে গেলাম। এই বই তো যে কোনো সাধারণ বই নয়। এই বই আমার জীবনে দেখা কাহিনী, খালার সংগ্রামের কাহিনী, আপাদের কাহিনী, ভাইয়াদের কাহিনী, বাপ্পী-চিকুআপা-শাম্মীর কাহিনী। একাত্তরে একজন অসহায় মায়ের কাহিনী। অসহায় বা দুর্বল বলে ভেঙ্গে না-পড়ার কাহিনী। দৃঢ়তার কাহিনী। উঠে দাঁড়াবার কাহিনী, ফিরে দাঁড়াবার কাহিনী। আমি, পড়ছি তো পড়ছিই, পাতার পর পাতা। বাস্তবে আমি যাচ্ছি বার্মিংহ্যাম থেকে লিভারপুলে; কিন্তু মনোজগতে আমি খালার সঙ্গে চলছি চট্টগ্রাম থেকে আমানটোলার খানকা-শরীফে, আগরতলার ক্র্যাফ্‌ট ইন্সটিটিউট হোস্টেলের রিফিউজি ক্যাম্পে, কলকাতার কুমেদান বাগান লেনের বাসায়, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
বার্মিংহ্যাম থেকে লিভারপুল যেতে হলে, ক্রু (ঈৎববি) নামের এক জংশনে ট্রেন বদল করতে হয়। সেই স্টেশান মিস্‌ করলাম। কিছুপরে, বাথরুমের প্রয়োজনে উঠতে গিয়ে ভুলটা টের পেলাম। তাড়াহুড়া করে পরের স্টেশানেই নেমে, মিনিট বিশেক পরের ফিরতি ট্রেন ধরলাম, ক্রু (ঈৎববি)-র দিকে। রিস্কি হলেও, বই চলছিল। ক্রু পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সন্ধ্যার আগে লিভারপুল যাওয়ার আর কোনো ট্রেন নাই। অথচ আমাকে চাচার বাসায় পৌঁছাতেই হবে, তারপর ব্যাগ-স্যুটকেস গুছিয়ে, ভোররাতে ম্যাঞ্চেস্টার এয়ারপোর্ট যেতে হবে। নিরুপায় হয়ে, ট্রেন স্টেশান থেকে বের হয়ে, বাসের দিকে রওনা দিলাম। সেই সময়ে (১৯৯০-এর দিকে) ঘধঃরড়হধষ ঊীঢ়ৎবংং বলে একটা সুন্দর বাস সার্ভিস ছিলো, সারা ইংল্যান্ড জুড়ে। খুবই আরামের। আমি দৌড় দিয়ে গিয়ে, লিভারপুলের বাসের টিকিট কাটলাম। পকেট থেকে বেশ কয়েক পাউন্ড গচ্চা গেলো। কিন্তু, “ফড়বং রঃ সধঃঃবৎ?” অবশ্যই না; খালার বই পড়তে গিয়ে এতটুকু গচ্চা, গায়েই লাগলো না। আমি আবারো বইয়ে ডুবে গেলাম। শুধু তো পড়ছি না – আমি এই বই উপলব্ধি করছি। প্রতিটা শব্দ আমার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। প্রতিটা ঘটনা দাগ কাটছে। ’৭১ সালে ছয় বছরের সেই আমি, খালার এবং সমগ্র পরিবারের দুঃখ-বেদনা হয়তো তেমন করে বুঝি নাই। বাপ্পী-শাম্মী-চিকু আপার সঙ্গে খেলাধুলাতেই মেতে থাকতাম। ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোতে গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় করতাম। কিন্তু এই বই আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিলো ওনাদের রক্ত-ঝরা দিনগুলো; গভীর দুঃখ-কষ্টগুলো।
হায়, হায়! লিভারপুল তো পৌঁছে গেলাম, কিন্তু বইটাতো অর্ধেকও শেষ হয় নাই। চাচার বাসায় গিয়ে কোনোমতে ডিনার শেষ করেই, আবারো ঝাঁপিয়ে পড়লাম বই নিয়ে। ছোটোবেলার থেকে আম্মার আর খালার কত লেখা পড়ে এসেছি; কিন্তু একজন অতি আপনজনের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ের নিজ-জীবনের দুঃসহ সংগ্রাম নিয়ে লেখা তো এই প্রথম পড়ছি। বইয়ের চরিত্রগুলোর অনেককেই আমি চিনি, জানি, কাছে থেকে দেখেছি। কিন্তু কখনো তো অন্তর্গত এই ক্ষরণ, দুঃসহ এইপরিস্থিতিগুলো এইভাবে জানা হয়ে ওঠেনি।। খালার বই সেগুলোকে উন্মোচন করছে।
ডিনারের শেষে চাচা বলে দিয়েছিলেন, ফজরের নামাজের পরে, আমরা দুইজনে রওনা দিবো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। রাত গভীর হতে হতে, মধ্যরাত পার হয়ে গেলো। আমি বইয়ে ডুবেই আছি। ফজরের একটু আগে, চাচা এলার্ম দিয়ে উঠে বাংলাদেশে আমার আব্বাকে ফোন করলেন, আমি যাতে আমেরিকা যাওয়ার আগে দেশে আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথা বলে যেতে পারি। আমারো বইটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সারারাত একফোঁটা ঘুমাই নাই। কোনমতে বইটাকে সরিয়ে রেখে, স্যুটকেসের মধ্যে আমার সব জিনিস-পত্র, কাপড়-চোপড় ছুড়ে দিয়েই আবারও বইটা নিয়ে বসে শেষ করে, বাইরে এসে চাচাকে বললাম ডলিখালা আপনাকে একটা বই দিয়েছেন।
আমি যেন এক অন্য জগতের মধ্যে ছিলাম। এরপরে ইচ্ছা ছিলো, জাহাজে জয়েন করে এই ঘটনাটা চিঠিতে জানাবো। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশতঃ মাসখানেকের মধ্যেই সেই জাহাজে আমার একটা বড়সড় এঙিডেন্ট হলো, আমি গরম তেলে পুড়ে গেলাম। আমেরিকার হাসপাতালে বেশ কয়েকমাস চিকিৎসা শেষ করে দেশে ফিরে আসি। নিজের ভুলেই সেই বই পড়ার ঘটনা আর কখনো কাউকে বলা হয়নি। আজ প্রায় একত্রিশ বছর পরে সেটা নিয়ে লিখলাম। আমার চাচা অবশ্য বইটি পড়েই খালাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন; খালাও ভীষণ খুশী হয়ে সেই চিঠি বইয়ের পরবর্তী প্রকাশে ছাপিয়েছিলেন। আজ এত বছর পরে, খালা চলে যাওয়ার পরে আমার বইয়ের শেলফ থেকে ২০১৭ সালে খালার নিজ হাতে আমাকে দেওয়া বইটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছি আর খালার আজীবন সংগ্রামের বিনিময়ে, আল্লাহ্‌র কাছে ওনার জন্য শান্তি কামনা করছি।
টলিডো, ওহাইও, ২০২১

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধআলোর পথযাত্রী