চিকিৎসা সেবায় গরিবের ভরসা : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

রতন বড়ুয়া | রবিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬০ সালে। নতুন নির্মিত সাত তলা ভবনে তিনটি বিভাগ (সার্জারি, গাইনী ও মেডিসিন) ও মাত্র ১২০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ হাসপাতালের। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে ৫০০ শয্যা, ১৯৯৬ সালে ৭৫০ শয্যা, ২০০১ সালে ১ হাজার ১০ শয্যা, ২০১৩ সালে ১৩১৩ শয্যা এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে এ হাসপাতালকে ২২০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। মাত্র ৫০০ শয্যার অবকাঠামোতে নির্মিত এ (চমেক) হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা দফায় দফায় বাড়ানো হলেও বাড়েনি জনবল। উপরন্তু তিনটি বিভাগের স্থলে বর্তমানে হাসপাতালের বিভাগ (ওয়ার্ড) সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬টিতে। সবমিলিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। বর্তমানে হাসপাতালের বর্হিবিভাগে (আউটডোরে) প্রতিদিন আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। আর প্রতিনিয়ত প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকছে গরিবের হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত এই হাসপাতালের আন্তঃবিভাগে (ইনডোরে)। তবে এই তিন হাজার রোগীর সেবা চলছে সেই ৫০০ শয্যার জনবলেই।

জনবল : হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ীবর্তমানে মেডিকেল অফিসার পদ মর্যাদার হাসপাতালের নিজস্ব চিকিৎসক রয়েছেন ৩৩৫ জন। অনারারি (বিনা বেতনে) চিকিৎসক আছেন তিন শতাধিক। ইন্টার্ন চিকিৎসক রয়েছেন আড়াই শতাধিক। এছাড়া মেডিকেল কলেজের অধীন ৩৪ জন অধ্যাপক, ৫৮ জন (ওএসডি হিসেবে সংযুক্ত থাকা ২০ জনসহ) সহযোগী অধ্যাপক ও ১৮২ জন সহকারী অধ্যাপক (ওএসডি হিসেবে সংযুক্ত থাকা ৮৭ জনসহ) হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। এর বাইরে পোস্টগ্রাজুয়েট (স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের কয়েকশ শিক্ষার্থীচিকিৎসকও হাসপাতালে সেবা দিয়ে থাকেন।

আর হাসপাতালে বর্তমান নার্স সংখ্যা ১ হাজার ১৯৭ জন। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে হাসপাতালে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারি রয়েছেন ৪১৭ জন। এর মধ্যে ৩য় শ্রেণির ১১০ পদে রয়েছেন ৮৫ জন। আর ৪র্থ শ্রেণির ৫৬৬টি পদে কর্মরত রয়েছেন ৩৩২ জন। হিসেবে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদে আরো প্রায় আড়াইশ পদ শূন্য রয়েছে। অবশ্য আউটসোর্সিংএর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া ৪র্থ শ্রেণির আরো ১৯৩ জন কর্মচারী রয়েছে হাসপাতালে। চিকিৎসক ও নার্স সংখ্যা মোটামুটি চলনসই হলেও হাসপাতালে কর্মচারি সংকট প্রকট বলে জানান হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। পরিচালকের দাবিহাসপাতালে বিশেষ করে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী বেশি প্রয়োজন। কিন্তু এ জায়গাতেই সংকট বেশি। পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মচারী পাওয়া গেলে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় আরো সন্তোষজনক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এর বাইরে প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহকারী পরিচালক পদ মর্যাদায় আরো কিছু সংখ্যক জনবল জরুরি জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, শয্যা বেড়ে এখন ২২০০ হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে জনবল বাড়েনি। সেই পুরনো জনবলেই সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। এত অপর্যাপ্ত জনবলে বিশাল সংখ্যক রোগী সামলানো আসলেই কঠিন। সীমিত জনবলে সেবা দিতে গিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাকর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই হিমশিম অবস্থা বলেও মন্তব্য করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।

এদিকে, কর্মচারি সংকটের পাশপাশি ৪৬টি ওয়ার্ড বিশিষ্ট চমেক হাসপাতালে স্থান সংকটও চরম পর্যায়ে। শয্যা ছাড়িয়ে মেঝে, বারান্দা, করিডোর এমনকি সিঁড়িতেও রাখতে হচ্ছে রোগীকে। জনবল ও স্থানের এমন চরম সংকট নিয়ে এতদঞ্চলের বিশাল সংখ্যক রোগীর চাপ যেন আর নিতে পারছে না হাসপাতালটি। সবমিলিয়ে গরিবের এ হাসপাতালটি রোগীর ভারে বিপর্যস্ত বলা চলে। এমন পরিস্থিতিতেও এ হাসপাতালে তুলনামূলক কম খরচে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন গরীবঅসহায় রোগীরা। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চড়া ফি বহনে অক্ষম অসহায় রোগী মাত্রই ছুটে যান চমেক হাসপাতালে।

বাইরে ব্যয়বহুল কিন্তু চমেক হাসপাতালে স্বল্প ও নামমাত্র খরচে সেবা পান রোগীরা, এমন উল্লেখযোগ্য বেশকয়টি চিকিৎসা সেবার মধ্যে রয়েছে :

আইসিইউ সেবা: বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মুমূর্ষু কোন রোগীকে আইসিইউতে রাখতে গেলে দৈনিক বিল গুণতে হয় অর্ধ লাখ টাকার বেশি। যা সব পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভবপর নয়। বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের জন্য বেসরকারি হাসপাতালের এই আইসিইউ সেবা অনেকটা কল্পনাতীত। যার ফলে দরিদ্র মুমূর্ষু রোগীদের জন্য চমেক হাসপাতালই অন্যতম ভরসা বলা চলে। কারণ এখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়া রোগীদের আইসিইউ’র কোনো ধরণের বিল দিতে হয় না। হাসপাতালের চার তলার আইসিইউ বিভাগে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে শিশু রোগীদের জন্য রয়েছে আরো দশটি আইসিইউ শয্যা। যেটি পেডিয়াট্রিক আইসিইউ (পিআইসিইউ) হিসেবে পরিচিত। ৬ তলার নবজাতক (নিউনেটাল) ওয়ার্ডে নবজাতকদের জন্য রয়েছে ২০টি এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ)। এছাড়া প্রসূতি জটিল রোগীর জন্য গাইনী বিভাগে দুটি আইসিইউ চালু রয়েছে। বলতে গেলে অনেকটা বিনা খরচেই গরীব ও অসহায় রোগীরা এসব আইসিইউ সেবা পান।

ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি সেবা: চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে বহু প্রতিক্ষিত নতুন রেডিওথেরাপি মেশিনের আনুষ্ঠানিক সেবা চালু হয় ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর। এর আগে পুরণো মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ায় দীর্ঘ তিন বছরেরও বেশি সময় রেডিওথেরাপি সেবা বন্ধ ছিল হাসপাতালে। তবে নতুন মেশিনের আনুষ্ঠানিক সেবা চালুর পর বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা বিরতিহীন ভাবেই প্রায় দশ কোটি টাকার এ মেশিনের সেবা পাচ্ছে চট্টগ্রামের ক্যান্সার রোগীরা।

ক্যান্সার চিকিৎসকরা বলছেনবিশেষ করে জরায়ু, স্তন, মুখ গহ্বর, গলাশ্বাসনালী, ফুসফুস, ব্রেইন টিউমার ও মলদ্বারের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি অপরিহার্য। তাছাড়া শরীরের নির্দিষ্ট কয়েকটি অংশে ব্যথা নিরাময়েও রেডিওথেরাপি দেয়া হয়ে থাকে। বলতে গেলে অধিকাংশ ক্যান্সার রোগীকেই একটি সময়ে রেডিওথেরাপি নিতে হয়। যার ফলে ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই রেডিওথেরাপি সেবা অপরিহার্য বলে জানান চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ ও সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী।

ক্যান্সার ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে দৈনিক কম হলেও শতাধিক রোগী রেডিওথেরাপি সেবা পান। গোটা দক্ষিণাঞ্চলে (নোয়াখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত) প্রায় ৪ কোটি মানুষের জন্য সরকারিবেসরকারি পর্যায়ে দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে এই রেডিওথেরাপি সেবা চালু নেই। যার ফলে এই রেডিওথেরাপি সেবা পেতে ক্যান্সার ওয়ার্ডে রোগীদের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে।

যদিও সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে একটি রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বেসরকারি পর্যায়েও চট্টগ্রামে এই রেডিওথেরাপি সেবা গ্রহণের পথ সুগম হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অত্যাধুনিক সিটি স্ক্যান : দীর্ঘ চার বছর সেবা বন্ধ থাকার পর অবশেষে অত্যাধুনিক নতুন একটি সিটি স্ক্যান মেশিন পেয়েছে চমেক হাসপাতাল। হাসপাতালের রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগে প্রায় সাত কোটি টাকা দামের জাপানি হিটাচি ব্র্যান্ডের (১২৮ স্লাইস) অত্যাধুনিক মেশিনটি পৌঁছে ২০১৮ সালের নভেম্বরে। আর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে মেশিনটির আনুষ্ঠানিক সেবা চালু হয়। এরপর থেকে হাসপাতালে কম খরচে রোগীরা সিটি স্ক্যান সেবা পাচ্ছেন বলে জানান রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুভাষ মজুমদার। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে সেবা চালুর পর থেকে একাধিকবার মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে। কয়দিন আগেও মেশিনটি দুই দফায় অকেজো ছিল। তবে মেশিনটি সচলের পর বর্তমানে এর সেবা চালু রয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

ওপেন হার্ট সার্জারি : হৃদরোগের চিকিৎসার জন্যও গরীবঅসহায় মানুষের ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। স্বল্প খরচে হৃদরোগের সব ধরনের সেবা মেলে সরকারি এই হাসপাতালে। হাসপাতালে হৃদরোগ (কার্ডিয়াক) সার্জারি বিভাগ চালু হয় ২০১২ সালে। বিভাগটি চালু হওয়ার পর থেকে এই বিভাগে ৭ শতাধিক রোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই ওপেন হার্ট (সার্জারি) অস্ত্রোপচার।

চিকিৎসকেরা জানান, এই বিভাগে ওপেন হার্ট সার্জারিতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু বেসরকারি কোনো হাসপাতালে করতে গেলে এর খরচ আড়াই লাখ টাকার কম নয়। বরং বেশি। হৃদরোগের অন্যান্য অস্ত্রোপচার করতে গেলে এখানে খরচ পড়ে ১০১২ হাজার টাকা। বাইরে তা তিন থেকে চার গুণ।

বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, এখানকার খরচ সকল বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেক কম। শুধুমাত্র ওষুধ ও পারফিউনিস্টের ফি বাবদ রোগীর কিছু টাকা খরচ হয়। এ পর্যন্ত ৭২০টি সার্জারি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কার্ডিয়াক সার্জারী ওয়ার্ড সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের পর ওয়ার্ডের জন্য নতুন কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। শুরুর সময়ে যেসব যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে, এখনো সেসব যন্ত্রপাতি দিয়েই অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। কিন্তু এরই মাঝে সব ধরণের মেশিনে প্রযুক্তিগত অনেক আপগ্রেডেশন (এডভান্সডমেন্ট) হয়েছে। কিন্তু নতুন মেশিন না পাওয়ায় সে সুবিধা এখানে মিলছে না। পুরনো মেশিনগুলো দিয়েই কোনো রকমে চালিয়ে নিতে হচ্ছে জানিয়ে বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, অতি পুরনো হওয়ায় যন্ত্রপাতিগুলোও প্রায়ই ডিস্টার্ব দিচ্ছে। অনেক সময় অপারেশন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বলা যায় অনেকটা জোড়াতালি দিয়েই কার্ডিয়াক সার্জারির মতো বড় ধরণের এই অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করতে হচ্ছে।

এনজিওগ্রাম : হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের ক্যাথ ল্যাবে স্বল্প খরচে এনজিওগ্রাম সুবিধা পান রোগীরা। সরকারি ফি, ইনজেকশন ও আনুষঙ্গিক সবকিছু মিলে এনজিওগ্রামে ৮ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। বেসরকারি হাসপাতালে এর খরচ ২০ হাজার টাকার কম নয়। তুলনামূলক খুবই কম খরচে এখানে (চমেক হাসপাতালে) এনজিওগ্রাম করা যায় বলে জানান হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. আশিষ দে।

উল্লেখ্য, দুটি এনজিওগ্রাম মেশিন রয়েছে হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে। এর মাঝে একটি দেড় বছর ধরে অকেজো। সচল থাকা অপর মেশিনে রোগীরা সেবা পেয়ে আসছেন। তবে অতিরিক্ত চাপে যেকোনো মুহূর্তে এই এনজিওগ্রামটিও অকোজে হয়ে যেতে পারে বলে ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

(দুই)

সংস্কারে আমূল পরিবর্তন

বদলে গেছে সেবার ধরণও

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের কয়েকটি বিভাগে সংস্কারের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর এই সংস্কারের ফলে বিভাগগুলোর সেবার ধরণও বদলে গেছে। বিশেষ করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগের কথা না বললেই নয়..

আধুনিকায়নে জরুরি বিভাগ এখন ওসেক :

সংস্কারের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগের স্থলে নাম রাখা হয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার (ওসেক)। শুধু নাম নয়, পাল্টে গেছে সেবার ধরনও। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আদলেই এখানে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন রোগীরা। ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে এই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের সেবা চালু হয়েছে। হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ীওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের অভজারেভশন সেলে ৫০টিসহ রোগীদের জন্য সবমিলিয়ে ৮০টি শয্যা রাখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা চিকিৎসা সেবায় স্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্ণার। এছাড়া হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্যও রাখা হয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।

জরুরি রোগ নির্ণয়ে যুক্ত করা হয়েছে বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম। এর মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম, ইকো কার্ডিয়াগ্রাম, পোর্টেবল এক্সরে, ইসিজি ও এনালাইজারসহ অন্যান্য বেশ কয়টি সরঞ্জাম রয়েছে। চিটাগাং ক্লাবের পক্ষ থেকে এসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দেয়া হয়েছে। শয্যাসহ সবমিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়েছেন ক্লাবটির (চিটাগাং ক্লাব) সদস্যরা। এখন জরুরি বিভাগেই এসব পরীক্ষার সুবিধা পাচ্ছেন রোগীরা। এসব পরীক্ষার জন্য আগের মতো ওয়ার্ডে, রেডিওলজি ও প্যাথলজিতে ছুটোছুটি করতে হচ্ছেনা রোগীদের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবায় মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক এবং অ্যানেসথেসিয়াসহ প্রয়োজনীয় সব বিভাগের একজন করে কনসালটেন্ট সার্বক্ষনিক (শিফট ভিত্তিতে) নিয়োজিত থাকছেন এখানে। চিকিৎসকদের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষ। এছাড়া ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে দুটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও পর্যায়ক্রমে ৪টি আইসিইউ শয্যা যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, একজন রোগী আসা মাত্রই এখানে (ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে) রাখা হচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে দায়িত্বরত চিকিৎসক কর্তৃক পর্যবেক্ষনের পর পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন হলে সেটাও এখানে করা হচ্ছে। রোগীদের ২৪ ঘন্টার মতো এখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে যেসব রোগীর আর চিকিৎসা প্রয়োজন নেই বা বাসায় চিকিৎসা নিতে পারবেন, তাদের বিদায় করে দেয়া হচ্ছে। যেসব রোগীর আরো দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, শুধু সেসব রোগীকেই আন্তঃবিভাগে ভর্তি দেয়া হচ্ছে। মোটকথা, একজন রোগী জরুরি বিভাগে আসার পর জরুরি সব ধরণের চিকিৎসা যাতে এখানেই (ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে) পান, সে আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।

হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের এই উদ্যোগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ওসেককে মডেল আখ্যা দিয়ে দেশের সবকয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই মডেল অনুসরণেরও নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যা চমেক হাসপাতাল সর্বোপরি চট্টগ্রামের জন্য একটি বড় পাওয়া বলে মনে করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। তবে ওসেকএর জন্য এখনো জনবল পাওয়া যায়নি। জনবল পেলে এখানে (ওসেক) আরো সন্তোষজনক সেবা দেয়া সম্ভব বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক।

নতুন রূপে প্যাথলজি সেবা :

বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেকটা কম খরচে পরীক্ষানিরীক্ষার (টেস্ট) সুবিধা রয়েছে চমেক হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে (ল্যাবরেটরি প্যাথলজি)। আর কম খরচে পরীক্ষা করাতেই হাসপাতালের প্যাথলজিতে দিন দিন ভিড় বাড়ছে। যেন তিল ধারণের ঠাঁই থাকছেনা।

তবে এতদিন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি কাউন্টারে সেবাদানের কারণে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার ভোগান্তি সয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে হত রোগীদের। এ নিয়ে ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘চমেক হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ : কম খরচে পরীক্ষা করাতে দীর্ঘ লাইন/জনবল জায়গা সংকটে ভোগান্তি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই সেবা প্রার্থীদের ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাড়ানো হয়েছে নমুনা (স্যাম্পল) সংগ্রহে কাউন্টারের সংখ্যা। পাশাপাশি সেবা প্রার্থীদের জন্য করা হয়েছে বসার ব্যবস্থাও। এতে করে সেবা প্রার্থীদের ভোগান্তি অনেকটাই কমেছে। এতদিন নমুনা সংগ্রহে কম সংখ্যক কাউন্টারের কারণে সেবা প্রার্থীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হতো। বসার ব্যবস্থাও ছিল অপর্যাপ্ত। সবমিলিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হত সেবা প্রার্থীদের। তবে সংস্কারের মাধ্যমে হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগকে বর্তমানে নতুন রূপ দেয়া হয়েছে। এতে করে সেবা প্রার্থীরা আগের তুলনায় অনেকটা ভোগান্তিহীন ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে পারছেন। স্টাফরাও অনেকটা নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারছেন বলে জানিয়েছেন প্যাথলজির ল্যাব ইনচার্জ শুভাশীষ বড়ুয়া। যদিও সরেজমিনে দেখা যায়, সেবা প্রার্থীদের অতিরিক্ত চাপে স্টাফদের এখনো হিমশিম অবস্থায় সেবা দিতে হচ্ছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোগান্তি সয়েই সেবা নিতে হচ্ছে সেবা প্রার্র্থীদেরও।

প্যাথলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিবিসি, আরবিএস, ক্রিয়েটিনিন, বিলরুবিন, সিআরপি, এসজিপিটি, ইলেকট্রলাইট, কোলেস্ট্রল, ইউরিন, ডোপ টেস্টসহ প্যাথলজি সংক্রান্ত ৩৮ ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার সুবিধা রয়েছে এখানে। খরচও বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক কম। প্রায় অর্ধেক বলা চলে। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে মাত্র ২০০ টাকায় রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু বাইরে এ পরীক্ষার ফি ৪০০ টাকার কম নয়। একইভাবে প্রায় সব ধরণের পরীক্ষানিরীক্ষার ফি হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের চেয়ে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কয়েকগুণ বেশি।

(তিন)

অকেজো মেশিনে অসহায় রোগীরা

কিছু মেশিনের সেবা চালু থাকলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বেশ কয়টি ভারি যন্ত্রপাতি দীর্ঘ দিন ধরে অকোজো হয়ে পড়ে আছে। অকেজো হয়ে থাকা এসব যন্ত্রপাতির দামও কোনোটির কোটি টাকার কম নয়। মেশিন অকেজো থাকায় কম খরচের এসব সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়ে আসছে চট্টগ্রামের গরীব রোগীরা। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কয়েকগুণ বেশি দামে এসব সেবা নিতে বাধ্য হচ্ছে তারা। এর মাধ্যমে গরীব রোগীরা যেন দিনদিন আরো অসহায় পড়ছে।

হাসপাতালের ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতির মধ্যে আগে থেকেই এমআরআই, দুটি ক্যাথল্যাবের (এনজিওগ্রাম) একটি, ব্র্যাকিথেরাপি ও মেমোগ্রাফি মেশিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর বাইরেও তুলনামূলক কম দামের আরো বেশ কিছু সংখ্যক যন্ত্রপাতি বিকল রয়েছে। সবমিলিয়ে অকেজো এসব ভারি যন্ত্রপাতির দাম ২০ কোটি টাকার বেশি।

এমআরআই : হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের একমাত্র এমআরআই মেশিনটি গত বছরের (২০২২ সালের) মে মাস থেকে অকেজো। এর দাম প্রায় দশ কোটি টাকা। দীর্ঘ সময় সেবা বন্ধ থাকার পর অবশেষে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিনটির সেবা চালু হয় হাসপাতালে। কিন্তু সেবা চালুর পর কিছুদিন পরপর নিয়মিত ভাবেই অকেজো হয়ে পড়ে এমআরআই মেশিনটি। মেশিনটি অকেজো থাকায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই এমআরআই সেবা পাচ্ছেনা রোগীরা।

এনজিওগ্রাম: হৃদরোগ বিভাগে থাকা দুটি এনজিওগ্রাম মেশিনের একটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে (দেড় বছরের বেশি) অকেজো। মেশিনটির দাম ৫ কোটি টাকা। একটি টিউব নষ্ট হওয়ায় মেশিনটি আর কাজ করছেনা। ওই টিউবের দামও কোটি টাকার কম নয়। ওয়ার্ডে থাকা অপর মেশিনটিও প্রায় সময় ডিস্টার্ব দিচ্ছে। যেকোন সময় এই মেশিনটিও অচল হয়ে যেতে পারে বলে ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ব্র্যাকিথেরাপি: ক্যান্সার ওয়ার্ডে নারীদের জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি গত বছরের ৬ জুন থেকে অকেজো। মেশিনটির দাম প্রায় ৬ কোটি টাকা। ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই মেশিন চট্টগ্রামের আর কোথাও নেই। এখন জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের ব্র্যাকিথেরাপি দিতে হলে ঢাকা যাওয়া ছাড়া গতি নেই।

ম্যামোগ্রাফি : চমেক হাসপাতালে ডিজিটাল ম্যামোগ্রাফি মেশিনের বহু প্রতিক্ষিত সেবা চালু হয় ২০১৮ সালের ৬ আগষ্ট। হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে স্থাপন করা অত্যাধুনিক এ যন্ত্রটি নারীর স্তনে টিউমারক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। চিকিৎসকরা বলছেনমহিলাদের স্তনে যে কোন ধরণের টিউমার নির্ণয়ে ও স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে স্তনের ক্যান্সার নির্ণয়ে ম্যামোগ্রাফ করা হয়। এছাড়াও ৩৫ বছরের উর্ধ্বে প্রত্যেক নারীর স্তনের পরীক্ষায় এই ম্যামোগ্রাফ স্ক্রিনিং করা উচিত। ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া প্রত্যেক নারীর (সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর) যারা হরমোন থেরাপি নিয়ে থাকে, তাঁদের বছরে অন্তত একবার হলেও অবশ্যই ম্যামোগ্রাফ করা উচিত বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তবে রেডিওলজি বিভাগে থাকা একমাত্র ম্যামোগ্রাফি মেশিনটিও অকেজো হয়ে আছে বছরের বেশি সময় ধরে। যান্ত্রিক ক্রুটিতে গত বছরের শুরু থেকে এই সেবাও বন্ধ রয়েছে। মেশিনটির দাম কোটি টাকার কম নয়।

যা বলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ:

দফায় দফায় তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি ডজন খানেক চিঠি চালাচালির পরও এসব ভারি যন্ত্রপাতি সচল করতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবিএসব ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতি সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোর ডিপো (সিএমএসডি)’র মাধ্যমে ক্রয় করে হাসপাতালে সরবরাহ দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাই এ ধরণের কোন যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রথমে সিএমএসডি বা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়ে থাকে। পরে সিএমএসডি সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ওই যন্ত্র মেরামতের জন্য তাগিদ দেয়। সাধারণত ওয়্যারেন্টি সময় থাকা পর্যন্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দ্রুত সময়ে মেশিন মেরামতে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু ওয়্যারেন্টি সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। মেশিন মেরামতে গড়িমসির পাশাপাশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত বিল দাবি করে থাকে। এ নিয়ে দর কষাকষি করেই দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। এভাবেই মাসের পর বছর পেরোলেও এসব ভারি মেডিকেল যন্ত্রপাতি সচল হয়না। এক্ষেত্রে নিজেরাও এক প্রকার অসহায় বলে মন্তব্য করেছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। তবে এসব মেশিন সচল থাকলে চট্টগ্রামের গরীবঅসহায় রোগীরা কম খরচে সেবা পেতেন এবং উপকৃত হতেন বলে স্বীকার করেন হাসপাতাল পরিচালক।

লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুইস এনজিও’র ১৮ কর্মী আফগানিস্তানে আটক
পরবর্তী নিবন্ধএলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে: শহরের যান চলাচলে উন্মোচিত হবে নতুন দিগন্ত