চলার পথের ভাবনাগুলো

শামীম ফাতেমা মুন্নী | মঙ্গলবার , ২১ জুন, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

ফিরছিলাম নিজ ঠিকানায়, অঝোর বৃষ্টি শেষে গভীর রাতে! পাহাড়ি এলাকা, ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত ছুটন্ত গাড়ির জানালা খুলে দিলাম, এসির কৃত্রিম হাওয়া থেকে প্রকৃতি প্রদত্ত রাতের বাতাস অনেক নির্মল! বুক ভরে শ্বাস নিলাম জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, বাতাসে মুখ ডুবিয়ে, সারাদিনের অবিরাম বর্ষণ শেষে মাঝ রাতে বাদলধারার বিশ্রামে সব শীতল করে দিয়েছে যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও। ডুবে গেছে অনেক অলি-গলি, পথ-ঘাট, জল থইথই করছে রাতের প্রচ্ছায়া বুকে নিয়ে! তারই মাঝে গাড়ি ছুটে চলেছে এঁকে বেঁকে আর আমি দু’পাশ দেখছিলাম ক্লান্ত দৃষ্টিতে। দু’ধারের সারি সারি আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকাসম বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে নক্ষত্র রাজির মতো।

ভাবনারা ডানা মেলে বিহঙ্গ হয়ে, ঐ ইটের পিঞ্জরাগুলোর মাঝে বাস করে সহস্র জীবন্ত প্রাণ! প্রাণগুলোতে সুখ যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি কত যে কষ্ট-গ্লানি-ব্যথা দহন লুকিয়ে জীবন চলছে, আমরা কেউ জানি না, জানতে পারি না, জানতে চাইও না কখনোই ! সুখ আর দুখ, কষ্ট আর আনন্দ কিন্তু বিশাল বাড়িগুলোতে যেমন থাকে, তেমনি পাতায় ছাওয়া বস্তিবাড়িতে ও জড়িয়ে থাকে ওরা, সবখানেই তাদের অবাধ আসা যাওয়া যেন।

উঁচু উঁচু দালানের আকাশছোঁয়া স্বপ্নদেখা মানুষগুলো পাহাড়চূড়া জয় করার স্বপ্নে ব্যস্ত, অথচ সেই পাহাড়চূড়ার নীচে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করা মানুষগুলোর জীবন প্রদীপ নিভে যায় সেই পাহাড়চূড়ার মাটি ধসে! মানুষগুলোকে রাষ্ট্র যে বাসস্থান দিতে পারেনি, কেউ শখ করে জেনে শুনে মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস করে না! আমরা শুধু দুঃখপ্রকাশ করেই ক্ষান্ত হই। এই দুঃখ, এই ব্যর্থতা কোথায় লুকোই ? কোথায় লুকোই সিলেট ও সুনামগঞ্জের বানের পানিতে গৃহবন্দী প্রায় দশ লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধে আহাজারীর দুঃসহ আক্ষেপ, সব হারিয়ে বেঁচে থাকার দৈন্যদশার করুণ আর্তনাদ? বন্যার পানি নামবে একদিন, কিন্তু এই পানি তো জীবনে অর্থহীন অসহনীয় কষ্টের দাগ রেখে যায় নিঃস্ব করে!

পদ্মাপাড়ের উৎসবে শত শত আলোর ঝলকানিতে আমরা আবার সব ভুলে মেতে উঠবো অসাধ্য স্বপ্ন পদ্মাসেতুর বাস্তবায়নের আনন্দে। মানুষের চরিত্রই যে এমন, জলকুয়াশায় আঁকা এর নামই জীবন! জীবন সুন্দর, আমরাই তাকে জটিল করে তুলি যাপনের মারপ্যাচ এর কঠিন হিসেবে, অনেক সময় ভুল ও হয়ে যায় মারাত্মক সব। তার প্রায়শ্চিত্তে কখনো কখনো একজীবন ও কম পড়ে যায় ! চোখের পলকে সরে সরে যাচ্ছে সবকিছু, মাটির সাথে মিশে থাকা বস্তি কলোনীগুলোতে ও মিটমিট আলো জ্বলছে তখনো! ওখানে ও একই আলো আঁধারীর খেলা চলে বিধাতার। আমাকে ছুঁয়ে যায় এসব ভাবনার রূঢ় বাস্তবতা একান্তে খুব, চোখের জলকণা গড়িয়ে পড়ে রীমলেস চশমার ফাঁকে অজান্তে! ঝাপসা হয়ে আসা চশমা খুলে রাখতেই হয় তাই। ভাবনার রাশ টেনে গভীর রাতের চলন্ত পথে ‘সমস্ত ব্যর্থতার দায় মানুষেরই ‘ দুচোখে বর্ষার জল নিয়ে সেই স্বীকারোক্তিতে নিজেকেই বোঝাই – ‘মানুষ মানুষের জন্য – সর্বক্ষেত্রে আমরা কথাটার সার্থক বাস্তবায়ন করতে পারিনি সে আমাদের অক্ষমতা! তাই নীরব প্রার্থনায় রবিঠাকুরের সেই চিরন্তন লাইন দুটো গুনগুনিয়ে নিজেকেই শোনাই, ‘কষ্ট যদি দাও হে প্রভু, শক্তি দিও সহিবারে’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বর্গেও ভালো থেকো মা
পরবর্তী নিবন্ধভারতে উগ্র সামপ্রদায়িকতা ঠেকাতে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ প্রয়োজন