পূর্বকথা: ১৯৪৭ সালে (১৪ আগস্ট) একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল, অবিভক্ত ভারতবর্ষের (Undivided India ) সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, অনুন্নত ও অনগ্রসর এলাকাগুলি পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে–তখনকার ব্রিটিশ–শাসকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলির সম্মতি–চুক্তি মোতাবেক, (Indian Independence Act of 1947 )। এই দুরবস্থার প্রেক্ষিতে, সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের সরকার দেশের দ্রুত সার্বিক আর্থ–সামাজিক উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে, ‘পঞ্চ–বার্ষিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’ (Five-Year Economic Development Plan ) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কৌশলগত নীতি (Strategic Policy ) গ্রহণ করে। পাকিস্তানের ‘প্রথম পঞ্চ বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার’ মেয়াদকাল ছিল ‘১৯৫০–৫৫’ কাল–পর্ব। দ্বিতীয় পঞ্চ–বার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদকাল ছিল ‘১৯৫৫–৬০’ কাল–পর্ব। প্রথম পঞ্চ–বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে ১৯৫৩ সনে রাজশাহীতে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর আগ পর্যন্ত, সেই সময়ের পূর্ব–পাকিস্তানের প্রায় সাড়ে চারকোটি লোকের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মাত্র একটি–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত) [১৯৫১ সনে পাকিস্তান সরকারের পরিচালিত আদম–শুমারির (Census ) অর্থাৎ লোক–গণণার তথ্য অনুযায়ী তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি একুশ লাখ এবং ১৯৬১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে সাত কোটিতে উপনীত হয়] ১৯৬০ সনে প্রকাশিত পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চ–বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার দলিলে (Document ) ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ‘চট্টগ্রাম বিভাগে’ একটি পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় (রাষ্ট্রীয় পরিচালনাধীন) প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুমিল্লা, সিলেট এবং নোয়াখালী জেলাসমূহের বাসিন্দারা সকল শ্রেণি–পেশার মানুষ তাঁদের নিজেদের জেলায় ঐ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে, পরবর্তী তিন বছরে, সিলেট ও কুমিল্লা জেলার বাসিন্দারা, সর্ব–স্তরের জনগণের অংশগ্রহণে, এমন প্রবল, ব্যাপক ও অব্যাহত তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যে, তাতে দৃশ্যত মনে হচ্ছিল–সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টি এই দুই জেলার যেকোন একটিতেই স্থাপিত হবে। এই বিষয়ে, চট্টগ্রামবাসীর আন্দোলন ছিল তুলনামূলকভাবে নিষ্প্রভ, বিচ্ছিন্ন ও অকিঞ্চিৎকর তথা নগণ্য। চট্টগ্রামবাসীর ধারণা ছিল–অবিভক্ত বাংলার একমাত্র প্রাকৃতিক সমুদ্র–বন্দর (Natural Sea-Port ) সম্বলিত চট্টগ্রাম একটি ঐতিহাসিক নগরী। তদুপরি, চট্টগ্রাম প্রশাসনিক বিভাগের (Administrative Division ) সদর–দপ্তর, ‘চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয় এখানে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে অন্য কোথায়ও যেতে পারে না। (তখন পূর্ব পাকিস্তানে ‘প্রশাসনিক বিভাগ’ ছিল চারটি–ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ। সাবেক বৃহত্তর কুমিল্লা ও সিলেট জেলা এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলা ‘চট্টগ্রাম বিভাগের’ অন্তর্ভুক্ত ছিল)। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে–সেই সময়ের চট্টগ্রাম সিটি কলেজের (তখন বেসরকারি) উপাধ্যক্ষ এবং বাংলার অধ্যাপক আহমদ হোসেন চৌধুরী ছাত্র–শিক্ষকদের নিয়ে কিছু মিছিল–মিটিং সংগঠিত করেছিলেন।
এই বিষয়ে জোরালো আন্দোলন সংগঠনে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে প্রভাব, পরিচিতি ও খ্যাতির দিক দিয়ে প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী (সিটি কলেজের) তখন খুব ভালো অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্মের প্রচার–প্রচারণার সভা–সমাবেশ ছাড়া, অন্য কোনরূপ কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছিলেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, চট্টগ্রাম অপেক্ষা, সিলেট ও কুমিল্লা জেলাবাসীর আন্দোলন, প্রবলতর হওয়ার পেছনে, অন্যান্য কারণের মধ্যে নিম্নলিখিত কারণগুলি বিদ্যমান ছিল :
(ক) চট্টগ্রাম জেলার জনগণের শিক্ষার শতকরা হার অপেক্ষা সিলেট ও কুমিল্লা জেলার জনগণের শতকরা শিক্ষার হার কয়েক সংখ্যায় অধিকতর ছিল।
(খ) পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীসভায় সিলেট ও কুমিল্লা জেলার মন্ত্রীদের সংখ্যা চট্টগ্রামের মন্ত্রীদের সংখ্যার চেয়ে দুই–তিন গুণ বেশি ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন কুমিল্লা জেলার বাসিন্দা–আশরাফ উদ্দীন আহমদ। প্রাদেশিক গভর্নর, আব্দুল মোনায়েম খান ছিলেন–ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা। চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা মন্ত্রী ছিলেন মাত্র দু’জন–চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানহাটের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও মুসলিম লীগ নেতা সুলতান আহমদ এবং রাঙ্গামাটির চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পত্নী শ্রীমতি বিনীতা রায়–এঁদের কেউই চট্টগ্রামের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না।
(গ) সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যে–সকল কর্মকর্তারা (সরকারের চাকরিতে নিয়োজিত) মূখ্য ভূমিকা পালন করেন–সেই সব ই,পি,সি,এস, এবং সি, এস,পি, অফিসারদের সংখ্যার ক্ষেত্রেও–চট্টগ্রাম জেলার চেয়ে কুমিল্লা ও সিলেট জেলা অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। পাকিস্তানের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের পরীক্ষায় (CSS Exam .) সফলকাম হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ঊর্ধ্বতন পদে সি,এস,পি (CSP ) অফিসার (Covenanted Service of Pakistan –রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চাকরি) হিসেবে কর্মরত সিলেট ও কুমিল্লা জেলার বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং ঈর্ষণীয়। চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা শুধু দু’জন সি.এস.পি অফিসারের নাম শোনা যেত–একজন ছিলেন ফটিকছড়ির এস.এম, সফিউল আজম এবং অপরজন পটিয়ার জিরি গ্রামের সন্তান এ.কে.এম, আহ্সান। এদেশে ব্রিটিশ আমল থেকে বেসরকারি/ব্যক্তি পর্যায়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার আইন ছিল কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠার কোন আইন ছিলনা–বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনেক পরে–১৯৯২ সনে এই ধরণের আইন চালু হয়। পাকিস্তানে ‘পঞ্চ বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের একমাত্র কর্তৃপক্ষ ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রে এবং প্রদেশগুলিতে ‘কনভেনশন মুসলিম লীগের’ সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল এবং সরকারের ধরণ ছিল-‘রাষ্ট্রপতি–শাসিত সরকার’ (Presidential Type of Govt )-অবিকল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো। প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ আইয়ুব খান। তিনি কনভেনশন মুসলিম লীগেরও সভাপতি ছিলেন।
‘আন্দোলনের’ দৃশ্যপটে আতাউর রহমান খান কায়সার ঃ–
আলোচিত সময়ে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিলাম। আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন একই বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তখনকার দিনে, ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’ পার্টির (অর্থাৎ আইয়ুব খান সরকারের) সমর্থক ছাত্র–সংগঠনের নাম ছিল ‘এন.এস.এফ’। (National Students Federation ) আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন–এই এন.এস.এফ–এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার প্রখ্যাত জমিদার ও মুসলিম লীগ নেতা মরহুম এয়ার আলী খানের (প্রকাশ–পেচু মিয়া) জ্যেষ্ঠ পুত্র।
‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে’ চট্টগ্রামবাসীর নিষ্ক্রিয় ও হতাশাজনক ভূমিকায় আমি অত্যন্ত অস্থির ও মর্মাহত হয়ে পড়ি। আমি মনঃস্থির করলাম–আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা ছাত্র–ছাত্রীদেরকে সংঘবদ্ধ করে-‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে একটি সরব ও সক্রিয় আন্দোলনের সূচনা করব। তখনকার দিনের পরিস্থিতিতে আতাউর রহমান খান কায়সার ছাড়া অন্য কারও নেতৃত্বে এরূপ ‘আন্দোলন’ সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আমি তখন, ঢাকায় বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতাম। সেই সময়ে, ঢাকা শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা–চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল একেবারে নগণ্য।
১৯৬৩ সনের জানুয়ারী মাসের চতুর্থ সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট তারিখ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নির্দিষ্ট একটি স্থান নির্ধারিত করে, আমি ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত চট্টগ্রামবাসী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, আমার সাধ্যমত খুঁজে খুঁজে যোগাযোগ শুরু করি এবং নির্দিষ্ট তারিখে ও স্থানে, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমাবেশে যোগদানের জন্য জোরালো আহ্বান জানানো আরম্ভ করি এবং আমার এই কাজে, অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে আমাকে ‘সঙ্গ’ দিয়েছেন–অত্যন্ত পুরনো ঢাকাইয়া–চাটগাঁইয়া, আমার আত্নীয়, আবুল ফজল চৌধুরী। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে, মাস্টার্স শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। এরপরে, আমার ‘মিশনের’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে, আমি কায়সার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সম্মুখভাগের দক্ষিণ–পশ্চিম ব্লকের দোতলায় ছয় শয্যা বিশিষ্ট কক্ষে থাকতেন। সেখানে গিয়ে দেখি যে, তিনি নাই। তখন তাঁর রুমমেটদেরকে তথায় অমার আগমনের বিস্তারিত তথ্যাদি বুঝিয়ে বললাম এবং এটাও অবশ্যই তাঁকে জানাতে বললাম যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আহুত ‘সমাবেশে’ গঠিতব্য ‘সংগ্রাম কমিটিতে’ তাঁকেই ‘প্রধান–আহ্বায়ক’ মনোনীত করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ঐতিহাসিক ‘মধুর কেন্টিনের’ অতিরিক্ত হিসাবে, কার্জন হলের পিছনে (দক্ষিণে) এবং ঢাকা হলের (বর্তমানে এটি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল) উত্তর দিকের খালি জায়গায় আধুনিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরী দোতলা দালানের প্রশস্ত কক্ষে পাশ্চাত্য স্টাইলের ‘বুফে কেন্টিন’ চালু করা হয়। নীচ তলায় কেন্টিন চলত–চেয়ার–টেবিল থাকা সত্ত্বেও দোতলার কক্ষটি অব্যবহৃত পড়েছিল। কেন্টিনের ইজারাদারদের অনুমতি নিয়ে, আমি সেখানে, চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে ঢাকায় অধ্যয়নরত চট্টগ্রামবাসী ছাত্রদের সমাবেশ আহ্বান করি ১৯৬৩ সনের ২৪ শে জানুয়ারী বিকাল বেলায়। সমাবেশে শতাধিক ছাত্র উপস্থিত ছিলেন। (চলবে)