দেশবিভাগের (১৯৪৭) আগে অবিভক্ত বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ছিল কলকাতা। পরে তদানীন্তন পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী শহর ঢাকাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা নতুন গতিবেগ লাভ করে। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরেও নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। কৃত্রিম সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকচক্র প্রথম থেকেই পাকিস্তানপন্থী ইসলাম ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারে মত্ত হয়। তারই বাহন হিসেবে কিছু প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার১ পাশাপাশি ১৯৫০ সালের মধ্যেই নতুন কিছু পত্রিকার আবির্ভাব ঘটে। যেমন : আবদুর রশিদ সম্পাদিত ২ মাহেনও (১৯৪৯-৭১), কাজী মোতাহার হোসেন সম্পাদিত দিলরুবা (১৯৪৯-৬৪), মাহফুজা খাতুন সম্পাদিত নওবাহার (১৯৪৯-৫৩), সৈয়দ আবদুল মান্নান সম্পাদিত তাহজিব (১৯৫০-), আবেদ আলী সম্পাদিত দ্যুতি (১৯৪৯-৫০) ইত্যাদি। ৩
তখন পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণের স্বরূপ জনগণের সামনে স্পষ্ট না হলেও ১৯৫০-এর মধ্যেই মার্কসীয় মতাদর্শ প্রভাবিত কিছু প্রগতিশীল বামপন্থী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেমন সুধাংশু রায় ও অন্যান্য পরিচালিত ৪ কৃষ্টি (১৯৪৭), মাহবুব উল আলম ও সুচরিত চৌধুরী সম্পাদিত সীমান্ত (১৯৪৭-৫৩), সিরাজুর রহমান সম্পাদিত সংকেত (১৯৪৮), ফজলে লোহানী সম্পাদিত অগত্যা (১৯৪৯-৫৩), আবদুল গনি হাজারী ও মাহবুব জামাল জাহেদী সম্পাদিত মুকতি (১৯৫০)।৫ এদের কোনো কোনটি পাকিস্তান ও কায়েদে আজমের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি প্রগতিশীল অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
দেশবিভাগ এবং ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় চট্টগ্রাম থেকে মো. আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার (১৮৯৮-১৯৬২) সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার প্রকাশ (১৯৫০) একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মুসলমান স্বাতন্ত্রবাদী ভাবাদর্শ আরোপ এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের নানা ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এই পত্রিকার উদার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামি ভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকাটি উদার গণতান্ত্রিক ও দেশব্রতী স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার এই স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিচিতি প্রদানই বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য।
পত্রিকার সম্পাদক মো. আবদুল খালেক ছিলেন একাধারে প্রকৌশলী, সম্পাদক, লেখক, পাঠ্যবই রচয়িতা এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা উদ্যোক্তা। কলকাতা শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কিছুকাল শিক্ষকতার পর তিনি চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুৎ প্রচলনে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান চিটাগাং সাপ্লাই কোম্পানিতে যোগ দেন (১৯২০)। এরপর চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পদে ইস্তফা দিয়ে চট্টগ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ছাপাখানা ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করে (১৯২৮) মুদ্রণ জগতে আসেন। পরে কোহিনূর লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করে (১৯৩৩) পাঠ্যবই রচনা, প্রকাশনা ও বিপণন শুরু করেন এবং সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকতা ও লেখালেখির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইসলামি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজসেবায় নিয়োজিত হলেও মুসলিম লীগ সরকারের সামপ্রদায়িক নীতি অবস্থানের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং তিনি ছিলেন পাকিস্তান সরকারের উর্দ্দু প্রীতির বিরোধী এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা এর সাক্ষ্য বহন করছে।
কোহিনূর-এর প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার ৬ সম্পাদকীয় নিবন্ধে পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট
১. ‘একমাত্র পরম কারুণিক বিশ্ব গ্রষ্টার উপর নির্ভরতা’;
২. ‘মখলুকের (সৃষ্টিজগতের) খেদমত করা’
৩. সাহিত্যের সেবা করা-সে সাহিত্য ‘ধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত থাকবে না;’
৪. স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
কোহিনূর প্রকাশকাল থেকেই ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় সংখ্যাতেই স্বনামে ‘ভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে সম্পাদক লেখেন ঃ
“হুকুমতে পাকিস্তান উর্দ্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেই উর্দ্দু ভাষা প্রচলিত নাই।… যদি অধিকাংশের ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে গ্রহণ করা উচিত
বিবেচিত হয় তবে বঙ্গভাষা হইবে রাষ্ট্রীয় ভাষা।”৭
দেশবিভাগের পরপর পাকিস্তানের শাসকগাষ্েঠী ও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আরবি হরফে বাংলা প্রচলনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ‘আরবী হরফ বনাম বাংলা হরফ’ প্রবন্ধে অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন দৃঢ় ও বলিষ্ঠ ভাষায় ঐ হীন প্রয়াসের বিরোধিতা করে লেখেন ঃ “জাতিকে ভাঁওতা দিয়ে অন্যমনস্ক করা ছাড়া এর কোন অর্থই থাকতে পারে না।৮ ‘আরবী ছাত্র সম্মেলন’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধেও কোহিনূর-এর অবস্থান স্পষ্ট। “আমাদের পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের উপর উর্দ্দুরূপ এক দৈত্য চাপাইয়া দিয়াছেন – আমাদের অসম্মতিতে এবং জোরপূর্বক! আমরা কখনও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিতে পারি না।”৯ ।
‘রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “উর্দ্দুক রাষ্ট্রভাষা করিলে যেন পূর্ববঙ্গবাসীদের কাঁধের উপর একটি বড় ভূত চাপাইয়া দেওয়া হইবে।”১০ । ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে তীব্র ভাষায় ২১শে ফেব্রুয়ারির বর্বর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা এবং প্রকাশ্য ও নিরপেক্ষ আদালতে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করা হয়। পত্রিকাটিতে একুশের ঘটনার আগে ও পরে মাতৃভাষার স্বপক্ষে তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সেগুলির ভাববস্তু ছিল ঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে সমবেতভাবে সোচ্চার হওয়া,১১ রক্ত দিয়ে বাংলাভাষার ভিত মজবুত করার অঙ্গীকার ১২ এবং বাংলাকে হিন্দুর ভাষা বলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও সমগ্র বাঙালির ভাষা হিসেবে ঘোষণা।১৩
রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে কোহিনূর পত্রিকার ইতিবাচক ভূমিকা প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য। পত্রিকাটির ২২ জানুয়ারি ১৯৫৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় পরবর্তী ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ সংখ্যাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশের বিজ্ঞপ্তি। তাতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির অনুকূলে রচনা সম্ভার আহ্বান করে বলা হয় যে, “পাঁচকোটি পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালির কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া কোহিনূরও বাংলাভাষাকে পাকিস্তানির অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিরামহীন সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করিয়া যাইবে।”১৪
উল্লেখ্য, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সংখ্যা’ কোহিনূর আমাদের চোখে পড়ে নি। তবু প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামি ভাবধারায় লালন পত্রিকাটির ঘোষিত উদ্দেশ্য হলেও তা জাতীয়তাবাদী ভাবধারণা লালনের প্রতিবন্ধক ছিল না।
নবসৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোহিনূর-এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট আধুনিক ও বাস্তবমুখী। শিক্ষক ধর্মঘট নিয়ে লেখা এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে পত্রিকাটি শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করে ঃ
“আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির আমূল সংস্কার সাধন করিতে হইবে। বৃটিশের আমলে কেরানী তৈয়ার করিবার জন্য যে শিক্ষাদান করা হইতো এখন ইহার পরিবর্তন করিয়া দেশ কালোপযোগী করিতে হইবে। এখন আমাদের ছেলেরা কেরানী না হইয়া রাষ্ট্রনায়ক হইবে, বড় বড় শিল্পী হইবে। তাই স্বাধীন দেশোপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে।” ১৫
ধর্মশিক্ষা সম্পর্কেও কোহিনূর পত্রিকার ভূমিকা ছিল প্রাগ্রসর। ১৯৫১ সালের ১৪ মার্চ মওলানা আকরম খাঁ-র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আরবী ছাত্র সম্মেলন প্রসঙ্গে লিখিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে ধর্মশিক্ষা বিষয়ে সম্পাদকের যুক্তিনিষ্ঠ, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়ঃ
“ধর্মশিক্ষা যেমন প্রয়োজনীয় আবার অর্থকরী শিক্ষাও অনুরূপ প্রয়োজনীয়। বর্তমান আরবী শিক্ষায় অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি যথাযথভাবে নেছাবভুক্ত না করিলে এই শিক্ষার কোন মূল্য থাকিবে না। বর্তমান জগৎ বিজ্ঞানের যুগ। সুতরাং বিজ্ঞানকে অবহেলা করিলে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারাই হইবে”…..
কোহিনূর পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় সাহিত্যগ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তক, ধর্মীয় পুস্তক ও মননশীল পত্র পত্রিকার পরিচিতি ও সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্পাদকের উদার দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তিবাদী মনোভাব, সাহিত্যপ্রীতি ও মননমুখীনতার পরিচয় লক্ষ্যণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সে সময়ে প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠকের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত বামপন্থী আওয়াজ পত্রিকার ১৬ পরিচিতি প্রকাশে সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল খালেকের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহসী মনের পরিচয় সুস্পষ্ট ঃ
“পত্রিকাটির রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে আমাদের কোন কোন বিষয়ে মতানৈক্য থাকিলেও ইহা যে সুসম্পাদিত তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহার সংবাদ পরিবেশন ও সম্পাদকীয় প্রবন্ধাদির ধরণটি মনোমুগ্ধকর।… দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের দুঃখের শরীক হইয়া যে সকল পত্রপত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে সেগুলি অবশ্যই মুবারকবাদ পাইবার যোগ্য। এইদিক হইতে ‘আওয়াজ’-এর কার্যাবলী প্রশংসনীয়। পত্রিকাটির বহুল প্রচার কামনা করি।” ১৭
সামপ্রদায়িকতা ভাবাপন্ন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রবীন্দ্র-বিরোধী মনোভাব এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেও কোহিনূর রবীন্দ্র প্রতিভার প্রতি ছিল শ্রদ্ধাশীল। কোহিনূর-এর প্রথম বর্ষের ২১তম সংখ্যায় প্রথম লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘চির আমি’ কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথের একনবতিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বকবি’ শিরোনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধ। তাতে রবীন্দ্র প্রতিভার মূল্যায়নে কোহিনূর সম্পাদকের অসামপ্রদায়িক চেতনা ও উন্নত সাংস্কৃতিক বোধের পরিচয় মেলে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সর্ব সমপ্রদায়ের শ্রদ্ধা নিবেদনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাতে লেখা হয়ঃ
“রবীন্দ্রনাথ আজীবন সাধনা দ্বারা সত্য, শিব ও সুন্দরের বন্দনা করিয়া গিয়াছেন। তিনি কোনো বিশেষ সমপ্রদায়ের সুখ, দুঃখ, আশা, আকাঙ্ক্ষাকে লইয়া কাব্য রচনা করেন নাই, তিনি সমগ্র মানব সমাজের আনন্দ কামনায় রচনা করিয়াছেন অসংখ্য গান, অগণন গল্প ও বহুবিধ উপন্যাস। … কবি আজীবন সুন্দরের সাধনা করিয়া গিয়াছেন।”
২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যায় (৭ মার্চ ১৯৫২) মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন ‘পূর্ব বাংলার সাহিত্যের রূপ কি হবে’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের অবদানকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দেন : “রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে বড়। কেননা রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাঙ্গালা ভাষা এবং বাঙালি মুসলমানেরও মাতৃভাষা বাংলা, সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিকটতম আত্মীয়।”
কোহিনূর-এর ১ম বর্ষ ২৩ সংখ্যাটি ছিল নজরুল সংখ্যা। এতে নজরুলকে নিবেদিত কবিতাসহ নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘সৈনিক কবি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে রাবীন্দ্রিক যুগে নজরুলের সাহিত্যিক অবদানকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে গণ্য করা হয়। ইসলামি গান রচনায় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের অবদান স্বীকার করেও নিবন্ধে নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে মন্তব্য করা হয় যে-
“যে আবহাওয়ার মধ্যে তাঁহাকে কাটাইতে হইয়াছে তাহা ইসলামের পরিপন্থী ছিল। তাই বাধ্য হইয়া তাঁহাকে এক অনৈসলামিক স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইয়াছে। ইসলাম এরূপ অনৈসলামিক স্ত্রী গ্রহণে অনুমতি দেয় না। সুতরাং তাহার চালচলন যে ইসলাম বহির্ভূত হইবে এবং এইরূপ স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের নাম যদি ‘সব্যসাচী’ ইত্যাদি হয় তাহতে বিস্মিত হওয়ার কী আছে?”
সাপ্তাহিক কোহিনূর-এর ৪র্থ বর্ষ ১৫-১৬ সংখ্যা নজরুল সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৮ এতে নজরুলের নিবেদিত কবিতা ও নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় মহান নজরুল’ নামে সম্পাদকীয়।এই সম্পাদকীয়তে নজরুলকে জনগণের ও বিশ্বমানবতার কবি এবং মহাকবি হিসেবে চিহ্নিত করে বর্ধমান হাউসের একটি শাখাকে নজরুল একাডেমী হিসেব প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। দেখা যাচ্ছে, প্রথম বর্ষের নজরুল সংখ্যার সম্পাদকীয়তে নজরুল সম্পর্কে যে দ্বিধা ছিল চতুর্থ বর্ষের সংখ্যায় তার লেশমাত্র নেই। আরও একটি ক্ষেত্রে কোহিনূর-এর উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫৪ সালের ২৩-২৬ এপ্রিল ঢাকার কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, কাজী আবদুল ওদুদ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী-সাহিত্যিক তাতে যোগ দেন। সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক শিল্পীসাহিত্যিকদের একটি দল অংশগ্রহণ করে। বামপন্থী ও প্রগতিশীল এই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি চট্টগ্রামে বহুদিন আগেই শুরু হয়েছিল। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় তিনমাস আগে কোহিনূর পত্রিকা সাহিত্য সম্মেলন’ নামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশবিভাগের প্রেক্ষাপটে সাহিত্য চর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টির উল্লেখ করে সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণকে স্বাগত জানায়। সম্পাদকীয়তে আশা প্রকাশ করা হয় যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাস্তব সমাজ ব্যবস্থা পত্তন, সুন্দরের সন্ধানে নতুনভাবে মনোভূমি কর্ষণ’, সাহিত্যজগতে বিপুল গণতান্ত্রিকতার আবির্ভাব, পূর্ববঙ্গে সাহিত্যিক প্রগতি সম্পর্কে নতুন আলোকপাতের পাশাপাশি সাহিত্য সম্মেলন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আদায়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারবে।১৯ বামপন্থীদের এ ধরনের উদ্যোগের প্রতি স্বাগতিক মনোভাব কোহিনূর-এর উদার সাহিত্য চেতনারই পরিচায়ক।
কোহিনূর-এর ঘোষিত লক্ষ্য ইসলামি ভাবধারার প্রচার হলেও এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এখানে যে, এতে অন্য সমপ্রদায়ের লেখকদেরকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই পাকিস্তানি জজবার যুগেও পত্রিকাটির অসামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রথম সংখ্যাতেই। বিশ্বনবী সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত সেই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় তেজেন্দ্রকুমার নাথের ‘ওগো বিশ্বনবী’ কবিতা। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষে বিশ্বনবীকে নিয়ে ‘নবীপ্রণাম’ শীর্ষক কবিতা লিখেছেন অশোক বড়ুয়া।
এছাড়া বিভিন্ন সংখ্যায় কবিতা লিখেছেনঃ কল্যাণী সেন, নির্মলচন্দ্র পাল, জ্যোৎস্না রায় চৌধুরী, কল্যাণী সেনগুপ্তা, ননীগোপাল দাশগুপ্ত, কিরণচন্দ্র তালুকদার, জ্যোৎস্না রাণী চৌধুরী, অশোক বড়ুয়া, নিকুঞ্জ বড়ুয়া প্রমুখ। গল্প লিখেছেন মণীন্দ্রলাল দে এবং প্রবন্ধ লিখেছেন নির্মলচন্দ্র পাল,মোহিনীমোহন দত্ত, কল্যাণী সেনগুপ্তা, মণীন্দ্রলাল দে, জীবন রায় প্রমুখ। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্ম সম্পর্কিত লেখাও কোহিনূর নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যামিনীরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা দুর্গাপূজা বিষয়ক নিবন্ধ ‘বিজয়া দশমী’২০ এবং ফতেনগর বৌদ্ধ জাতীয় মহাসভায় প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ।২১,
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাপ্তাহিক কোহিনূর আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, ধর্মপ্রচারের একমাত্র লক্ষ্য সামনে রেখে প্রকাশিত হলেও তা ধর্মীয় বাতাবরণকে ছাপিয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য-শিল্পের প্রসারে এবং দেশ-হিতৈষণায় এই পত্রিকার অবদান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বিশেষ করে এর অসামপ্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং বহু ক্ষেত্রে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি পত্রিকাটিকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে।
সূত্র নির্দেশ
১। পত্রিকাগুলি হচ্ছে : মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) সম্পাদিত মোহাম্মদী (১৯০৩-১৯৭০), মৌলবী মুম্মদ নূরুল হক (১৯০৭-১৯৮৭) প্রকাশিত আল ইসলাহ(১৯৪৭-১৯৭১), মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বি. এল (পরে মো. হেমায়েত আলী) সম্পাদিত নওরোজ (১৯৪২-১৯৭১)। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন: ইসরাইল খান, বাংলা সাময়িকপত্র ঃ পাকিস্তান পর্ব, ঢাকা, ২০০৪।
২। আবদুর রশিদ ছিলেন মাহেনও পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। পরে একে একে এর সম্পাদক হন ; মীজানুর রহমান, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, আবদুল কাদির, তালিম হোসেন প্রমুখ। মাহেনও সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন : ইরাইল খান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৭৮-১৯৮। ৩। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন ঃ ইসরাইল খান, পূর্বোক্ত, পৃঃ.১৭৮-১৯৮। ৪। পরিচালকমন্ডলীর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সুধাংশু রায়, প্রভাত সরকার, সাধন চ্যাটার্জী, ফুলদা রায়, জীবর গোস্বামী প্রমুখ। দ্রঃ ইসরাইল খান, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৬৭। ৫। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন : ইসরাইল খান পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৬৬-৫২৭। ৬। কোহিনূর-এর প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ২২.১২.১৯৫০ তারিখে ঈদে মিলাদুন্নবী সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ৭। সাপ্তাহিক কোহিনূর, ১:২ (কায়েদে আজম সংখ্যা) পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৫। ৮। পূর্বোক্ত, ১:১৩, ১৬.৩.১৯৫১। ৯। পূর্বোক্ত, পূঃ ১৫৮। ১০। পূর্বোক্ত, ১:১৯, ৪.৫.১৯৫১, পৃঃ ২৩১। ১১। মতিউল ইসলাম, ‘বাংলা ভাষা’, কোহিনূর ২:৫, ১৫.২.১৯৫২, পৃঃ ৮১। ১২। এম. ফজলুল হক, ‘বাংলা ভাষা’, পূর্বোক্ত, ২:৮, ১৪.৩.১৯৫২, পৃঃ ১৪১। ১৩। মোতাসিম বিল্লা, ‘বাংলা ও বাঙালি’, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩৩। ১৪। দ্র.: কোহিনূর-এর ৪:৩ সংখ্যায় (২২.১.১৯৫৪) প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি। ১৫। দ্র.: কোহিনূর, ১:১৭। ১৬। যতদূর জানা যায়, এটি ছিল চট্টগ্রামের প্রথম বামপন্থী সাময়িক পত্রিকা। ১৭। দ্র.: পত্রিকা পরিচয়, আওয়াজ – ১ম বর্ষ ১৮শ সংখ্যা। সম্পাদক: চৌধুরী হারুনুর রশীদ, কোহিনূর, ১:১১। ১৮। দ্বিতীয় বর্ষের নজরুল সংখ্যা আমাদের চোখে পড়েনি। তৃতীয় বর্ষের নজরুল সংখ্যায় প্রচ্ছদে নজরুলের ছবি এবং ভেতরে নজরুলকে নিবেদিত কবিতা থাকলেও প্রবন্ধ, কবিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নজরুল সংখ্যা প্রকাশ করতে না পারায় সম্পাদক ক্ষমা চেয়েছেন। ১৯। দ্র.: কোহিনূর, ৪:৩, (২২.১.১৯৫৪)। ২০। দ্র.: কোহিনূর, ২:৩১-৩২, (১০.১০.১৯৫২) ২১। দ্র.: কোহিনূর, ২:৩৩-৩৪, (১৭.১০.১৯৫২)।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ; প্রাবন্ধিক