চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ও সংক্ষিপ্ত ইতিকথা

সাইফুদ্দিন সাকী | শনিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও প্রধান সমুদ্রবন্দর। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়। সাগর পাহাড় নদী সমতল ভূমির এক চমৎকার বৈশিষ্ট্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তীর্থস্থান চট্টগ্রাম। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই বলা হয়ে থাকে ‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন’।
এবার জেনে নেয়া যাক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- ১৮৬৩ সালের ২২ জুন প্রথম চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটি গঠিত হয়। এর প্রথম প্রশাসক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ জে.ডি. ওয়ারড। তখন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭ এবং আয়তন ছিল ৬ বর্গমাইল। ওয়ার্ড ছিল ৫টি আর এর নামকরণে পরিচয় ছিল এ, বি, সি, ডি, ই । জে ডি ওয়ারড ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর আরো ৫ জন ইংরেজ প্রশাসকের নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন মিঃ কার্কউড, মিঃ সি.এ.স্যামুয়েল, মিঃ এইচ.টি.এস কটন, মিঃ এন্ডারসন ও মিঃ গুড। এরপরে খান বাহাদুর আমান আলি, খান বাহাদুর আবদুস ছত্তার, নূর আহমদ, রফিক উদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করেন অবিভক্ত ভারতের আইনসভার সদস্য নূর আহমদ চেয়ারম্যান। তিনি ১৯২১ হতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত একটানা প্রায় ৩৩ বৎসর চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে প্রথম চেয়ারম্যান হলেন খান বাহাদুর আবদুস ছত্তার।
১৯৬০ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠন করা হয়। তখন ওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৬ করা হয়। পৌরসভা করা হয় ১৯৭৭ সালের ২৭ জুন। এর চেয়ারম্যান হন ফজল করিম। ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পৌরসভা থেকে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয় এবং ১৯৮২ সালের অর্ডিন্যান্সে ১ জন মেয়র/ প্রশাসক, ২ জন ডেপুটি মেয়র/প্রশাসকের পদ সৃষ্টি করা হয়। ইতিমধ্যে ওয়ার্ডের সংখ্যা ৪১ এবং আয়তন ৬০ বর্গমাইলে রূপ নেয়। তখন প্রশাসক হন ব্রিগেডিয়ার মফিজুর রহমান চৌধুরী। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী, সেকান্দর হোসেন মিয়া, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী প্রশাসক নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনকে ১৯৯০ সালের ৩০ জুলাই সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত করা হয়। তখন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে মেয়র করা হলে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হন এবং ডেপুটি মেয়র হন এম আবু নাছের চৌধুরী ও দস্তগীর চৌধুরী। এরশাদ সরকারের পতন হলে বিভাগীয় কমিশনার মো. ওমর ফারুককে মেয়রের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয় এবং বিএনপি সরকার গঠন করলে মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন মেয়র হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালের আদেশে ডেপুটি মেয়রের পদ বিলুপ্ত এবং মেয়র পদে সরাসরি নির্বাচনের বিধান আনা হয়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করলে বিভাগীয় কমিশনার এম এ বারী প্রশাসক হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালের ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নাগরিক কমিটির প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হন। তখন মহানগরীর ভোটার ছিল ৬,৮৭,৭৪৪ জন। এরপর ২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি ও ২০০৫ সালের ৯ মে’র চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পুননির্বাচিত হয়ে তিন বারের নির্বাচিত মেয়র হিসাবে ইতিহাস গড়েন। ২০১০ সালের ১৭ জুন নির্বাচনে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মনজুর আলমের নিকট পরাজিত হন এবং ২০১৫ সালে এম মনজুর আলমকে পরাজিত করে আ জ ম নাছির উদ্দিন মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন গত বছর ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে এবং ২৯ মার্চ ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে। কিন্তু মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছরের ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত হয়। ফলে ২০০৯ সালের এ্যাক্ট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মো. খোরশেদ আলম সুজনকে সরকার ৬ মাসের জন্য প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দেয়। তিনি গত ২০২০ সালের ৬ আগস্ট দায়িত্ব নেন এবং আগামী ৫ ফ্রেরুয়ারি তাঁর মেয়াদ শেষ হবে। গত ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী বিএনপি প্রার্থী ডাঃ শাহাদাত হোসেনকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি শপথ নিয়ে ৫ বছরের জন্য মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন।
২০০৯ সালে এ্যাক্ট পাশ হবার আগ পযর্ন্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১৯৮২ র অর্ডিন্যান্স ও আইন দ্বারা পরিচালিত হত। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে সকল সিটি কর্পোরেশনকে সিটি কর্পোরেশন সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও অধ্যাদেশসমূহকে একীভূত, অভিন্ন এবং সমন্বিতকরণকল্পে জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ করে এবং ১৫ অক্টোবর আইনটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ৭টি বিভাগ রয়েছে। তা হল- সচিবালয়, প্রকৌশল, রাজস্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্ন ও হিসাব। এতে সরকারের যুগ্ম সচিব, উপ সচিব পদের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রেষণা নিয়োজিত আছেন।
লেখক : প্রাক্তন জনসংযোগ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

পূর্ববর্তী নিবন্ধজহির রায়হান : জীবনদ্রষ্টা কথাসাহিত্যিক
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে