ভারতে উগ্র সামপ্রদায়িকতা ঠেকাতে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ প্রয়োজন

কাজী রুনু বিলকিস | মঙ্গলবার , ২১ জুন, ২০২২ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দা ইন্ডিয়ান এঙপ্রেসে একটি কলাম লিখেছেন কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী। তিনি লিখেছেন, ‘ঘৃণা, ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা ও অসত্য ভাষণের বাতাবরণ গোটা দেশকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলেছে। এখনই এই সর্বনাশ রোখা না গেলে এদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।’ তাঁর ভাষায় ‘এই অবস্থা আমরা চলতে দিতে পারি না। মিথ্যা জাতীয়তাবাদের যূপকাষ্ঠে শান্তি ও বহুত্ববাদের বলি আমরা নীরব দর্শক হয়ে দেখে যেতে পারি না’। কংগ্রেস এই মুহূর্তে শান্তি ও বহুত্ববাদের বলি ঠেকাতে কতটুকু কী করতে পারবে বলা কঠিন। কারণ মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ভারতের মাঠে ঘাটে অনলাইনে বিভাজনের চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে হিন্দুত্ব মৌলবাদের যে বিশাল উত্থান হয়েছে এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। সোনিয়া গান্ধী এমন সময় লেখাটি লিখেছেন যখন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সঃ)কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতা আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতেও আঘাত করেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ মুসলমানের রক্ত যেমন ঝরছে ভারতে, তেমনি মুসলিম দেশগুলোর ক্ষোভের মুখে পড়েছে ভারত। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো তাদের রাজধানীতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে অগ্রহণযোগ্য বিবৃতির জন্য তাদের ভর্ৎসনা করেছে এবং এসব মন্তব্য যারা করেছে তাদের শাস্তি ও দাবি করেছে। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা জানিয়েছে এবং জাতিসংঘকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

ভারতে গণতন্ত্রের অবনমন, মানবাধিকার হরণ, ঘৃণা ভাষণ ও সংখ্যালঘুদের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে উঠে এসেছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম স্থাপনা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে দেশটির প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রও। ২০২১ সাল জুড়ে ভারতের সর্বত্রই সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার অব্যাহত ছিল। খুন জখম ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটেছে অবিরাম। অবশ্য এটাও সত্য যে গত সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব সমস্যা সমাধান, কৃষকদের সমস্যাকে একপাশে রেখে ভোটারদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছিলেন নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে। বিজেপির এজেন্ডা ছিল-

এক. কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল
দুই. রাম মন্দির নির্মাণ
তিন. বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন।

তাদের এই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল তার প্রমাণ তাদের বিপুল বিজয়। এখন তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে আইনসভা ও আদালতের সহায়তায়। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণে অগ্রসর হচ্ছে ভারত। এই পর্যন্ত থাকলেও কোনোভাবে সহ্য করে নেওয়া যেতো কিন্তু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো নেতাদের বুলডোজার নীতি, খুনাখুনির উসকানি, অবিরাম ঘৃণা ছড়ানো মহাত্মা গান্ধীর দেশটাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিজেপির এই প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ শুধু ভারতকে সংকটে ফেলেছে তা নয় পুরো উপমহাদেশে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। ভারতের ৭২ বছরের ইতিহাসে এমন সহিংস রূপ আর দেখা যায়নি। বিজেপি দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনর্বাসন করতে গিয়ে ভারতকে পিছিয়ে দিয়েছে বহু বছর। ভারতের অর্থনীতি গতিপথ হারিয়েছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্য বৃদ্ধি, কর্মহীনতা ভারতের বড় সমস্যা। বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির কারণেই প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের ও যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। সত্যিকার অর্থে কোনো প্রকৃত ধার্মিক অন্য ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর কিছু বলতে পারে না। বিজেপির এই ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের ধর্ম নিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর ব্যাপারটা শুধু ভারতে থেমে থাকবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এটা এই উপমহাদেশে একটি সামপ্রদায়িক ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে ক্রমাগত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে মুসলিম সংখ্যালঘু সমপ্রদায় অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এবং তাদের নাগরিক অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব হয়েছে। কিছু কট্টর লোকজনের ভোটের জন্য বিশ কোটি মুসলমান নাগরিকদের এভাবে প্রান্তিক করে তোলার পরিকল্পনা অন্যায় তো বটেই ঝুঁকি ও কিন্তু কম নয়!

১০ই এপ্রিল রাম নবমীকে কেন্দ্র করে নেতাদের মুখে চরম ঘৃণা সূচক মন্তব্য যেমন শুনা গেছে তেমনি সহিংসতায় কয়েক জনের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ভারতের এই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র বিনির্মাণে আড়াল থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়েতি নরসিংহানন্দের মতো সাধুরা। তারা খোলাখুলি সংখ্যালঘু বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এই নতুন হিন্দুত্ববাদ বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার বলেছেন, ভারতে বিরতিহীন ঘৃণা সূচক বক্তব্য বিবৃতির বিস্তার ঘটেছে।

আগে ঘৃণা সূচক কথাবার্তা সাধারণ নির্বাচনের আগে শোনা যেতো কিন্তু এখন মিডিয়া জগতের যে নতুন চালচিত্র তাতে রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পেরেছেন যে একটি রাজ্যে এধরনের বক্তব্য দিলে অন্য রাজ্যে ও নিজেদের লোকজনের সুবিধা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামপ্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ভারতে যথেষ্ট আইন রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে কোনো গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি এবং বিশ্বাসে আঘাত করা ভারতে দণ্ডনীয় অপরাধ। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্র এই অপরাধের সাথে জড়িত। নূপুর শর্মা ও নবীন কুমারের আপত্তিকর মন্তব্যে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। কিছুদিন পর পর মুসলিম স্থাপনা ও মসজিদের ভিতর মন্দিরের খোঁজ পাওয়ার গল্প ফেঁদে বসছে তারা। কখনো তাজমহল কখনো কুতুব মিনার বা এরকম ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর নানা রকম মিথ্যা তথ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে বিজেপি যে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোট নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা আরও একবার স্পষ্ট করলো। তাদের এসব কাণ্ডে অসুস্থ রাজনীতি চর্চার সাথে সাথে সামাজিক ক্ষেত্রেও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী ও আধুনিক দেশ হিসেবে ভারতের পরিচয়টা নষ্ট করছে। সবশেষে মধ্যেপ্রাচ্যের বাজারও হারাতে বসেছে। সংখ্যালঘুসহ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই জায়গায় রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন টেনে সামপ্রদায়িকতা উসকে দেয় তা রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক!

বর্তমান ভারতের রাজনীতি একেবারে আনুষ্ঠানিক ভাবে মিশে গেছে ধর্মের সাথে। ভোটের রাজনীতির কারণে ভারতের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক সরকারিভাবে ঠিক থাকলে ও সাধারণ জনগণের মনে ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম নিচ্ছে এটা অস্বীকার করার জো নেই। সবচেয়ে বড় কথা এই জনগণকে নিয়েই কিন্তু সরকার! আমি এই দাবি করতেই পারি ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি সহনশীল ও অসামপ্রদায়িক। অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ বোধের অনুশীলন তো হচ্ছে! আশা করি ভারত এই সহিংস পরিবেশ থেকে খুব দ্রুত বের হয়ে আসবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলার পথের ভাবনাগুলো
পরবর্তী নিবন্ধএকটি হঠাৎ মৃত্যু : হরিষে বিষাদ!