চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ফুল ডে ট্যুর

জয়দীপ দে | সোমবার , ১৭ জুলাই, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

ঈদের ছুটিতে মাকে দেখতে চট্টগ্রাম যাব। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে চোখে পড়ল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের একটি নোটিশ। তারা চট্টগ্রাম জেলার পর্যটন স্পটগুলোর যাতায়াত সহজতর করতে একটি দিনব্যাপী ট্যুর সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছে। এর উদ্বোধন ১ জুলাই। এরপর থেকে প্রতি শুক্র ও শনিবার এ সার্ভিস চলবে। ফোন করলাম বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া নম্বরে। ধরলেন জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা। তাঁর আন্তরিক কথোপকথনে মনে হলো, না গেলে মিস হবে। সঙ্গে সঙ্গে বুক করলাম।

১ জুলাই। ঈদের তৃতীয় দিন। ছুটির শহর। ফাঁকা রাস্তা। কয়েকদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল। ভয় ছিল পাছে বৃষ্টি না ভ্রমণটা পণ্ড করে দেয়। কিন্তু ভাগ্য সহায়। সকালে চারদিক আলো করে সূর্যমামা চোখ মেলেছেন।

ঠিক সাড়ে ৮টায় যাত্রা করল পর্যটকবাহী ৪টি বাস। সব মিলে ৪০ জন পর্যটক। উদ্বোধনী যাত্রা বলে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এ ট্যুরের সমন্বয়ক চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা জামশেদ আলম রানা আর তাঁর দলবল।

ঈদের ছুটির জন্য ঢাকাচট্টগ্রাম হাইওয়ে ছিল ফাঁকা। বর্ষার কারণে চারদিকে সজীব প্রকৃতি। সবুজের সমারোহ। হাইওয়ের মিডিয়ানে প্রচুর ফুলের গাছ। বিশেষ করে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার রূপে ঝলমল করছিল রাস্তা। মহাসড়কের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম। নাস্তার প্যাকেটে ছিল স্যান্ডুইচ ও সমুচা। সঙ্গে পানির বোতল। ঠিক দশটায় আমরা শহর থেকে ৭৮ কিলোমিটার দূরে মহামায়া লেক ও ইকোপার্কে হাজির হই। মহাসড়ক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে লেকটি অবস্থিত। গেটে প্রবেশের আগে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসনের উদ্যোগের কারণে আমরা বিশেষ ছাড় পাই। এন্ট্রি ফিও দিতে হলো না। গাড়ি একেবারে বাঁধের উপরে গিয়ে থামে। মহামায়া ছড়া থেকে আসা পানি বাঁধের মাধ্যমে আটকে ১১ বর্গকিলোমিটার বিশাল এ লেক তৈরি করা হয়েছে। ২২০ মিটার বাঁধের নিচে সারি ধরে পর্যটনের নৌকা সাজানো। কিছু নৌকা প্যাডেল বোট। ঘণ্টা ৪০০ টাকা হিসেবে ভাড়া নিয়ে ৪ জন মিলে লেকে ভ্রমণ করা যায়। আর আছে কিছু ইঞ্জিন নৌকা। সেসব ১০০০ টাকায় রিজার্ভ নিলে কিছু দূর নিয়ে মহামায়া ছড়া দেখিয়ে আনবে। এছাড়া কাইকিংএরও ব্যবস্থা আছে লেকে। কিন্তু এ শান্ত জলে কী কাইকিং হবে বুঝলাম না।

চারদিকে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা লেকটি প্রকৃতিপ্রেমীদের মন কাড়বে। লেকের পাহাড়ে ইকোপার্ক। সেখানে নানা জাতের গাছের সমারোহ। তবে এটা ঠিক, এই পর্যটন স্পটে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য আরো অনেক ব্যবস্থা রাখার সুযোগ আছে। জয় রাইড, রোপওয়ে এসব থাকলে পর্যটকরা আরো অধিক সময় এখানে কাটাতে পারতেন। এখানে প্রচুর ফলের গাছ দেখতে পেলাম। এসব ফল দিয়ে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন করে এখানেই বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মানসম্মত টয়লেট ও খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত। এসব অবশ্য জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব নয়। তারপরও কাউকে না কাউকে তো উদ্যোগ নিতে হবে। তাই লেখা।

ঠিক ১১টায় আমরা রওনা দিলাম সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের উদ্দেশ্যে। এখানেও আমাদের ভিআইপি অভ্যর্থনা। গাড়ি সরাসরি উঠে গেল সহস্রধারা জলপ্রপাতে নামবার পথের মুখে। ১,৯৯৯ একর বিস্তৃত বিশাল এ বনভূমির প্রায় শেষ প্রান্তে এই ঝর্নাটি। গেট থেকে অটোরিকশা রিজার্ভ করলে ৩০০ টাকা লেগে যায়। এতো দূর গাড়ি আসায় নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে হলো। উপভোগ করলাম গহীন অরণ্যের রোমাঞ্চ। গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম আমাদের পর্যটনের দৈন্য দশা। একটা পাবলিক টয়লেট আছে। কিন্তু সেখান পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। নোংরা হতে হতে এমন দশা হয়েছে ধারেকাছে ঘেঁষবার সুযোগ নেই। চারদিকে প্লাস্টিকের আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগত পর্যটকদের বনভূমির সৌন্দর্য উপভোগের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না। একটি মাত্র দোকান থেকে পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য কিনছিলেন দর্শনার্থীরা। প্রতিটি পণ্যের দাম গায়ের দামের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। আমাদের দেশে পর্যটন মানেই যেন অরাজকতা।

রাস্তা থেকে সহস্রধারা ঝর্নাটি বেশ দূরে। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার হবে। সিঁড়ির সংখ্যা শ পাঁচেক হবে। সেসব বেশ খাঁড়া ও বিপজ্জনকও। তাই শারীরিকভাবে অক্ষমরা এ ঝুঁকিতে না যাওয়াই শ্রেয়। আমরা কিন্তু এ যাত্রাপথটি বেশ উপভোগ করলাম। ঝর্নাটি বেশ উঁচু ও বেগবান। দৃষ্টিনন্দন। ঝর্না দর্শন শেষে আমরা দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। সত্যি বলতে কী ভদ্রস্থভাবে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও জামশেদ আলম রানার বিশেষ উদ্যোগে আমাদের জন্য বসার জায়গা করা হলো। বনের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে মনের আনন্দে খেলাম। প্রতিটি প্যাকেটে প্রচুর পরিমাণ ভাত, বড়ো একটা মোরগের মাংসের টুকরো, কাঁচাকলা ভর্তা আর ডিম ছিল। স্বাভাবিকের তুলনায় খাবারের পরিমাণ বেশি। মানও ভালো। তবে ভাতের পরিমাণ কমিয়ে সঙ্গে টিস্যু ও চামচের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

সেখানেই কথা হলো জামশেদ আলম রানার সঙ্গে। তিনি জানালেন জেলা প্রশাসনের ট্যুরিজম সেলের মাধ্যমে এই উদ্যোগটি নিয়মিত করা হবে। আরো জানতে পারলাম, পারকি সমুদ্র সৈকত, বাঁশখালী ও ফটিকছড়ির চা বাগান নিয়ে উত্তর চট্টগ্রামে আরেকটি ট্যুর সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা আছে তাঁদের।

উল্লেখ্য, গত ১০ জুন থেকে নিউ মার্কেট হতে পতেঙ্গা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য বিআরটিসির ডাবল ডেকার (একটি ছাদখোলা) বাস সার্ভিস চালু করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এরই মধ্যে এই বাস সার্ভিস পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসু দর্শনার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পর্যটকদের চাহিদা মেটানোর জন্য নিউ মার্কেট হতে পতেঙ্গা রুটে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে দুটি অতিরিক্ত বাস সংযোজন করা হয়েছে। এক পথের ভাড়া মাত্র ৭০ টাকা। জামশেদ জানান, ২০ দিনে এই বাস সার্ভিস সব খরচ মিটিয়ে ৯১ হাজার টাকা লাভ করেছে। তাই তারা এখন আশাবাদী।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা রওনা দিলাম গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতের উদ্দেশ্যে। এখানকার অভিজ্ঞতা সুখপ্রদ ছিল না। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে সরু পথ ধরে আমরা সৈকতের প্রবেশ রাস্তায় হাজির হই। কিন্তু রাস্তা এত সরু আর বন্ধের দিনে গাড়ির আধিক্যের কারণে কোনোভাবেই আমাদের গাড়িগুলো ঢুকতে পারছিল না। শেষে গাড়ি ঘুরিয়ে মুরাদপুর বেড়িবাঁধে নেয়া হলো। কিন্তু সেখান থেকে সৈকতে যাওয়ার কোনো গাড়িপথ নেই। ফলে কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে ১ কিলোমিটার হেঁটে সৈকতে যেতে হলো সবাইকে। ভাটার কারণে সমুদ্র অনেক দূরে ছিল। কষ্ট করে গিয়েও সৈকতটি সেভাবে উপভোগ করা গেল না। সৈকত ও এর আশেপাশে শৌচাগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পরিবার নিয়ে গেলে ভোগান্তি পোহাতে হয়। গুলিয়াখালী সফরসূচিতে না রাখলেই ভালো হতো। এই সময়টা সীতাকুণ্ড ইকোপার্কে দিলে ভ্রমণপিপাসুরা সুপ্তধারা ঝর্না ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটি দেখে আসতে পারতেন।

সেখানে দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে আমরা গেলাম ফৌজদারহাট ডিসি হিল। এই একটা স্পট ভ্রমণের জন্য দশে দশ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সুন্দর শৌচাগার। নান্দনিক পরিবেশ। খাবারের সুব্যবস্থা। দীর্ঘ ১০ বছর অবৈধ দখলে থাকা ২০০ একর খাস জমি ও জলাশয় উদ্ধার করে এই বিশাল পার্কটি করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চারদিকে প্রচুর ফুল। বিশাল জলাশয়ে কাইকিং ও প্যাডেল নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। অল্প দূরেই সাগর। তাই বাতাস আর বাতাস। নির্মল পরিবেশে মনটা চনমনে হয়ে উঠবে। পার্কটির একটি সুন্দর নাম রাখলে ভালো হতো।

সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় শেষ হয় আমাদের সারা দিনের ঘুরাঘুরি। পর্যটন স্পটগুলো জনপ্রিয় করে তুলতে জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। এতে একযাত্রায় দুই ফল হবে। সাধারণ নাগরিকদের ভ্রমণ সহজতর হবে, পাশাপাশি পর্যটন স্পটগুলো প্রশাসনের নজরদারিতে থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধগরম তেলের ঝলসানি ৩ রিভারসাইড হাসপাতাল