‘চাটগাঁর বেলা’ এক ঐতিহ্যের নাম

ঋত্বিক নয়ন | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

চাটগাঁর বেলা’ এক ঐতিহ্যের নাম। মেজবানের মতো বেলা বিস্কুট চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক একটি খাবার। চট্টগ্রামবাসীর কাছে সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ে ডুবিয়ে কিংবা বিকেলের আড্ডায় বেলা বিস্কুটের কোনো বিকল্প নেই। বেলা বিস্কুটের কথা কবিসাহিত্যিক, ইতিহাসবিদদের লেখায়ও উঠে এসেছে।

যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহন করা এ ঐতিহ্য প্রসার লাভ করেছে দেশের অন্যান্য স্থানেও। এ অঞ্চলে বিস্কুট তৈরির পদ্ধতি রপ্ত করা হয়েছে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারে পর্তুগিজদের নিয়মিত আগমনের সুবাদে। প্রচলিত রয়েছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আবদুল গণি সওদাগর প্রথম বেলা বিস্কুটের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন।

বিস্কুট তৈরিতে মাটির তন্দুর এখন বিলুপ্তপ্রায়। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক ওভেন। আবার ইস্ট ছাড়া বিস্কুট তৈরির কথা ভাবাই যায় না। এসব আধুনিক যন্ত্র আর উপাদান দূরে ঠেলে প্রাচীন পদ্ধতিতে বেলা বিস্কুট তৈরি করে যাচ্ছে গণি বেকারি।

বেলা বিস্কুটের নামকরণ প্রসঙ্গে প্রয়াত লেখক ও অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৬৬ সালে তার আত্মজীবনী রেখাচিত্র গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে।’ এছাড়া বিভিন্ন গবেষকদের লেখায় ২০০ বছর আগে চট্টগ্রামের বেকারিতে সর্বপ্রথম বেলা বিস্কুট তৈরি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। আবদুল গণির আগে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারি পণ্য তৈরির সূচনা হয় তার পূর্বপুরুষ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার বাসিন্দা লাল খাঁ সুবেদার এবং তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে। এ হিসাবে দেখা যায় চট্টগ্রামে বেলা বিস্কুটের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের।

ব্রিটিশ আমলেও তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার মানুষের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় ছিল বেলা বিস্কুট। পান্তা ভাতের পরিবর্তে ধোঁয়া ওঠা চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে সকালবিকেলের নাশতা সেরে নিতেন তখনকার পৌরসভার মানুষেরা। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে। আর এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে রপ্তানি হচ্ছে বেলা বিস্কুট।

গণি বেকারি নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা একাডেমির সাবেক সহপরিচালক প্রয়াত আহমদ মমতাজ। তিনি বলেছেন, মোগল ও পর্তুগিজদের খাদ্যাভ্যাসে ছিল রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। তাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেকারি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ২৫০ বছর আগে। শুরুতে রুটি তৈরি হতো বেকারিতে। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় পাউরুটি, কেক, বেলা বিস্কুট। মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ। বেকারি পণ্য তৈরির সময় তখনকার উদ্যোক্তারা বেলা বিস্কুট নামে বিশেষায়িত বিস্কুট তৈরি করেন। এ হিসেবে বেলা বিস্কুট তৈরির ইতিহাস ২০০ বছরের কম হবে না।

চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় কলেজ রোডে গণি বেকারির অবস্থান। গণি বেকারি মোড় হিসেবে পরিচিত এলাকাটি। আবদুল গণির পূর্বপুরুষদের এই বেকারি পণ্য তৈরির ব্যবসা থাকলেও তখন সেভাবে নাম ছিল না। পূর্বপুরুষের হাত ধরে ১৮৭৮ সালে বেকারিশিল্পে যুক্ত হন আবদুল গণি সওদাগর। ১০৫ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে মারা যান তিনি। তার আগে ১৯৪৫ সালের ৮ অক্টোবর ওয়াক্‌ফ করে যান তিনি। সে অনুযায়ী এই বেকারির হাল ধরেন আবদুল গণির ভাইয়ের ছেলে দানু মিঞা সওদাগর। তিনি মারা যাওয়ার পর ১৯৮৭ সালে তাঁর ছেলে জামাল উদ্দিন হাল ধরেন। জামাল উদ্দিন মারা যাওয়ার পর হাল ধরেন তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ এহতেশাম। তিনি জানান, ‘একতলা এই বেকারি ভবনটি তৈরি হয় ১৯১০ সালে। এরপর থেকে সংস্কার করা হলেও তিন স্তর ছাদের মূল অবকাঠামো টিকিয়ে রাখা হয়েছে।’

দেশ ভাগের আগে ভারতের কয়েকটি প্রদেশেও এ বেকারির বিক্রয় কেন্দ্র ছিল। তবে ১৯১০ সালে গণি সওদাগর যখন বেকারির হাল ধরেন, তখন নামকরণসহ পুরনো বেকারি ভেঙে আধা পাকা ভবন গড়ে তোলেন। এখনো প্রাচীন পদ্ধতিতেই বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও গণি বেকারি থেকে এখনো বেলা বিস্কুট কিনে নিয়ে যান চট্টগ্রামের বাইরের জেলার ক্রেতারা। আবার প্রবাসে আছেন এমন অনেকেই দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে যান বেলা বিস্কুট। আধুনিক প্রযুক্তির সব মেশিনারিজ বাজারে এলেও আসল স্বাদ ও গুণগত মান ধরে রাখতে এ বেকারির বেলা বিস্কুট এখনো তৈরি করা হয় মাটির তন্দুরে।

গণি বেকারি শোরুমের পেছনেই বিস্কুট তৈরি হয়। সেখানে দেখা যায়, দুটি মাটির তৈরি তন্দুরে বেলা বিস্কুট তৈরি করছেন কারিগরেরা। পুরোনো নিয়ম ধরে রাখায় এই বেকারিতে বেলা বিস্কুট তৈরিতে অন্তত দুই দিন সময় লাগে। প্রথমে ময়দা, চিনি, লবণ, ভোজ্যতেল, ডালডা, গুঁড়া দুধ পানিতে মিশিয়ে খামি তৈরি করা হয়। এই খামিতে ইস্টের পরিবর্তে বিশেষ ধরনের মাওয়া দেওয়া হয়। মাওয়ার উপাদান প্রকাশ করতে চান না তাঁরা। খামিতে মাওয়া মিশিয়ে একদিন রাখার পর তন্দুরে প্রথম এক দফায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা সেঁকা হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় আবারও সেঁকে বেলা বিস্কুট তৈরি করা হয়। তন্দুরে গ্যাসের ব্যবহারের পাশাপাশি কয়লাও ব্যবহার হয়। গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ প্যাকেট বা ৮ থেকে ১০ হাজার পিস বেলা বিস্কুট তৈরি হয়। বাণিজ্যের চেয়ে ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টাতেই এমন আয়োজন তাদের।

বেলা বিস্কুট নিয়ে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী প্রফেসর সবিহ্‌ উল আলম বলেন, “ছোট বেলায় যখন কাজেম আলী ইশকুলের ছাত্র ছিলাম, তখন দেখতাম বাসায় প্রায় সময় আব্বার কাছে মেহমান আসত। বাবা গণি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট কিনে আনতেন। আমার মা লেবুর চিনিপানা বা শরবত দিয়ে বেলা বিস্কুট কোন কোন সময় দুধ চা দিয়ে বেলা বিস্কুট পরিবেশন করতেন। ইশকুলের টিফিন ছুটিতে গণি বেকারিতে গিয়ে বেলা বিস্কুট কিনে খাওয়ার স্মৃতিটা আজও মনে পড়ে। বেলা বিস্কুটের ইতিহাস মানে গণি বেকারির নাম নিতে হবে। ছোট বেলা থেকে জেনেছি বেলায়েত আলী নামে বিস্কুট বিক্রেতা ছিলেন তাঁর নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়”।

ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক লেখক গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, “বেলা বিস্কুট আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। অনেকের ধারনা ১৫০ থেকে ২০০ বছর আগে আমরা কেউ বেলায়েতকে দেখিনি, বেলায়েতের নাম যারা বলে তাঁরাও দেখেনি। অনেকে মনে করেন বেলিয়ে তৈরী করা হয় বলে বেলা বিস্কুট নামকরণ করা হয়। তবে আমার কাছে বেলায়ত নামে বেলা বিস্কুটের নামকরণটাই গ্রহণযোগ্য মনে হয়”।

লেখক : সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধহৃদয় দিয়ে হৃদয় সম্পর্কে জানুন
পরবর্তী নিবন্ধঐতিহ্য ধরে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন