চাল-গমের চোরাকারবারে ৭২ ঠিকাদার, ৭ সিন্ডিকেট

খাগড়াছড়ির চাল গম যায় পাহাড়তলীতে ।। টেকনাফের চাল খাতুনগঞ্জে

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

সরকারের আমদানিকৃত চাল যাওয়ার কথা খাগড়াছড়ি, কিন্তু সেই চাল বিক্রি হচ্ছে পাহাড়তলীতে। চাল যাওয়ার কথা টেকনাফে, অথচ বিক্রি হচ্ছে চাক্তাই কিংবা খাতুনগঞ্জে। চাল যাওয়ার কথা নোয়াখালী, যাচ্ছে নগরীর চালের আড়তে। এমন বেহাল অবস্থা চলছে সরকারি চাল গম পরিবহনে। পরিবহন ঠিকাদারের আড়ালে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার চাল গম নিয়ে নানা তেলেসমাতিতে লিপ্ত রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহনে জড়িতদের অনেকেই এ চোরাকারবারে লিপ্ত । চাল ব্যবসায়ী, আড়তদার, পরিবহন ঠিকাদার ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সরকারি চাল-গমের চোরাকারবারে জড়িত রয়েছে। চাল চোরাকারবারি, আড়তদার ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা নামে-বেনামে পরিবহন ঠিকাদারির লাইসেন্স নিয়ে এসব অপকর্ম করছেন। পাহাড়তলী দশ ট্রাক ও উখিয়ায় তিন ট্রাক সরকারি চাল ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি অনুসন্ধান করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। ৭২জন পরিবহন ঠিকাদারসহ সংঘবদ্ধ চক্রটির তালিকা এখন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে।
চাল গম পরিবহনের আড়ালে পরিচালিত অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক। পরিবহন ঠিকাদার সমিতিও অনিয়মে অতিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলা ও সিলেটের ৪ জেলার সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্সমূলে ৪৭৮ জন পরিবহন ঠিকাদার হালিশহর সিএসডি, সাইলো কিংবা দেওয়ানহাট খাদ্য গুদাম থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের চাল ও গম পরিবহন করে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের ১৫ জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বিধবা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিসহ সরকারের খাদ্যবান্ধব নানা কর্মসূচি, শরণার্থী সহায়তা, রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহৃত চাল গম ঠিকাদাররা পরিবহন করে। বিভিন্ন জেলা উপজেলা ভেদে ট্রাক ভাড়া নির্ধারিত হয়। এক ট্রাকে ১৫ টন করে চাল বা গম পরিবহন করা হয়। বছরে পাঁচ লাখ টনেরও বেশি চাল গম চট্টগ্রাম থেকে উক্ত জেলায় পরিবহন করা হয়। পরিবহনকালেই কোটি কোটি টাকার চাল গমের চোরাকারবার সংঘটিত হয়।
চাল যাওয়ার কথা খাগড়াছড়ির পানছড়িতে। সেই চাল বিক্রি হয় পাহাড়তলী, চাক্তাই কিংবা খাতুনগঞ্জে। সিলেটের কোন উপজেলা, নোয়াখালীর কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের গুইমারা, তবলছড়ি, দীঘিনালা কিংবা টেকনাফের চাল গম বিক্রি হয় চট্টগ্রাম শহরে।
খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদাররা হালিশহর সিএসডি থেকে সিলেটের জন্য চাল বোঝাই করে তা নামিয়ে দেয় পাহাড়তলীতে। এতে গাড়ি ভাড়ার টাকা পুরোপুরি পকেটে চলে আসে। পাশাপাশি চাল লোপাটের ভাগও অনায়াসে জুটে যায় বলে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা জানায়, মাসুদ কোম্পানি নামের একজন চাল ব্যবসায়ীর ২১টি পরিবহন ঠিকাদারির লাইসেন্স রয়েছে। ধনা বাবু নামের আরেক চাল ব্যবসায়ীর মালিকানায় রয়েছে ১৮টি লাইসেন্স। রশিদ সেক্রেটারি নামের এক ব্যক্তির মালিকানায় রয়েছে ১১টি লাইসেন্স। সাহাবুদ্দীন নামের একজনের মালিকানায় ৫টি লাইসেন্সের হদিশ মিলেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, চিহ্নিত চোরাকারবারিরা নিজেদের আত্মীয় স্বজন, পরিচিত পান দোকানদার ও হোটেল ব্যবসায়ীর নামেও লাইসেন্স নিয়ে তা নিজেই পরিচালনা করে। এতে ওই ব্যবসায়ী একদিকে পরিবহন ঠিকাদার, অন্যদিকে চালের চোরাকারবারি।
এতে চাল পথিমধ্যে নামিয়ে নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অত্যন্ত সহজ হয়ে উঠে। সাতটি সিন্ডিকেট সরকারের চাল গম নিয়ে এসব অপকর্ম করছে।
সরকারি চাল গমের ডিও কিনে নিয়ে তা যথাস্থানে প্রেরণ না করে এখানে সেখানে বিক্রি করে দেয়া হয়। সরকারের ভালো মানের চাল চট্টগ্রামে বিক্রি করে দিয়ে স্থানীয়ভাবে সংগৃহিত নিম্নমানের চাল দিয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে টেকনাফের সরকারি চাল উখিয়ায় নামানোর ঘটনা নিয়মিত ঘটে। স্থানীয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রেশনের নিম্নমানের চাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। আবার ১৫ টন চাল নিয়ে ট্রাক রওয়ানা হলেও পথিমধ্যে চালের পরিমাণ কমে যাওয়ার ঘটনা প্রাত্যহিক বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহন ঠিকাদার নানা গোঁজামিলের তথ্য উদঘাটন করতে গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা পিলে চমকানো নানা তথ্যও পেয়েছে।
খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদারের একটি লাইসেন্স পেতে ৫ লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি হিসেবে জমা দিতে হয়। এর বাইরে আরো ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে এক একটি লাইসেন্সের জন্য। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও পরিবহন ঠিকাদার সমিতিকে এ টাকা দিতে হয়।
বর্তমানে যে ৪৭৮ জন পরিবহন ঠিকাদার রয়েছে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২০১৮ সালে।
দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল এসব ঠিকাদার। সাবেক আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) মাহবুবুর রহমান, সাবেক সহকারি উপ-পরিচালক চন্দ্র শেখর মল্লিক এবং সিএমএস জহিরুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি উক্ত খাদ্যশস্য পরিবহন ঠিকাদারির লাইসেন্স ইস্যু করেছিলেন। দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া এসব ঠিকাদারি লাইসেন্সের মেয়াদ গত বছরের জুন মাসে শেষ হয়ে গেছে। এরপর নতুন লাইসেন্স ইস্যুর উদ্যোগ না নিয়ে তিন মাস পর পর সাময়িক নবায়ন দেখিয়ে খাদ্যশস্য পরিবহনের কাজ চালানো হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে- শুধু একজনের কাছে ১৮টি লাইসেন্সই নয়, দুইটি ঠিকানায় ৪৫টি লাইসেন্স থাকার ঘটনাও ধরা পড়েছে।
নগরীর শেখ মুজিব রোডের ৩১৪ নম্বর হোল্ডিং এর ঠিকানা ব্যবহার করে ৩৭টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে। অথচ দোতলার ওই ভবনে একটিও খাদ্যশস্য পরিবহন ঠিকাদারের অফিস দেখা যায় নি।
অপরদিকে শেখ মুজিব রোডের ভান্ডার মার্কেটের তৃতীয় তলায় চট্টগ্রাম খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির কার্যালয় থাকলেও ঠিকাদারের কোন অফিস নেই বলে জানান ওই ভবনের একাধিক ব্যবসায়ী।
অথচ এই ভবনের ঠিকানায় ৮টি লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। উক্ত ৪৫টি লাইসেন্সের ঠিকানায় সরেজমিন অনুসন্ধান করে একটিরও অফিসের অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।
খাদ্যশস্য পরিবহনে ৪৭৮টি লাইসেন্স ইস্যু হলেও কেউ কেউ মারা গেছেন। এসব লাইসেন্সের অনেকগুলো খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বলেও গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে।
খাদ্যশস্য পরিবহনের আড়ালে সরকারের কোটি কোটি টাকার চাল গম নয় ছয় করা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হাই বলেন, পরিবহন ঠিকাদারের কোন সাধ্য নেই চাল গম লোপাট করার। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সম্মতি ছাড়া খাগড়াছড়ির চাল পাহাড়তলীতে নামার কোন সুযোগ নেই। ডিও’র মালিক পরিবহন ঠিকাদার নয়। এখন ডিও’র মালিক যদি পথিমধ্যে চাল গম নামিয়ে বিক্রি করেন, সেখানে পরিবহন ঠিকাদারের কি করার আছে? খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাসহ ডিও’র মালিকদের ইচ্ছায় কিছু ঘটনা ঘটে বলে তিনি স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, কাজের সুবিধার জন্য বেশ কয়েকজন ঠিকাদার মিলে একটি অফিস ব্যবহার করেন। স্বাধীনতার আগ থেকেই এখানে ঠিকাদার সমিতি ও ঠিকাদারদের অফিস রয়েছে।
চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদার সমিতির সভাপতি সৈয়দ মাহমুদুল হক বলেন, আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেও কিছু কিছু ঘটনা ঠেকাতে পারছি না। পথিমধ্যে চেকপোস্ট স্থাপন ও খাদ্যগুদামগুলোকে সিসিটিভির আওতায় আনা সম্ভব হলে চাল-গম নিয়ে নয় ছয় করার সুযোগ থাকবে না। তিনি বলেন, পরিবহন ঠিকাদাররা এসব ঘটনায় জড়িত নয়, ট্রাক ড্রাইভারকে ম্যানেজ করে ডিও’র মালিকরা এসব করেন।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি-ফুড) মো. জহিরুল ইসলাম খান বলেন, আমিও অনেকগুলো অভিযোগ শুনেছি। বিভিন্ন পয়েন্টে অফিসার পাঠিয়ে সত্যতা যাছাইয়ের চেষ্টা করেছি। এসব কাজে জড়িতদের ধরা চেষ্টা করছি।
একই ঠিকানায় ৪৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রী ও স্বজনদের লাইসেন্স থাকার বিষয় নিয়েও তদন্ত চলছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহনের আড়ালে কোটি কোটি টাকার চাল গম লোপাটের বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানানো হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোভিড টিকা সর্বজনীন হোক : শেখ হাসিনা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬